খালি পায়েই ‘পদ্মশ্রী’ গ্ৰহণ

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া পদ্মশ্রীর অনুষ্ঠানে যে মানুষটি এক অসাধারণ সারল‍্যের মাধ‍্যমে সবার মন কেড়েছেন, তিনি তুলসী গৌড়া। সেদিনে তাঁর খালি পায়ে, অতি সাধারণ পোশাকে  ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কার গ্ৰহণের ভিডিও বিপুলভাবে  ছড়িয়ে পরেছিল নেট দুনিয়ায় । আজকের উন্নয়নমুখী দুনিয়ায় তুলসী গৌড়া এক বিকল্প চরিত্র। পরিবেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অত‍্যন্ত নিবিড়। গাছপালা সম্পর্কে তিনি কোন প্রাতিস্থানিক সংস্পর্শে না এসে থাকলেও উদ্ভিদ সম্মন্ধে তাঁর অপরিসীম জ্ঞান তাঁকে এনে দিয়েছে ‘অরণ‍্যের বিশ্বকোষ’ বা ‘Encyclopedia Of Forest’ আখ‍্যাটি। মাত্র ১২ বছর থেকে তিনি দীর্ঘ তিরিশ বছর নিরলসভাবে বৃক্ষরোপণের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।    

 তুলসী গৌড়া কর্ণাটক রাজ‍্যের উত্তর কান্নাড় জেলার আঙ্কোলা তালুকের অন্তর্গত হোন্নালি গ্ৰামের হালাক্কি সম্প্রদায়ভুক্ত আদিবাসী। তাঁর নিজের নামের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে একটি ঔষধী গাছের নাম। তুলসীর যখন দুই বছর বয়স, তখন তাঁর বাবার মৃত‍্যু ঘটে। তারপরেই তিনি মা এবং বোনের সঙ্গে স্থানীয় নার্সারিতে শ্রমিকের কাজ শুরু করেন। বোঝাই যায়, গাছের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে একেবারে ছেলেবেলা থেকেই। অভাবের সংসারে লেখাপড়া বরাবর‌ই বিলাসিতা তাই তাঁকে সারাজীবন ধরে বয়ে নিয়ে চলতে হয়েছে নিরক্ষরতার দায়ভার। একেবারে কৈশোরকালেই তুলসীর বিয়ে হয় গোবিন্দে গৌড়া নামক এক অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ব‍্যক্তির। কিন্তু সাংসারিক জীবনের ছন্দোপতন ঘটে কিছুদিনের মধ‍্যেই। গোবিন্দে গৌড়া বিবাহের অল্পকিছুদিনের মধ‍্যেই পরলোক গমন করে, তুলসীর বয়স তখন মোটে সাতেরো। স্বামী হারানোর পরে যে নিঃসঙ্গতা তাঁর জীবনে নেমে এসেছিল, গাছ‌ই সেই নিঃসঙ্গতাকে কাটিয়ে উঠতে সাহায‍্য করেছিল।

