বাচ্চাদের সামলানোর জন্য, চুপ করানোর জন্য, তাদের হাতে মোবাইল তুলে দেওয়া ওদের ভবিষ্যতের জন্য কতটা ক্ষতিকারক?

আমাদের ছোটবেলা কেটেছে দাদু ঠাকুমার আদরে, জ্যেঠু জেঠিমার কোলে কোলে, মায়ের বুকের ওমে, পাড়া পড়শীদের সাহচর্যে। আমাদের খেলার সাথী ছিল, খোলা উঠোন-সবুজ মাঠ ছিলো, গল্প শোনানোর ঠাকুমা ছিল, খেতে না চাইলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খাওয়ানোর মতো মা ছিল, ঘুম না এলে পিঠে আলতো চাপ্পড় মারতে মারতে গান শোনানোর লোক মাসি পিসি ছিলো। কিন্তু আজকালকার শিশুদের কাছে নেই সেসব স্বর্ণযুগের সিকিকড়ি। আধুনিক যুগের কর্মরত মা বাবার ব্যস্ততায়, নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির বহুল প্রচলনে এখনকার দিনের বাচ্চারা ছোট্ট থেকেই একলা। ছোট্ট দু'কামড়ার ফ্ল্যাটেই তাদের ইহজগত, বিশ্বসংসার। তার মধ্যে বাইরে কোরোনার চোখরাঙানি।

এমতাবস্থায় না তারা পায় বাইরের মানুষের সহচর্য্য, না খোলা আকাশ, না খেলার সাথী, না সবুজ মাঠ। অতঃপর মা বাবার ব্যস্ততার অছিলায় ছোট্ট ছোট্ট শিশুদেরকে ভুলিয়ে রাখতে হাতে তুলে দিচ্ছেন স্মার্ট ফোন। ফুলের মতো শিশুরা সব কিছু ভুলে দিনভর মেতে থাকছে নানানরকম গেমস, ভিডিও, ইউটিউব, ইত্যাদিতে। কিন্তু আপনি কী জানেন মোবাইল নামক যন্ত্রটিতে মেতে থেকে ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারা ভুলে থাকলেও, এই ক্ষতিকারক যন্ত্র কীভাবে সর্বনাশ করছে আপনার সন্তান সন্ততির? জানেন না তো, তবে আসুন জেনে নেওয়া যাক। 

১. মস্তিষ্কের বিকাশ : একদম ছোট্ট থেকেই মোবাইল ঘাঁটার অভ্যাসের জন্য বাচ্চাদের অত্যন্ত ক্রিয়েটিভ মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটছে না স্বাভাবিক ভাবে। মস্তিষ্কের মধ্যে যত ধরণের ভাবনা থাকে, প্রশ্ন থাকে তত বিকাশ ঘটে মস্তিষ্কের, যা কিনা শিশু বয়সে সব থেকে বেশি হয়। কিন্তু এখনকার শিশুরা মোবাইলের ছক বাঁধা জিনিস দেখতে দেখতে হারিয়ে ফেলছে বিস্ময়, মনে জাগছে না কোনও প্রশ্ন, ভাবনা শক্তি, চিন্তা শক্তি হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। 

২. ক্ষতিকারক আসক্তি : মোবাইল ছোট ছোট শিশুদের মধ্যে সৃষ্টি করে এক মারাত্মক ক্ষতিকারক আসক্তির। যার ফলে তারা মোবাইল হাতে না পেলেই কান্নাকাটি করে, অশান্তি করে। মোবাইলের ভিতরে থাকা নানানরকম মোবাইল গেমস হলো এর অন্যতম কারণ। এই আসক্তির থেকে পড়াশোনায় ক্ষতি হয় বাচ্চাদের। ক্যারিয়ারের একদম শুরুর দিকেই এই ক্ষতি চিন্তার কারণ।

৩. স্থূলতা : সারাদিন মোবাইল হাতে বসে থাকার কারণে, কোনওরকম শারীরিক কসরত না হওয়ার কারণে বাচ্চারা একদম ছোট্ট থেকেই স্থূল হয়ে পড়ছে। এই স্থূলতা থেকেই শরীরে বাসা বাঁধছে বিভিন্ন ধরণের রোগ। যা ভবিষ্যতে মারাত্মক ক্ষতিকারক হতে পারে। 

৪. সামাজিক অবস্থান : মোবাইলের আসক্তিতে বুঁদ হয়ে থাকলে মানুষ মোবাইলের ভিতরেই তৈরি করে নেয় নিজস্ব জগৎ। বাচ্চাদের বোধশক্তি সৃষ্টি হওয়ার আগেই মোবাইলের প্রতি আসক্তি সৃষ্টি হলে তারা মোবাইলের ভিতরেই বানিয়ে নেয় নিজস্ব জগৎ। ফলত বাইরের দুনিয়ার মানুষের সাথে তার কোনও সামাজিক সম্পর্ক তৈরি হয় না। সে মানুষের সাথে মিশতে পারে না, কারোর সাথে কথা বলতে চায় না, একলা একলা থাকে। যা ভবিষ্যতে তাকে ফাকে দিতে পারে গভীর অবসাদে। 

৫. চরিত্রায়ন : মোবাইলের প্রতি আসক্তির ছাপ পড়ে শিশুদের চরিত্রে। তারা ছোট থেকেই ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহারের ফলে দেখতে পায় সেই সবকিছু যা তাদের হয়তো সেই বয়সে দেখা উচিত নয়। ফলত তারা এমন এমন কাজ করে যা তাদের সেই বয়সে করাই উচিত নয়। ফলত শিশুদের চরিত্রায়ন সেই ভাবে ঘটে না যেভাবে ঘটা উচিত। অল্প বয়সেই পেকে যাওয়া, খুব পাকা পাকা কথা বলো, অশ্রাব্য ভাষার ব্যাবহার করা, বড়দের জিনিসপত্র দেখা এবং জানা এসবের লক্ষ্মণ। 

সমাধান : 
বাড়ির ছোটদের সাথে একটু বেশি বেশি সময় কাটান। ওদের সাথে গল্প করুন, ওদের নিয়ে ঘুরতে বেরোন, ঘুম না এলে গান শোনান, বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিন, ওদের সাথে খেলুন, ওরা কাঁদলে ভোলান, খেলনা কিনে দিন, লজেন্স কিনে দিন। কিন্তু দোহাই সমস্ত বাবা-মা দের, ওদের হাতে মোবাইল তুলে দেবেন না। সময়ের অভাব থাকলে, সামলাতে না পারলে, ক্লান্ত থাকলে ওদের হাতে মোবাইল তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তি খুঁজবেন না। অন্য যে কোনও উপায়ের সন্ধান করুন, বাবা-মা হয়ে ওঠার আগে দশ বার ভাবুন আদেও বাবা-মায়ের দায়িত্ব পালন করার যোগ্যতা অর্জন করেছেন কিনা! একটা প্রাণকে জগতের আলো দেখাতে চাইলে তার সঠিক দেখভাল, পরিচর্যা করার সিদ্ধান্ত নিন আগে।

More Articles