কৃত্তিবাসী নয়, গো-বলয়ের পেশিবহুল রামই এখন বাংলার ইভিএম মেশিন?

Ramnavami BJP Trends Jay Sree Ram West Bengal : কালী-দুর্গা-শিবের আরাধনা করা বাঙালি কি হঠাৎ করেই রাম ভক্ত হয়ে উঠল, নাকি কার্যত জোর করেই তাকে ভক্ত বানানো হলো?

দীর্ঘদিন ধরেই ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গ হয়ে উঠেছেন রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্র। বিষ্ণুর সপ্তম অবতারের ভূমিকা ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন নয়, বিশেষত উত্তর ভারতে ভগবান রাম মানেই রাজনীতির এক প্রধান অস্ত্র। ভারতীয় জনতা পার্টির প্রচারে রাম হয়ে ওঠেন একটি বড় এজেন্ডা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এই আবহ একটু নতুন। বছর সাত-আটেক আগেও রামনবমী নিয়ে এত বাড়-বাড়ন্ত কিন্তু চোখে পড়েনি। কালী-দুর্গা-শিবের আরাধনা করা বাঙালি কি হঠাৎ করেই রাম ভক্ত হয়ে উঠল, নাকি কার্যত জোর করেই তাকে ভক্ত বানানো হলো?

ভারতের অন্যান্য রাজ্যে কারও সঙ্গে সাক্ষাতের সময় 'রাম রাম' বলাটা একটা রেওয়াজ। অনেকদিন ধরেই এমনটা চলে আসছে। বাংলায় কিন্তু সেরকমটা নয়। শবযাত্রাতেও আমাদের আশ্রয় থাকে 'বলো হরি, হরি বোল'; রামের নাম সেখানে ব্যবহার করি না। বাড়ি থেকে বেরনোর জন্য 'দুগ্গা দুগ্গা' বলাই যথেষ্ট বাঙালির জন্য। কিন্তু সেই রাজ্যেই আজ পালা করে রামের পুজো করা হচ্ছে। 'রাম রাজ্যের' পথে শাসন পরিচালনা করতে চাইছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টি। আর সেই রাম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতেই যাবতীয় সংগ্রামের পথে বিজেপি নেতারা। সেই সুবাদেই হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির নিজস্ব রাম, সুপ্রাচীন কৃত্তিবাসী রাম। সেসব সরিয়ে আমদানি ঘটেছে হিন্দিবলয়ের পেশিবহুল রামের। তাই রামনবমী উদযাপন নিয়ে বিশেষ উন্মাদনা গেরুয়া শিবিরের মধ্যে। এই উন্মাদনা খানিক ক্ষমতার আস্ফালনও নয় কি? বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে ভোট রাজনীতির দিকে তাকিয়ে এমন আস্ফালনই কি চায় রাম ভক্তরা? রামের নামে রাজনীতি, কিংবা রামনবমীর এতটা চল ছিল না, যা চালু হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে।

আরও পড়ুন : ভয় দেখানো হিন্দুস্তানি পুরুষোত্তম নয়, বাংলার ছিল শূদ্রপ্রিয় এক রাম…

'জয় শ্রী রাম' - আপাতদৃষ্টিতে রামকে দেবজ্ঞান মনে করে করা একটি স্লোগান। আর এখন সেটাই হয়ে উঠেছে বিজেপির প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার। আন্তর্জাতিক যুদ্ধের প্রেক্ষিত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস দেখলে 'ওয়ার ক্রাই' (War cry) শব্দটি বারবার সামনে আসে। 'জয় শ্রী রাম' কি আদতে বিজেপির রাজনৈতিক 'ওয়ার ক্রাই'? বিশ্লেষকদের একাংশ এতে সায় দিচ্ছেন। সারা দেশে হিন্দুত্ববাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ বৃদ্ধি করতে বিজেপি এই স্লোগানকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ভোটের প্রচার থেকে শাসকের বিরোধিতা, সব ক্ষেত্রেই যেন রামের ছড়াছড়ি। তবে এই স্লোগানের ইতিহাস শুরু হয়েছিল আজ থেকে কয়েক দশক আগে। ১৯৯২ সালে অযোধ্যায় রাম মন্দিরের করসেবকরা ধ্বংস করেছিলেন সুপ্রাচীন বাবরি মসজিদ। আদতে রাম জন্মভূমি আন্দোলনের স্লোগান হিসেবেই তখন উঠে এসেছিল এই শব্দবন্ধ। করসেবকদের দাবি ছিল, রামের জন্মস্থানের উপরেই নাকি তৈরি হয়েছিল এই মসজিদ!

