কালনার লালজি মন্দিরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে এক বৈষ্ণব সাধুর মাহাত্ম্য!

বনেদিয়ানা ও ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত অম্বিকা কালনার লালজি মন্দির। কালনাকে মন্দির শহর বললেও অত্যুক্তি হয় না।লালজি মন্দিরের ইতিহাসের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে বর্ধমানের স্পন্দন। সেই আখ্যান পাঠকের সামনে তুলে ধরতেই এই লেখার অবতারণা।

বর্ধমানের মহারাজারা জাতিতে ছিলেন হিন্দু-পাঞ্জাবি। এঁদের পূর্বপুরুষ ছিলেন আবু রায় ও বাবু রায়। সুদূর পাঞ্জাব থেকে এই কীর্তিমান ভাতৃদ্বয় বাংলায় আসেন ভাগ্য অনুসন্ধানে, আনুমানিক ১৬৫৭শকাব্দের অনেক আগে। তখন বাংলায় সবেমাত্র ডাকবিলি ব্যবস্থা শুরু হয়েছে ঘোড়ার সাহায্যে।আর ঠিক তখনই আবু রায় ও বাবু রায় বাংলায় এলেন ঘোড়া ও কম্বলের ব্যবসা করতে। তাঁরা প্রথম ব্যবসা শুরু করলেন বর্ধমানের কাছে বৈকুণ্ঠপুর গ্রাম থেকে। তদানীন্তন বৃটিশ সরকারকে ঘোড়া বিক্রি করে ব্যবসায় প্রভূত উন্নতি হলো। প্রচুর অর্থ আসার ফলে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়তে লাগল।পরে তারা কিছু জমিদারি সরকারের কাছ থেকে খাজনা দিয়ে ইজারা নিলেন। ক্রমে জমিদারি লাভ হলো এবং তাঁরা রাজচিহ্ন বা 'টোটেম' হিসেবে কেশরযুক্ত ঘোড়ার মুখ ব্যবহার করতে লাগলেন।

আজও বর্ধমানের যে সব সম্পত্তি ও মন্দির আছে সর্বত্র এই ঘোড়ার মুখের ব্যবহার দেখা যায়। এটি ছিল পরবর্তীকালে বর্ধমানের মহারাজাদের শিলমোহর।

বর্ধমানের মহারাজারা-দের ইতিহাস পরবর্তীতে আলোচনা করা যাবে। এখন ফিরে দেখা যাক লালজি মন্দিরের ইতিহাসের পাতায় কোন ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ও গৌরব লুকিয়ে আছে।

বর্ধমানের রাজা কীর্তিচাঁদ রায়ের মাতা ব্রজসুন্দরীদেবী কালনায় গঙ্গাস্নানে আসতেন। বলা বাহুল্য কালনার উত্তর দিকে ভাগীরথী নদী বয়ে চলছে। একদিন রাজমাতা ব্রজকিশোরীদেবী কালনায় এসেছেন গঙ্গাস্নানে। সময়টা পৌষ মাসের মাঝামাঝি। খুব শীঘ্রই গঙ্গাসাগর মেলা। তখন নদীপথে নৌকাযোগে যাতায়াত হতো।বহুভক্ত ও সাধকরা পশ্চিম থেকে ভাগীরথী দিয়ে নৌকাযোগে গঙ্গাসাগর যেতেন। তখনকার দিনে নদী থেকে সাগর এই জলপথ ছিলো খুবই ভয়ের। মানুষের মনে এই ধারণা ছিলো যে,এই তীর্থে যে যায় সে আর বেঁচে ফেরে না।কালনা একটি কৃষিপ্রধান শহর এবং তীর্থক্ষেত্রও বটে,তাই অনেকেই এখানে যাত্রাবিরতি দিতেন।এমনি এক নাগা সন্ন্যাসীর দল সেবার ছাউনি ফেলেছেন কালনায় গঙ্গাতীরে। নাগা সাধুরা ছাউনির ভিতরে রয়েছেন,তাদের চেলারা ছাউনির বাইরে এদিক ওদিক বিশ্রাম করছেন।

