কলকাতার পেটের ভিতর ইহুদি কলকাতা, হেঁটে দেখা হলো না যে পথ

Jewish Of Kolkata: আসলে স্বাধীন ইজরায়েল প্রতিষ্ঠা, দাউদ পাশার অত্যাচার থেকে চিরমুক্তির স্বপ্ন এই শহরের বাসিন্দা ইহুদিদের ঘরমুখো করে।

হেঁটে দেখতে শিখুন, কবির অমোঘ শব্দচয়নে গা করেনি কলকাতা। যে হাঁটে সে দেখে না, যে দেখে সে হয়তো তেমন হাঁটে না। অন্যমনস্ক চলাচলের মাঝে নিঃশব্দ গ্রামপতনের খবর কে আর রাখে। কল্লোলিনী কলকাতা, যে শহর সকলকে আপন করে নেয়, তাকে ছেড়ে নিরুচ্চারে দূরে পাড়ি দেন কত মানুষ, রেখে যান বেদনাবিধুর স্মৃতির স্যাক্সোফোন সুর, তার খোঁজ, খবরের কাগজের হরেকরকম হিজিবিজবিজ খবরের ভিতরেই হারিয়ে যায়। যে ভাবে হারিয়ে গিয়েছে কলকাতায় বসবাসকারী ইহুদিরা, এই শহরের পেটের ভিতরেই এক কালে তাদের আস্ত একটা শহর ছিল। কবে কোথা থেকে এলেন ওঁরা, কী ভাবে আস্তে আস্তে এই শহরের দুর্নিবার টান ছাড়িয়ে তাঁরা চলে যেতে শুরু করলেন। হেঁটে ঘুরে সেই গল্পটা বললেই বোধহয় ভালো হত, কিন্তু তাতেও বাধ সাধবে এই অসুখী সময়, অতঃপর এই মৌতাতটুকু রইল।

ভারতবর্ষে বিভিন্ন সময় এসে বসতি গড়ে তোলে বিভিন্ন ইহুদি গোষ্ঠী। এদের মধ্যে সবার আগে বলতে হয় কোচিন জিউদের কথা। ৫২৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ভারতে এসে পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করেন তাঁরা। ঠিক একই ভাবে স্প্যানিশ ও পোর্তুগিজ জিউসরাও বেছে নিয়েছিলেন গোয়াকে। এর অনেক পরে ১৭৩০ সাল নাগাদ জোসেফ সেমাহ সুরাটে এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে আরম্ভ করলেন। সুরাট সিনেগগ তাঁরই তৈরি। সুরাটেরই অলঙ্কার ব্যবসায়ী সালোম বি ওবাদিয়া হা কোহেন এর নেতৃত্বে ১৭৯৮ সাল নাগাদ একদল ভাগ্যান্বেষী বাগদাদি ইহুদি কলকাতা এসে পৌঁছান। শহরটা তাদের ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছিল। তাঁরাও শহরটাকে দিয়েছিলেন দুহাত ভরে। সেই ইতিহাস আজ আমরা ভুলেই গিয়েছি, কেউ বাংলা ভাষায় লিখে রাখার প্রয়োজনও বোধ করেননি। নিজেদের মতো একটা শহর গড়তে যে কোনও ছোট গোষ্ঠীই ধাপে ধাপে গড়ে তোলে শিক্ষাস্থল, প্রার্থনাস্থল, ব্যবসা বাণিজ্য কেন্দ্র এবং খাবারদাবারের একটা নিজস্ব ঠেক। ইহুদিরা কিন্তু তেমনটাই করেছিল।

জোসেফ এজরা, রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায় নেমে প্রচুর অর্থ উপার্জন শুরু করলেন। কলকাতার মানচিত্রে এজরা এম্পেয়ার ঢুকল। একটি গোষ্ঠীর রুচি ও প্রবণতাকে খুব ভালো করে পড়া যায় সেই গোষ্ঠীর মহিলাদের অবস্থানের মধ্য দিয়েই। এই শহরে ১৮৮১ সালে তৈরি হয় জিউস গার্লস স্কুল। স্কুলটি তৈরি করেন ডেভিড এজরার পুত্র। ১৮৮২ সালে তৈরি হয় জিউস বয়েজ স্কুল। ভাবতে অবাক লাগে ডেভিড এজরার নামে একটা বেনেপাড়া (এজরা স্ট্রিট) তৈরি হলেও ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেথুন বা উইলিয়াম ডাফের কৌলিন্য এজরা পরিবারের।

আরও পড়ুন- হিন্দির বিরুদ্ধে, বাংলার পক্ষে রক্তঝরা আন্দোলন! যেভাবে জন্মেছিল পুরুলিয়া জেলা

