পাতলা সুতির শাড়ি বিক্রি করে ৫০ কোটির ব্যবসা! দুই বাঙালি বোনের হাতে গড়া 'সুতা বোম্বে' তাক লাগাবে

Suta Bombay Brand: ২০১৬ সালে নিজেদের জমানো পুঁজি থেকে তিন লক্ষ করে দিয়ে শুরু হয় শাড়ির ব্যবসা। সুজাতার ‘সু’ এবং তানিয়া নামের ‘তা’ মিলে ব্র্যান্ডের নাম রাখলেন তাঁরা ‘সুতা’।

দুর্গাপুজোয় অষ্টমীর অঞ্জলি বা সরস্বতী পুজো, শাড়ি বেশিরভাগ বাঙালি কন্যারই পছন্দের তালিকায় শীর্ষে। ছোটখাটো অনুষ্ঠান থেকে বিয়ে বাড়ি, আধুনিক হাজার একটা পোশাক পরার সুযোগ থাকলেও ভারতের মহিলাদের কাছে শাড়ির কদর কখনই কমেনি। আর এই শাড়িকেই স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে মহিলাদের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ করে তুলতে মাঠে নামেন দুই বাঙালি মেয়ে সুজাতা ও তানিয়া। তিল তিল করে গড়ে তোলেন ৫০ কোটির ব্যবসা। দুই বোনের স্বপ্নের উড়ান হাজার হাজার মেয়ের পথচলার পথে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। অভাবের তাড়নায় বা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্যে বাড়ি বাড়ি কিংবা অনলাইনে শাড়ি বিক্রি করতে আসা মহিলাদের যাঁরা নেক নজরে দেখেন না তাঁদের কাছে উদাহণস্বরূপ সুজাতা ও তানিয়া। বঙ্গতনয়াদের হাতে তৈরি ‘সুতা বোম্বে’-র শাড়ি আজ দেশের মহিলাদের অন্যতম পছন্দের পোশাক।

কীভাবে শুরু হয়েছিল সুতা বোম্বের যাত্রা?

সুজাতা এবং তানিয়ার বাবা ভারতীয় রেলে কর্মরত ছিলেন। ফলে তাঁদের পরিবার খুব বেশিদিন কোনও জায়গাতেই থিতু হতে পারেনি। বাবার সঙ্গেই নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে বড় হয়ে ওঠে দুই বোন। সুজাতা ও তানিয়ার মামাবাড়ি বাংলাতেই। তাই ছোট বেলায় মা, দিদাকে আর পাঁচটা বাঙালি মহিলাদের মতোই শাড়ি পরতে দেখতেন।

ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পর এমবি-র পড়াশোনা শেষ করে সুজাতা স্টিল কোম্পানিতে চাকরি জীবন শুরু করেন। এই সময় ই কমার্স ব্যবসা নিয়ে পিএইচডি করার জন্য আইআইটি বম্বেতে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেন সুজাতা। অন্যদিকে তানিয়া ২০১৩ সালে আইআইএম লখনউ থেকে এমবি পাশ করে আইবিএম কোম্পানিতে কনসালট্যান্ট হিসেবে চাকরি করতেন। দু’জনেই মোটা অঙ্কের অর্থ উপার্জন করতেন চাকরি থেকে। কিন্তু নিজের হাতে কিছু গড়ে তোলার লক্ষ্যে দুই বোন চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরুর কথা ভাবেন। যে শাড়ি আজ মহিলারা কোনও অনুষ্ঠান ছাড়া পরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না তাকে ভারতীয় মহিলাদের প্রতিদিনের পোশাক করে তোলার জন্য শাড়ির ব্যবসা করবেন বলেই ঠিক করেন দুই বোন। সুজাতার কথায়, “আমাদের মধ্যে একটা ধারণা রয়েছে যে, কোনও অনুষ্ঠান ছাড়া শাড়ি পরা যায় না। একইসঙ্গে শাড়ি এমন একটি পোশাক যা শরীরের আকার, ওজনের ওপর নির্ভর করে না। সেকারণেই শাড়িকে বেছে নেওয়া।” ২০১৬ সালে নিজেদের জমানো পুঁজি থেকে তিন লক্ষ করে দিয়ে শুরু হয় শাড়ির ব্যবসা। সুজাতার ‘সু’ এবং তানিয়া নামের ‘তা’ মিলে ব্র্যান্ডের নাম রাখলেন তাঁরা ‘সুতা’।

আরও পড়ুন- কেন ইনকিলাব ধ্বনি দিচ্ছেন ইরানের মেয়েরা! কীভাবে পাড়ি দিল ভগতের স্লোগান