রাজমাতা ব্রজকিশোরীদেবীর পালকি চলেছে সেই ছাউনির পাশ দিয়ে। হঠাৎ রাজমাতা একটি ছাউনির পাশ দিয়ে যাবার সময় শুনতে পেলেন ছাউনির ভিতরে এক সাধুবাবা একটি ছোট্ট ছেলের সঙ্গে গল্প করছে। নানারকম বায়না করছে ছেলেটি,আর ভিতরে যে বয়স্ক সাধু রয়েছেন, তিনি তার বায়না পূরণ করতে ব্যর্থ হয়ে নানা ভাবে তাকে ভোলাবার চেষ্টা করে চলেছেন। তিনি শুনতে পেলেন বালকটি নানাবিধ ভালো ভালো খাদ্য খাবার বায়না করছে,আর সাধুবাবা তাকে বারবার বলছেন, তাঁর কাছে পোড়া রুটি ছাড়া আর কিছুই নেই।

শুনতে শুনতে মহারানি অবাক হলেন,আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন গঙ্গাসাগর অতি দুর্গম পথ, সেখানে বাড়ির মহিলারা পর্যন্ত যাবার সাহস পায়না,সেখানে এঁদের সাথে এই ছোট্ট বালক কেন? এই চিন্তা নিয়েই রাজমাতা স্নান সারলেন;তারপর পায়ে পায়ে এসে সেই ছাউনির সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। দেখলেন ভিতরে একজন সৌম্য দর্শন সাধুবাবা। রাজমাতা তাঁর দর্শনপ্রার্থী হলেন।সঙ্গে সঙ্গেই অনুমতি পাওয়া গেল। রাজমাতা সাধুজিকে প্রনাম করে জিজ্ঞাসা করলেন-"বাবা, গঙ্গাস্নানে যাবার সময় যে বালকটির গলা শুনেছিলাম,সেই বালকটি কোথায়?"

আরও পড়ুন-বঙ্গভঙ্গ বিরোধী কলকাতা সাক্ষী দেশের প্রথম জাতীয় পতাকার

সাধু বললেন তাঁর সঙ্গে কোনো বালক নেই।তিনি তাঁর উপাস্য দেবতা শ্যামচাঁদ(কানাই)-কে নিয়ে সাগরে যাচ্ছেন। রাজমাতার সন্দেহ যায় না,তিনি নিজের কানকে কি করে অবিশ্বাস করবেন? তিনি বারংবার প্রশ্ন করায় সাধুজী বললেন, তাঁর শ্যামচাঁদ (কানাই) তাঁর সাথে কথা বলেন,তিনি বললেন যে ভিক্ষাবৃত্তি করে আনা পোড়া রুটি কানাই রোজ রোজ খেতে চায় না। এদিকে রাজমাতার মনে বাসনা হলো ওই মুর্তি পূজো করার। কিন্তু কিছুতেই তিনি লালাজির (তখনকার দিনে সাধুবাবাদের লালাজি বলা হতো, ভগবান বিষ্ণুকেও লালাজি বলা হয়)-কাছে মুর্তি চেয়ে নিতে পারছেন না; কারণ এত যেমন তেমন মূর্তি নয়, জাগ্রত শ্যামচাঁদ।

রাজমাতা বুদ্ধি বের করলেন, তিনি লালাজির কাছে প্রস্তাব দিলেন যে, তাঁর এক বিবাহযোগ্যা ক্ আছে, সাধুবাবা যদি রাজি থাকেন তাহলে তিনি তাঁর কন্যার সাথে শ্যামচাঁদের বিবাহ দিতে চান এবং প্রতিদিন বাহান্নবার বাহান্নভোগ দিয়ে কানাইয়ের পুজা করতে চান(সেইমতো প্রতিদিন লালজি মহারাজকে বাহান্নবার বাহান্ন ভোগ নিবেদন করা হতো)। সাধুবাবা এককথায় রাজি হয়ে গেলেন।তখন লালাজী(সাধুবাবা) মহারানী-র কাছে মূর্তি রেখে বিবাহের ব্যবস্থা করতে লাগলেন।

এদিকে রাজমাতা ব্রজকিশোরীদেবী মাঈজী-র(মাঝির) বাড়ির থেকে সংগ্রহ করলেন এক রাধারানীর মুর্তি। এই মাঈজী ছিলেন সৎ বংশের এক ভক্তিমতি মহিলা।তিনি অত্যন্ত ভক্তিমতি ছিলেন।নিত্য পুজা করতেন সেই মুর্তির।এই মুর্তির পরিবর্তে তাদের দেওয়া হলো প্রচুর উপঢৌকন ও দেবোত্তর সম্পত্তি এবং মহারানির সঙ্গে পাতানো হলো নতুন সম্বন্ধ। এই মাঝির বাড়িও কালনার এক ঐতিহ্যশালী পরিবার বলে খ্যাত।