মূলত সেই আন্দোলন থেকেই সারা ভারতে জনপ্রিয়তা পেল এই 'জয় শ্রী রাম' স্লোগান। ১৯৮০-র দশকে বাংলা তথা সারা ভারতেই এই স্লোগান উঠতে আরম্ভ করেছিল। বাংলাতেও এর ব্যাপক ছাপ পড়তে পারত; তবে তৎকালীন বাম সরকারের কঠোর মনোভাবের কারণে বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি তৎকালীন বিজেপির উচ্চপদস্থ নেতারা। 'জয় শ্রী রাম' স্লোগান এবং 'গর্ব সে বোলো হম হিন্দু হ্যায়', এই জাতীয় পোস্টার কলকাতায় দেখা গিয়েছিল বটে, তবে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর তৎপরতায় পালে হাওয়া পায়নি বিজেপি।

কিন্তু রাম যে একেবারেই বিজেপিকে সাহায্য করেনি সেরকমটা বলা যায় না। আশির দশকের শেষের দিকে বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানির নেতৃত্বে বাংলায় অনুষ্ঠিত হয় বিশাল রাম রথযাত্রা। ব্যাপক মানুষ যোগদান করেন এই রথযাত্রায়। আর এর প্রভাব পড়ে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে। সে বছর বিধানসভা নির্বাচনে ২৯১টি আসনে প্রার্থী দিয়ে বিজেপি নিজেদের ভোট শেয়ার ০.৫১ থেকে ১১.৩৪ শতাংশে নিয়ে গিয়েছিল। তবে, ১১ শতাংশ ভোট পেলেও, বাঙালির রামচর্চা তখনও তেমন ভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি।

আরও পড়ুন : উগ্র ক্ষত্রিয় রাম নয়, হাওড়ায় পূজিত হয় বাঙালির আদি সবুজ রাম

তবে লক্ষণীয় বিষয়টি হলো, বাংলায় রামের জনপ্রিয়তা এবং 'জয় শ্রী রাম' স্লোগানের ছড়িয়ে পড়া দীর্ঘ সময় ধরেই বাংলায় বিজেপির উত্থানের ধনাত্মক অনুঘটক হয়ে থেকেছে। ৯০-এর দশকে অল্প বিস্তার বিজেপির জনপ্রিয়তা বাড়লেও, বামের চাপে রাম পিছিয়ে পড়তে থাকে ক্রমাগত। ২০১১ সালে পালাবদলের পর আবারও নতুন করে শুরু হয় বিজেপির রাম অভিযান। ২০১৭ সালে বিজেপির হাত ধরে বাংলায় শুরু হয় পেশিবহুল উত্তর ভারতীয় রামের পুজো। তার সাথেই ক্ষুণ্ণ হতে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক পরিবেশ। পিছিয়ে পড়তে থাকে বাঙালির নিজস্ব রাম, কৃত্তিবাসী আখ্যান।

২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি এলাকায় রামনবমী পালনকে কেন্দ্র করে ঘটে বেশকিছু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং সংঘর্ষের ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্প শহর আসানসোলে রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে হিন্দু আর মুসলিমদের মধ্যে হয় সংঘর্ষ। স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিকের ছবিতে উঠে আসে সেই ছবি। হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার মানুষের রামনবমীর মিছিলের পাশে জড়ো হয়েছেন প্রচুর সংখ্যক মুসলমান। আর তারপরেই হঠাৎ শুরু হয় সংঘর্ষ। কোথাও জ্বলেপুড়ে যাওয়া দোকান, পুড়ে যাওয়া গাড়ির কঙ্কাল, রাস্তার ধারে বাতিস্তম্ভে ঝুলতে থাকা ভাঙা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা, পাথর ছোঁড়াছুঁড়ি থেকে দোকান ভাঙচুর, কী না হয় ওই রামনবমীর মিছিলে!