সুতার পথচলা

তানিয়ার কথায়, “২০১৪ সালে যখন প্রথম তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলি তখন বুঝতে পারি তাঁদের মধ্যে কাজ এবং পারিশ্রমিক নিয়ে কতখানি অনিশ্চয়তা রয়েছে। আর তাঁদের উঁচু দরের হাতের কাজই আমরা গোটা দুনিয়াকে দেখাতে চেয়েছিলাম।” এরপরের দু’বছর সময় লেগেছিল সুতাকে বাস্তব রূপ দিতে। একবারে ভিন্ন জগত থেকে আসা সুজাতা ও তানিয়া এই সময় ব্যবসার স্বার্থে নতুন নতুন জিনিস শিখতে শুরু করেন, ভালো কাপড় যাচাই করার কায়দা বুঝে নিতে থাকেন। হাতে কলমে শিক্ষা নিতে নদিয়ার শান্তিপুর, ধনেখালি, মধ্যপ্রদেশ, মেঘালয়, ওড়িশা, গুজরাতের কচ্ছ এলাকায় ঘুরে বেরিয়েছে সুজাতা-তানিয়া। শিক্ষানবিশ হিসেবে প্রতারণারও মুখোমুখি হন দু’জনেই কিন্তু হাল ছাড়েনি তাঁরা। অবশেষে ২০১৬ সালে শাড়ির ব্যবসা শুরু করেন দুই বোন। শুরুর সময় মাত্র দু’জন তাঁতির সঙ্গে কাজ করতেন তাঁরা। সম্পূর্ণ ব্যবসাই চলত অনলাইনে। ফাইন মলমলের কাপড় দিয়ে শুরু হয় সুতার পথচলা। কিন্তু প্রথমদিকে তাঁতিরা স্টার্চ ছাড়া প্লেন মলমলের কাপড় তৈরি করতে রাজি হননি। তাঁতিরা সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, বাজারে এই ধরনের পাতলা এক রঙের মলমলের শাড়ি শুধুমাত্র বিধবারাই পরেন। খুব সামান্য সংখ্যক তাঁতিই স্টার্চ ছাড়া কাপড় বুনতেন। দুই বোন মিলে তাঁদের খুঁজে বের করে কাপড় তৈরি করতে শুরু করেন।

সুজাতার কথায়, “প্রথমদিকে এক রঙের কোনও ডিজাইন ছাড়াই শাড়ি তৈরি করাই। আমরা চেয়েছিলাম অল্পবয়সী মেয়েদের মধ্যে এই শাড়ি পরার চলটা ফিরিয়ে আনতে।” ১২৫০ টাকা দামে এমনই শাড়ি বাজারে বেচতে শুরু করেন তাঁরা। প্যাকেজিং, পার্সেল শিপিং সমস্ত কাজই নিজে হাতে সামলাতেন দুই বোন। সারা সপ্তাহ কাজের শেষে ছুটির দিনগুলিতে ব্যবসার কাজ করতেন তাঁরা। তবে ২০১৬ সালে পুরো দমে ব্যবসা শুরু করলে দু’জনেই চাকরি ছেড়ে দেন। প্রচুর এগজিবিশন, মার্কেট রিসার্চ করে প্রথম দু’বছর বোঝার চেষ্টা করেন কাস্টমারদের। ক্রমশ মানুষের মন জিতে নিতে থাকে ‘সুতা’। আজ দেশের ৮ টি রাজ্যে ১৫০০-এর বেশি তাঁতির সঙ্গে কাজ করছে তাঁদের ব্র্যান্ড। ছ’বছরে কোম্পানির লাভের অঙ্ক গিয়ে ঠেকেছে ৫০ কোটিতে, সঙ্গে ১৫০ জনের একটি টিম তৈরি হয়েছে সুতার হাত ধরে।

ব্র্যান্ডের মডেল হিসেবে বাইরের কোনও তারকা নয় সুজাতাই হয়ে ওঠে সুতার মুখ। তানিয়ার কলেজ জীবনে উপহার হিসেবে পাওয়া ক্যামেরাতেই এই ফটোশ্যুট চলত। তানিয়া নিজেই ছিল ফটোগ্রাফার। একবারে নিজে হাতে তৈরি সুতা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ভারতের সবার কাছেই।

আরও পড়ুন- সনিয়ার কন্যাদান করেন হরিবংশ রাই বচ্চন! কীভাবে নষ্ট হল অমিতাভ-রাজীব গান্ধীর বন্ধুত্ব?

সুতার সাফল্য রহস্য

যেখানে বাজারের বেশিরভাগ ব্র্যান্ড প্রথমে দোকানের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করে সেখানে সুতা প্রথম থেকেই অনলাইন ব্যবসার পথে হেঁটেছে। পাশাপাশি শাড়ি তৈরির পিছনের গল্পগুলিও তাঁরা সুন্দরভাবে তুলে ধরেন সামাজিক মাধ্যমে। সুজাতার কথায়, “করানোর সময় যখন আমাদের চারিদিকের বাজার বন্ধ তখনও মানুষ সুতার থেকে শাড়ি অর্ডার করেছেন।” কাস্টমার ধরতে সুতার ক্রেতাদের তাঁরা ‘সুতা কুইন’ নামে পরিচয় দেন এবং স্টোরির মাধ্যমে সামাজিক মাধ্যমে তাঁদের ছবিও ভাগ করে নেন।

পাশাপাশি তাঁতিদের হাতে সঠিক সময়ে অর্থ পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে নজর রাখা হয়। এমনকী শুরুর সময় তাঁতির স্ত্রীরা যে শাড়ি বুনতে সাহায্য করেছেন তাঁদের জন্য ব্যাংক মারফত টাকা পাঠানো হত। আজও সেইভাবেই কাজ করা হয় তাঁদের সঙ্গে। কাপড় তৈরি এবং গুণমান বিচারের সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে যায় তাঁতিদের প্রাপ্য সম্মান। কখনও কোনও শাড়িতে ত্রুটি দেখা গেলে তার জন্যও রয়েছে আলাদা রকমের ব্যবস্থা। একবারে আলাদা একটি বিভাগ রয়েছে সুতার যাঁরা ত্রুটিযুক্ত শাড়িগুলি ঠিক করে নতুনভাবে বাজারে বেচার যোগ্য করে তোলে। করোনা অতিমারির পর যখন বড় বড় কোম্পানি ক্ষতির মুখে পড়েছে তখন নতুন স্টোর খোলার কথা ভাবছেন সুজাতা-তানিয়া। আজ নানা ই কমার্স প্ল্যাটফর্মেও অনায়াসে পাওয়া যায় সুতার শাড়ি। বাঙালি দুই বোনের শাড়ির ব্র্যান্ড 'সুতা' আজ সাফল্যের শীর্ষে শুধু নয়, মানুষের মনের কাছেরও বটে।

More Articles