ভাবনার রথযাত্রা

সম্ভবত সালটা তখন ১৯৯০ হবে | মহা ধুমধামের সঙ্গে কলকাতার পার্ক স্ট্রীট এলাকা থেকে থেকে ইসকনের উদ্দ্যোগে শ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে | পুরীতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রায় যেসব আচার অমুস্তান পালন করা হয় বহুলাংশে তারই অনুসরণ করা ২য় কলকাতার ইসকনের রথে | পুরীতে রথের চাকা গড়ানোর আগে জগন্নাথদেবের রথের সম্মকবর্ত্তী পথটি সোনায় বাঁধানো ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে দেন পুরীর রাজা | সেবার কলকাতায় ইসকনের উদ্যোগে সুসজ্জিত জগন্নাথদেবের রথের সম্মুখস্থ পথটি সোনায় বাঁধানো ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে দিলেন কলকাতায় অবস্থিত তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার দূতাবাসের কনসাল জেনারেল | সোভিয়েত রাশিয়া তখনও অভিভক্ত, তখনও কমিউনিস্ট পাটির শাসনাধীন সমাজতান্ত্রিক দেশ | সোভিয়েত সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতিটি নাগরিকের ক্রিয়া-কর্ম গতিবিধির উপড় তখনও কমিউনিস্ট পার্টির এবং গোয়েন্দা সংস্থা কে-জি-বি-র করা নিয়ন্ত্রণ দেশের সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে এদিকে আবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট গরবাচেভ তাঁদের ভাষায় 'গ্লাসনস্ত  পেরেস্ত্রৈকা' অর্থাৎ দেশের জন্য লিবারালাইজেশন, প্রাইভেটাইজেশন, গ্লোবালাইজেশন (সংক্ষেপে এল-পি-জি)-এর সমর্থনে জোরালো সওয়াল করছেন |

এহেন পরিস্থিতিতে ধর্মে অবিশ্বাসী একটি কমিউনিস্ট শাসিত দেশের রাষ্ট্রদূত ঘোর ধর্মবিশ্বাসী ও সংস্কারাচ্ছন্ন ব্যক্তির মতো জগন্নাথদেবের রথের যাত্রাপথ ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করেছেন-----একথা প্রচারিত হওয়া মাত্র আমাদের দেশের কমিউনিস্ট কর্মী এবং বামপন্থীদের মহলে শোরগোল পড়ে গেল, গেল গেল বর উঠল | একটি কমিউনিস্ট দেশের রাষ্ট্রদূতের শেষ পর্য্যন্ত এত অবনতি, এত ধর্মান্ধতা |

আমাদের রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের সরকার তখন সি-পি-এই-এমের নেতৃত্বধীন বামফ্রন্টের দ্বারা পরিচালিত | তখন পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রীসভার তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের মন্ত্রী শ্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য | ঐসব শোরগোলের কথা শুনে তিনি যা বললেন, তা একটি চিরস্বরণীও কথা | বুদ্ধদেব বললেন----- রাশিয়ার কনসাল জেনেরাল জগন্নাথের রথের সামনের রাস্তা ঝাঁট দিয়েছেন | তাই বলে কমিউনিস্টদের এত গেল গেল বর তোলার কোনও অর্থ হয় না | একজন চিকিৎসক যদি ভুল করেন, তাঁর দ্বারা এটা প্রমাণিত হয়না যে চিকিৎসা বিজ্ঞানই ভ্রান্ত | বরং সেই ভুল করার ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়, তার আলোক চিকিৎসা বিজ্ঞান আরও সমৃদ্ধ হয় | ঠিক তেমন করে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতের একটা ভ্রান্তি এটা প্রমান করেনা যে কমিউনিজমের মতাদর্শ এবং তত্ত্ব পুরোপুরি ভ্রান্ত বা ব্যর্থ | ওনার করা ভুলের থেকে আমরা শিক্ষা নেব, যাতে আর পুনরাবৃত্তি না হয় |

এমন প্রাঞ্জল যুক্তিবিন্যাস স্বভাবতই মনকে শ্রদ্ধাবনত করে | এমন সুন্দর যুক্তিবিন্যাস আর এক দিক দিয়ে চেতনায় আলোক সম্পাত করে |

পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গেছে বরাবর ধর্মধ্বজীরা ধর্মীয় মৌলবাদীরা কিছু শ্রেণীর মানুষের উপড়ে, কিছু ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষের উপড়ে নিজেদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে জঘন্য রকমের বলপ্রয়োগ করেছেন, প্রতারণা করেছেন, অবর্ণনীয় অত্যাচার করেছেন, জোর করে ধর্মান্তর করে নিজেদের ধর্মসম্প্রদায়ভুক্ত করেছেন | দেশে দেশে এরকম অনেক অত্যাচার হয়েছে, অনেক রক্তের স্রোত বয়ে গেছে | অনেক সময় দেখা গেছে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মের দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করেছে অশান্তি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে | ধর্মান্ধতার উন্মত্ত আঘাতে পৃথিবীর বহু দেশে সাধারণ মানুষের যান, ম্যান, প্রাণ ও সম্পত্তি ধ্বংস হয়ে গেছে |