এরপর রাজমাতা মহারানী ব্রজকিশোরীদেবী যুগল মূর্তিকে প্রতিষ্ঠা করলেন দেবালয়ে। লালাজিও তীর্থে চলে গেলেন। রাজমাতা ব্রজকিশোরীদেবী দেবালয়টি অত্যন্ত সুন্দর ও সুচারুভাবে তৈরি করালেন। তাঁর প্রত্যক্ষ ইচ্ছেয় তৈরি হলো এই দেবালয়।

আনুমানিক১৬৬১শকাব্দে (১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দ) এই মন্দির স্থাপিত হয়। পঁচিশরত্ন মন্দির আয়তন, একে পঁচিশচূড়া মন্দিরও বলা হয়। ১২+৮+৪+১ --এই ভাবে চূড়াগুলি তৈরি। দীনবন্ধু মিত্রের লেখা সুরধনী-তে এই মন্দিরের কথা লিপিবদ্ধ আছে। এই শৈলীর মন্দির পশ্চিমবঙ্গে মাত্র পাঁচটি আছে। এর মধ্যে তিনটিই আছে কালনায়।একটি লালজি মন্দির,একটি কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির আর একটি গোপালজীর মন্দির।

এরপরের ইতিহাস আরো মুগ্ধকর, সাধুবাবা তীর্থ সেরে এসে রাজমাতার কাছে কন্যা-সহ কানাইকে চাইলেন, কিন্তু রানিমা জানালেন,এই বংশের রীতি অনুসারে কন্যা-সহ জামাতা শ্বশুরালয়েই থাকবে। এদিকে লালাজি নাছোড়বান্দা। তিনি বারংবার রাজমাতাকে অনুরোধ করলেন,তখন কোনো ফল হলোনা,তখন তিনি মন্দিরে ঢুকে কানাই-কে ওঠাতে গেলেন।কিন্তু কি আশ্চর্য,কিছুতেই ওঠাতে পারলেন না। তখন তিনি কানাইকে অভিশাপ দিয়ে বললেন, ৫২-বার ৫২ ভোগ খেয়ে পোড়া রুটি খেতে আমার সঙ্গে আর যেতে ইচ্ছে করছে না? অভিশাপ দিচ্ছি সারাজীবন তোমায় পোড়া রুটি খেতেই হবে।

লালাজি কিন্তু কানাইকে ছেড়ে যেতে পারেননি, কারণ এরপর থেকে যতবারই ভোগ দেওয়া হয়েছে ততবারই কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কানাই অভুক্ত থেকেছেন, শেষে লালাজী প্রতিদিন রুটি বানিয়ে কানাইকে ভোগ দিতেন বাহান্ন ব্যঞ্জনের সঙ্গে।

সেই প্রথা এখনো চলে আসছে।এখন আর আগের মতো বাহান্নভোগ দেওয়া সম্ভব হয়না, কিন্তু প্রতিদিন ভোগের সঙ্গে পোড়ারুটি দেওয়া হয়।

লালাজির নাম অনুসারে মন্দিরের নামকরন হয় "লালজী মন্দির"আর কানাই-এর নাম হয় "লালজি মহারাজ জিউ"।এখনো রাস উৎসবে এবং ঝুলনের দিন রঙিন পঞ্চগুড়ি দিয়ে কৃষ্ণের লীলাকাহিনি বর্নিত হয় মন্দিরে, একে বলা হয় সাঁজি (সাঁঝের কাজ)। অতি সুন্দর,অতিমনোরম সেই কাজ। দোলযাত্রায় লালজী মহারাজ-কে পালকিতে করে মশালের আলোয় পথ দেখিয়ে নিয়ে আসা হতো নাটমঞ্চে। কালের স্রোতে সেইসব দিন বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু লালজি মহারাজ কালনাবাসীর অন্তরে আদরের জামাই হয়ে রয়ে গিয়েছেন।


[কালনার জনশ্রুতি ও হিমাংশু দত্ত কতৃক বর্নিত]

More Articles