পাকা জহুরির মন নিয়ে কলকাতা ঘুরে দেখতে হলে দেখতে হবে ইহুদিদের সিনেগগগুলি। ১৮৫৬ নাগাদ কলকাতায় পা রাখেন জেরুজালেমের ইহুদি ধর্মযাজক রুবেন ডেভিড ব্রুক।ধর্মস্থাপনের নিরলস চেষ্টার সেই শুরু। নেভে সালোম সিনেগগটি ছিল আগে থেকেই (১৮২৫) । ব্রুকের তত্ত্বাবধানে ডেভিড এজরা সাহেবই ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে তৈরি করেন বেথ এল সিনেগাও(১৮৫৬)। আর নেভে সালোমের গায়েই ডেভিড এজরা তৈরি করলেন ম্যাগান ডেভিড সিনেগগটি (১৮৮৪)। পরবর্তীকালে টেরিটি বাজারে এবং সদর স্ট্রিটে তৈরি হয় ম্যাগান এবথ ও সারে রাসো সিনেগগটি।

ম্যাগান ডেভিড সিনেগগের চূড়া প্রায় ১৪০ ফুট উঁচু। চারদিকে আকাশচুম্বী বহুতল তবু এক কিলোমিটার দূর থেকে সেই চূড়া দেখতে পাওয়া যায় আজও। ভিতরের কারুকার্য দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। হলফ করে বলা যায় ব্রিটিশ স্থাপত্যকে হেসে হেসে দশ গোল দেবে ইতালীয় ধাঁচে তৈরি ম্যাগান ডেভিড উপাসনাগৃহ। বলাই বাহুল্য এশিয়া’র সর্ববৃহৎ সিনেগগ এটি। উপাসনাস্থলের শেষ মাথায় স্টার অফ ডেভিডের চিহ্ন স্বর্গের সংকেত বহন করে। দরজা থেকে একটানা লম্বা পথ, দুধারে সারি সারি চেয়ারে এসে পড়েছে ওপরের চারপাশের জানলার সাতরঙা বেলজিয়াম কাঁচ থেকে উপচে পড়া মায়ারোদ। ম্যাগন ডেভিড সিনেগগটি তিন তলা বিশিষ্ট। প্রতিটি ফ্লোরেই প্রায় এক হাজার লোক বসে প্রার্থনা সারতে পারবে এমন ব্যবস্থাপনা আছে। এই তো মাত্র কয়েক দশক আগেই তিনটি তলাই ভরে থাকতো শুক্রবার প্রার্থনা করতে আসা ইহুদিদের ভিড়ে। লম্বা লম্বা থামগুলোতে এখন শুধু জড়িয়ে আছে মন কেমন আর দীর্ঘশ্বাস।

কলকাতার পেটের ভিতর ইহুদি কলকাতা, হেঁটে দেখা হলো না যে পথ

বেথ এল চার্চ | ছবি সৌজন্যে: লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ

'বেথ এল'- কথাটির আক্ষরিক অর্থ ঈশ্বরের গৃহ। বেথ এল উপাসনাগারের বাইরেটা হলুদাভ আর ভেতরের প্রধান আকর্ষণ জানলার কাঁচের শার্সিগুলো। লক্ষ্যণীয় ভাবে মহিলাদের জন্য প্রার্থনার আসন সংরক্ষিত। মোগলাই খানার দোকান, সস্তার কাঁচের বাসন, সেলুন ঘিরে রেখেছে এখন সিনেগগটিকে। মনে মনে রোজ রোজ ক্ষয়ে যাওয়া ব্যস্ত শহরবাসীর চোখে যে ধরা পড়েনা এই অদ্ভুত শিল্পকর্ম,তার প্রমাণ মিলবে ভিজিটর’স্ বুকে। স্পেন, নেদারল্যান্ড, ইরান এর পর্যটকরা এসে দেখে যান এই সিনেগগগুলো। এমনকী রোববারও দেখা মেলে না একজন বাঙালির।

এ শহরেই থাকতে হবে কয়েক পুরুষ, এমনটা ধরেই নিয়েছিল ইহুদিরা। অতএব জন্ম, মৃত্যু এই দুই অনিবার্য ঘটনা প্রবাহে যাতে কোনও বিঘ্ন না ঘটে তার জন্য চাই পাকা বন্দোবস্ত। মৃতকে দাফন করার এক স্থায়ী ব্যবস্থা খুঁজতে শুরু করেন সালোম কোহেন। নারকেলডাঙায় এক বাঙালি বন্ধুর থেকে একটি সোনার আংটির বিনিময়ে কিনে নেন একটা আস্ত ধানমাঠ। তৈরি হয় ইহুদিদের একমাত্র কবরখানা। এই সিমেট্রিতে একটি গেনিজাও আছে। গেনিজা হল পবিত্র ধর্মীয় পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের জন্য তৈরি ঘর।

আরও পড়ুন- অনেক সয়েছি আর না! কেন রাষ্ট্রনেতা বলসোনারোকে ছুড়ে ফেলে দিল ব্রাজিলের জনতা