 বাবার মৃত‍্যুর পর মায়ের সঙ্গে নার্সারিতে কাজ করার সূত্রেই উদ্ভিদের প্রতি এক গভীর টান সৃষ্টি হয়েছিল তুলসীর। কর্ণাটকের বনদপ্তরের অধীনে উত্তর কন্নড় জেলার হোন্নালি গ্ৰামের মাস্তিকাট্টি রেঞ্জে ক্রমাগত বনসৃজনের যে প্রচেষ্টা করা হয়েছিল, তার‌ই অংশ হিসাবে বনবিভাগের আগাসুর নার্সারিতে তুলসী গৌড়া কাজ শুরু করেছিলেন মায়ের হাত ধরে। তুলসী তাঁর মায়ের সঙ্গে দীর্ঘ ৩৫বছর কাজ করেছেন বনবিভাগের নার্সারিতে। কাজের প্রতি একাগ্ৰতা এবং গাছের প্রতিপালনে তাঁর দক্ষতার দিকটি দেখে তুলসীকে বনবিভাগের একজন স্থায়ী কর্মচারী হিসাবে নিযুক্ত করা হয় । এরপরে তিনি দীর্ঘ ১৫বছর নার্সারিতে কাজ করেছেন স্থায়ী কর্মচারী হিসাবে। স্থায়ী এবং অস্থায়ী কর্মচারী হিসাবে তিনি জীবনের ৬০ বছর কর্ণাটক বনবিভাগের হয়ে কাজ করেছেন, এই ষাট বছরে তিনি প্রায় তিরিশ হাজার বৃক্ষরোপণ করেছেন। শুধু তাই নয় তাঁর বৃক্ষ সম্মন্ধে অভিজ্ঞতা এতটাই বেশি যে তিনি যে কোন প্রজাতির গাছ দেখে সেই গাছের প্রকৃত তথ‍্য নির্ভুলভাবে বলতে পারেন। এছাড়াও যেকোন গাছের মাতৃগাছের কথাও সঠিক করে বলতে পারেন। তিনি প্রায় তিনশোটির বেশি গাছ এবং ফুল চিনে নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, দীর্ঘ ৭০ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর অবসর গ্ৰহণ করেছিলেন তুলসী কিন্তু গাছের প্রতি তাঁর ভালোবাসা এতোই প্রগাঢ় যে তিনি অবসরের পরেও নিয়মিত গাছেদের পরিচর্যা এবং নতুন নতুন গাছের অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন। তুলসী গৌড়া কেবলমাত্র একজন পরিবেশপ্রেমীই নন, তাঁর যে এক প্রতিবাদী ভাবমূর্তি রয়েছে তাও জানা গেছে একটি ঘটনাক্রমে। কোন একটি বিবাদের কারণে একজন হালাক্কি মহিলাকে বন্দুক দেখিয়ে হুমকি দেওয়া হয়, তখন সেই রমণীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তুলসী, বলেছিলেন অপরাধীর যোগ‍্য শাস্তির কথাও। বর্তমানে তিনি বহু তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ‍্যে গাছ সম্মন্ধে সচেতনতা এবং প্রকৃতির রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে তা নিয়ে পাঠদান করছেন এবং হাতেকলমে শেখাচ্ছেন কীভাবে গাছের সংরক্ষণ করতে হয়।

 কর্ণাটক বনবিভাগে বীজ উন্নয়ন এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন‍্য তুলসী গৌড়াকে পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৯৮৬ সালে তিনি ‘ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী বৃক্ষমিত্র পুরস্কার’ লাভ করেছিলেন। পতিত ভূমি উন্নয়ন এবং বনসৃজনের আগ্ৰহী কোন যোগ‍্য মানুষের হাতে এই পুরস্কারটি তুলে দেওয়া হয়ে থাকে। প্রতিবছর সাতটি আলাদা আলাদা বিভাগের জন‍্য কোন ব‍্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে এই পুরস্কারটি প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রথম বছরেই তুলসী এই সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। এছাড়াও ১৯৯৯ সালে ‘কর্ণাটক রাজ‍্যোত্সব পুরস্কার’ দ্বারা তুলসী গৌড়াকে সম্মান জানানো হয়। এছাড়াও পরিবেশ সুরক্ষার জন‍্য ‘কবিতা মেমোরিয়াল’ এর মতো পুরস্কারেও তিনি সম্মানিত হয়েছেন। এরপর ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি, ৭১তম প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারত সরকার সামাজিক কাজের জন‍্য  তুলসী গৌড়ার নাম ঘোষণা করেন দেশের চতুর্থ সর্ববৃহৎ বেসামরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারের জন‍্য। সেইমতো ২০২১ সালের ৮ই নভেম্বর রাষ্ট্রপতি ভবনে, দেশের রাষ্ট্রপতি শ্রীরামনাথ কোবিন্দের হাত থেকে তুলসী গৌড়া পুরস্কার গ্ৰহণ করেন। আজ পদ্মশ্রী পুরস্কারের কারণে হয়তো তুলসী গৌড়ার কথা মানুষ জানতে পেরেছেন, কিন্তু আমাদের সবার মাঝেই এরকম অনেক মানুষ রয়েছেন যাঁরা কোন বাক‍্য ব‍্যয় না করেই  নিজেদের শ্রম এবং সময় দান করে চলেছেন এরকমই কোন কাজে। আমাদের সকলের উচিত সেই মানুষগুলির সন্ধান করে তাঁদের যোগ‍্য সম্মান দান করা। 

 

তথ্যসূত্র –

More Articles