দাঙ্গা যে শুধু আসানসোল শিল্পাঞ্চলে হয়েছিল, তা নয়। পশ্চিমবঙ্গের নানা এলাকাতেই ছড়িয়ে পড়েছিল এমন অশান্তি। গেরুয়া বস্ত্র পরে, কপালে লম্বা টিকা লাগিয়ে অস্ত্র হাতে মানুষের মিছিল দেখতে সেই সময় অভ্যস্ত ছিল না বাংলা। এই নিয়েই শুরু হয় তীব্র বিতর্ক। সেই সময় বিজেপির পক্ষ থেকে পাল্টা দাবি করা হয়েছিল, মহরমের মিছিলেও তো অস্ত্র থাকে। আর এই অস্ত্র তো রামনবমীর প্রতীক! ঐদিন বাংলার বহু জায়গায় মানুষের ভিড় দেখে বিজেপির নেতারা বলতে শুরু করেছিলেন, তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকারের তোষণের রাজনীতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে বাংলার সাধারণ জনতা। যদিও অস্ত্র কী করে রামনবমীর প্রতীক হয়, তার সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন : জয় শ্রীরাম: ছিল নিরীহ স্লোগান, গেরুয়া ‘অস্ত্র’ হয়ে উঠল যেভাবে…

বাংলার পাঁকে পদ্ম খুব সামান্য ফুটলেও, হিন্দুত্বের চোরাস্রোত বইতে শুরু করেছে বাংলায়। তাই হিন্দুদের মন জয় করতে এখন অনেক জায়গায় রামনবমী পালন করতে শুরু করেছেন তৃণমূলের নেতা-নেত্রীরাও। ঘাসফুল শিবিরের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, ভগবান রাম সবার, এটা রাজনীতির বিষয় নয়। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের মুখে ছিল রামনবমী। সেই সময় তৃণমূল ছেড়ে অনেক নেতা বিজেপিতে গিয়েছিলেন এবং সেই সময় তাঁরাও ধুমধাম করে পালন করেন রামনবমী।

২০২০ সালের করনা আবহে এই বিশেষ তিথি সেভাবে উদযাপিত না হলেও, এবারের ছবিটা একই। রামনবমী আজ পুরোপুরি বদলে দিয়েছে রাজ্যের রাজনৈতিক অবস্থা। রামের নাম করে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে শুরু করেছে গেরুয়া শিবির। সেই সঙ্গে হিন্দুদের কাছের মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে কিছুটা হলেও ভাঙ্গন ধরেছে তৃণমূলের মুসলিম ভোটে। যার স্পষ্ট নিদর্শন সাগরদিঘি বিধানসভা উপ-নির্বাচনে কংগ্রেসের বাইরন বিশ্বাসের জয়। অনেকে আবার রামনবমী বাংলার সংস্কৃতি নয় বলে দাবি করছেন। বিজেপির পেশীবহুল, সুদর্শন রাম 'বহিরাগত', বাংলার চিরাচরিত সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য কেন তাঁর উপাসনা করতে হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।