ভারতে আগত ইহুদিদের মধ্যে অতি জনপ্রিয় নাহুম ইজরায়েল মারদোকাই ১৯০২ সালে কলকাতায় কনফেকশনারির ব্যবসা শুরু করেন। বাড়ি বাড়ি অর্ডার অনুযায়ী কেক পৌঁছে দিতেন প্রথম প্রথম। পায়ের তলার জমি শক্ত হলে হগমার্কেট এর কিংবদন্তি দোকানটি তৈরি হয় ১৯১৬ সালে। শহরের খোলনলচে বদলেছে। মাথাচাড়া দিয়ে আকাশ ছুঁয়েছে কংক্রিটের জঙ্গল। নাহুমসের চেহারা কিন্তু আজও অবিকল। এক অর্থে বাঙালিকে কেক পেস্ট্রির স্বাদ চিনিয়েছে নাহুমস অ্যান্ড সন্স। লেমন টার্ট, আমন্ডরিং, চিজ সামোসা, ওয়ালনাট ব্রাউনি ইত্যাদি নাহুম ব্র্যান্ডের সিগনেচার খাবারগুলোর ফ্যান লিস্ট দীর্ঘ। সুচিত্রা সেন, মান্না দে, অঞ্জন দত্ত, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়! কে নেই তাতে। কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ডের ভিড়ে নিজের সাবেক স্টাইল আঁকড়ে ধরে রাখার সিদ্ধান্তে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অনড় ছিলেন ডেভিড এলিয়াস নাহুম। নাহুম মারদোকাইয়ের নাতি, কলকাতার ইহুদিদের মধ্যে সবচেয়ে লোকপ্রিয় সদা হাস্যময় মানুষ।

লা মার্টিনিয়ারয়ের ছাত্র ডেভিডের কিন্তু পারিবারিক ব্যবসায় মন টেকেনি প্রথম যৌবনে। ফিহপ্তা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বন্ধুদের নিয়ে বেড়িয়ে পড়তেন শিকারে। তবে চুলে পাক ধরলে কত বিবাগীই তো সংসারী হন। বড় দুই ভাই সলোমান এবং নরমানের মৃত্যুর পরে ব্যবসার হাল ধরেন তিনি। কর্মচারীদের সাথে সুমধুর সম্পর্ক তৈরি হয়। বিয়ে থা করেননি। নাহুম অ্যান্ড সন্সের কর্মচারীরাই ছিলেন তাঁর পরিবার। ইহুদি মেয়েদের বিয়ে থেকে শুক্রবারের প্রার্থনা সবই হত তাঁর তত্ত্বাবধানে। ২০১৩ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। কলকাতার হাতেগোনা ইহুদিরা সর্বার্থেই পিতৃহারা হন। নাহুম অ্যান্ড সন্স-এর দায়িত্ব নেন ৭৬ বছর বয়সি ইসাক নাহুম। নাহুমদের চার ভাইয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ তিনি। এখনও দোকানে ঢুঁ মারলে তাঁর দেখা মিলতে পারে কখনও সখনও। কিন্তু প্রতিবার ফেরার সময় মন কেমন করবেই। আর যদি দেখা না হয়!

আসলে স্বাধীন ইজরায়েল প্রতিষ্ঠা, দাউদ পাশার অত্যাচার থেকে চিরমুক্তির স্বপ্ন এই শহরের বাসিন্দা ইহুদিদের ঘরমুখো করে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে পরেই হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা,পাকিস্তানে ইহুদি নিপীড়ন ভয় ঢুকিয়ে দেয় ইহুদিদের মজ্জায়। শহর ছাড়তে শুরু করে ইহুদিরা। কলকাতায় ইহুদিদের সংখ্যা আজ কমতে কমতে কমবেশি ১৫-এ এসে ঠেকেছে। ইহুদি স্কুলে আজ একটিও ইহুদি ছেলে মেয়ে নেই। শুক্রবার বেলা পড়ে এলে সব প্রার্থনাস্থলগুলোয় একবার করে যান কলকাতার ইহুদিদের একমাত্র মুখপাত্র মিসেস কোহেন। সমবেত প্রার্থনার জন্য কমপক্ষে দশজন দরকার হয়। সেই দশজনও জোগাড় হয়না কোনও কোনও দিন। চোখ ধাঁধানো প্রার্থনাস্থল গুলোতে একাই নতজানু বসে থাকেন তিনি।

১৯৯৮ সাল থেকে ম্যাগান ডেভিড চার্চের দেখাশোনা করেন আনোয়ার খান। অভিমান ভরা গলায় বললেন “কিছুই তো নেই আর। এটুকু তো থাক।” আসলে অনেক কমা, কোলন, সেমিকোলন পেরিয়ে একটা স্বতন্ত্র সংস্কৃতি অবশেষে এক ট্র্যাজিক পূর্ণচ্ছেদের দিকে পা বাড়িয়ে। 'এটুকু তো থাক'।

More Articles