এ ধরণের বর্বরোচিত ঘৃণা ও হিংসা দেখে দেখে, অশ্রুপাত করতে করতে, যুগে যুগে মানুষের মনে দুধরণের প্রতিক্রিয়া হয়েছে | যে ধর্মসম্প্রদায়ের স্বার্থান্বেষীরা মানুষের প্রতি নৃশংস আচরণ করেছেন, সেই ধর্মমত এবং সেই ধর্মমতাবলম্বীরদের প্রতি সাধারণ ভাবে মানুষের মনে চরম অশ্রদ্ধা, ঘৃণা, ক্রোধ ও অবজ্ঞা বাসা বেঁধেছে | অবিশ্বাসের করাল ছায়া আজও বহু মানুষের মনকে গ্রাস করে রয়েছে----এটি একটি দিক | আর এক ধরণের প্রতিক্রিয়া হলো এই যে---- অনেক মানুষ 'ধর্ম' বিষয়টির সম্বন্ধেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছেন | ধর্মকে তাঁরা অফিসের নেশা বলে মনে করেন | তাঁদের কাছে ধর্ম বিষয়টাই বুজরুকিতে ভরা লোক ঠকানোর কল | ধর্মশিক্ষার চর্চা ও আলোচনা তাদের কাছে বিষবৎ লাগে, অবৈজ্ঞানিক মনে হয় |

এই দুই ধরণের প্রতিক্রিয়া বস্তুত কিছু ধর্মীয় মৌলবাদীর করা ভ্রান্তির ফল | সেই সব ভ্রান্তি নিশ্চই ইটা প্রমান করেনা----- যে কোনও বিশেষ ধর্মমত ভ্রান্ত, কোনও বিশেষ ধর্মবলম্বীররা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত পথের পথিক, অথবা ধর্ম বিষয়টিই প্রমান সাপেক্ষ নোই অতয়েব যাবতীয় ভ্রান্তির জন্মদাতা |

প্রকৃত বিচারে সত্যানুরাগ এবং ধর্ম হাত ধরাধরি করে চলে | সত্যানুরাগ মানে সত্যের প্রতি অনুরাগ | এই সত্যের বিচার কিন্তু এই ব্যক্তি সত্য কথা বলে, ঐ ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলে, এই ধরণের বিচার নয় | এখানে সত্য বলতে বোঝায় সেই স্বত্বা যাহা অমর, অব্যয়, অক্ষয়রূপে নিত্যবর্তমান আদি অনন্তকাল ধরে | তিনিই নিত্যবস্তু, তিনিই আদি শক্তি জগৎকে ধারণ করে আছেন | "ধৃয়তে অনেনেতি ধর্ম" ---- যাহা ধারণ করে রাখে তাহাই ধর্ম | অতয়েব জীবনে যে পথ অগ্রসর হলে সত্যের প্রতি, ব্রক্ষের প্রতি বা ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগ অর্থাৎ ভালবাসা জন্মায় ও পুষ্টিলাভ করে, সেই পথের নাম ধর্ম | জীবনে যে পথে অগ্রসর হলে সত্যের অনুসন্ধান কার্য্য সাফল্য আসে, তাহাই ধর্ম | এ বিষয়ে পৃথিবীর সকল ধর্মমত একই শিক্ষা দেয়, একই প্রত্যয় ঘোষণা করে |

পৃথিবীর সকল ধর্মমতের এই সারকথা, এই বিশ্বাসের ভিত্তি উপলব্ধি করতে গেলে বিশেষ জ্ঞান অর্থাৎ বিজ্ঞানের তন্নিষ্ঠ চর্চার প্রয়োজন | এই চর্চার নাম সাধনা | পৃথিবীর প্রতিটা ধর্মমতকে একটি একটি করে অবলম্বন করে, পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বিজ্ঞান চর্চা অর্থাৎ সাধনা করেছিলেন | সেই এক একটি সাধনা ছিল এক একটি সংগ্রাম | সেই সংগ্রামে জয়ী হয়ে, সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তিনি প্রত্যক্ষ প্রমান পেয়েছিলেন এবং উপলব্ধি করেছিলেন যে প্রত্যেকটি ধর্মমতই মানুষকে সফলভাবে ব্রহ্ম তথা ঈশ্বর উপলব্ধির রাজ্যে পৌছিয়ে দিতে পারে | অতয়েব প্রত্যেকটি ধর্মমতই সত্য | তাই তিনি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছেন---"যত মত, তত পথ" | তাই তিনি প্রত্যেকটি ধর্মমতের প্রতি, ধর্মাবলম্বীদের প্রতি শ্রদ্ধাবান হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন আমাদের |

অতয়েব ধর্মধ্বজী এবং ধর্মীয় মৌলবাদীদের করা ভুলের থেকে আমরা শিক্ষা নেব, যাতে তার পুনরাবৃত্তি না হয় |

More Articles