কিন্তু বাল্মীকির রাম আর হিন্দি বলয়ের রাম কি একই? এর উত্তর হল, কখনই নয়। রামানন্দ সাগরের 'রামায়ণ' ধারাবাহিক এবং ভারতীয় জনতা পার্টির হাত ধরে সৃষ্টি হয়েছে এক অন্য রামের। যে রাম এক বিশেষ গোত্রের রাজনীতির প্রতীক। যে রাম কিছু এজেন্ডা মেনে ময়দানে নামেন। এই রামের জয়গান পরিণত হয়েছে রণ হুংকারে। ভোটের প্রচার থেকে শুরু করে গণহত্যা, সব ক্ষেত্রেই ব্যবহার হচ্ছে এই 'জয় শ্রী রাম'। ওয়ার ক্রাই-ই বটে! জেল থেকে ছাড়া পেলেও বিজেপি নেতারা একে অপরকে অভ্যর্থনা জানাতে ব্যবহার করছেন রামের নাম। আদতে বিজেপির আমদানি করা এই কর্তৃত্ব স্থাপনকারী রাম একটু আলাদা। আবার দেখা যায়, যে রাম সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে চলেন, নিষাদরাজ গুহের আতিথেয়তা গ্রহণ করেন, বানরদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলেন; সেই রামই শম্বুক নামের এক শূদ্রকে তপস্যা করার অপরাধে হত্যা করেন। আর আজ রামের নাম নিয়েই বিজেপি অসহায় দলিত, সংখ্যালঘুদের হত্যা করে।

আদপে রাম বিজেপির রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির শুধুমাত্র একটি হাতিয়ার মাত্র। আর এই রামের আবেগ এখন নির্বাচন জেতার চাবিকাঠি। এর বেশি কিছু নয়।

আসলে পশ্চিমবঙ্গে পায়ের তলার জমি শক্ত করতে গিয়ে বিজেপির কিছু ইস্যু দরকার ছিল। নানা বিষয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতা করে শাসকদলকে সরানো কার্যত অসম্ভব। শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে জালিয়াতির সিন্দুক খুলে সবসময় সুবিধা করা যায় না। তাই ভোট বাড়ানোর জন্য তাদের এর বাইরেও একটা ইস্যু দরকার ছিল। সেরকমই একটা ইস্যু হচ্ছে রাম। সেখানে জুড়ে যাচ্ছে ধর্ম। কোনও এক সময় রাম হয়তো ছিলেন শুধুমাত্র একটি মহাকাব্যিক চরিত্র। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই রাম জ্বলজ্যান্ত হয়ে উঠছেন ভারতীয় রাজনীতিতে। এই রাম স্নেহের নয়, প্রাণের মানুষ নয়, এই রামকে ভয় পেতে হয়। আতঙ্কিত থাকতে হয়। পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক বছর ধরে যে আকারে রামনবমীর মিছিল হচ্ছে, তাতে বিজেপি যে নিজের লক্ষ্যে সফল, তা বলাই যায়।

সব মিলিয়ে ছোট করে হওয়া পুজো থেকে রামনবমী এখন হয়ে গিয়েছে বাংলার বড় রাজনৈতিক হাতিয়ার। তৃণমূল থেকে বিজেপি, কে কত বড় রামের ভক্ত তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে চারিদিকে। রামের নাম নিয়ে বিজেপি ভোটের ফায়দা তুললেও, পিছিয়ে নেই তৃণমূলও। তাদের নেতৃত্বেও শুরু হয়েছে রামনবমীর মিছিল। তাই, বাংলার রাজনীতিতেও যে এখন রাম বেশ সক্রিয় চরিত্র, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই রামের প্রভাবে হয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে বাঙালির অতি প্রাচীন কৃত্তিবাসী রামের ঐতিহ্যও। সেটাই কি অন্যতম উদ্দেশ্য? এখন প্রশ্ন একটাই, বাঙালিও কি হিন্দি বলয়ের মতো রামের রাজনীতিতে গা ভাসাবে? নাকি ধর্মের রাজনীতিকে সরিয়ে রেখে ফিরবেন নিজেদের পুরনো আশ্রয়স্থলে? যেখানে কুটিরের ছাওয়ায় আশ্রয় নেন রাম-সীতা-লক্ষ্মণ। আর সুন্দর রোদের পরশ মেখে সমস্ত মানুষ একসঙ্গে বসে থাকেন। যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের কোনও ভেদাভেদ নেই। নেই হিংস্র উল্লাস।

More Articles