জগন্নাথের বডিগার্ড: নিরামিষাশী বাহুবলী অনিল গোচিকারের পরিচয় জানুন...

বডিবিল্ডারদের নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। বিশেষত তরুণ প্রজন্মে আজকাল এমন কেউ পাওয়া ভার, যে একবারও জিমের ভিতরখানি দেখেনি! সত্যজিতের গুণময় বাগচীর সরস চরিত্রে মলয় রায় থেকে আর্নর্ল্ড স্যোজেনেগা, মানুষের চর্চায় থেকেছেন বরাবার। মনোহর আইচকে নিয়ে বাঙালির উন্মাদনাও কম ছিল না।  কিন্তু এই বডিবিল্ডাররা থাকেন অন্তরালেই। সেবা করেন ঈশ্বরের, সম্পূর্ণ নিরামিষাশী!  কাদের কথা বলছি? বছর খানেক আগে ভাইরাল হয় পুরীর রথযাত্রার ভিডিও। আর তখনই দেখা মেলে অনিল ও দামোদর গোচিকারের। পেশীবহুল অনিলের শরীর কোনও প্রাচীন ভাস্করের ছেনিতে পাথর খোদাই যেন। তার মধ্যে ফুলে ফেঁপে উঠেছে শিরা-উপশিরা। সুপ্রিম কোর্টের আদেশে ২০২০ সালের ২৩শে জুন, পুরীর রথযাত্রায় এই প্রথমবার, ভক্তদের অংশগ্রণ ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মাত্র ৩০০ লোক নিয়ে রথযাত্রা হয়। এবং সেই রথের দড়ি টানতে টানতে মন্দিরের ছায়া থেকে লাইমলাইটে এসে পড়েন গোচিকার ভাইয়েরা।

 

ছবি ফেসবুক থেকে নেওয়া

গোচিকারের উঠে আসা

গোচিকার পরিবার মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছেন বহু প্রজন্ম। কিন্তু কাজ ছিল তাদের মন্দিরের ভিতরে। এই প্রথমবার, তাঁরা জগন্নাথের ‘সেবা’ করলেন সর্বসমক্ষে। মা, দাদা, বৌদি, তাদের দুই ছেলে, নিজের স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে অনিলের ভরা সংসার। বাবা মারা গিয়েছেন ২০০৬ সালে। প্রফেশন হিসেবে বডিবিল্ডিং-কে কখনও ভাবেননি অনিল। তাঁর এ পথে আসা তাঁর দাদার হাত ধরে। বছর চব্বিশ বয়সে আইনে স্নাতক পাশ করে নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা ‘গোচিকার হোটেল’-এর দেখাশোনায় দাদাকে সাহায্য করার ইচ্ছে ছিল তাঁর। পাশাপাশি মন্দিরের সেবায় পারিবারিক দায়িত্বের খানিকটা কাঁধে নেওয়ার ইচ্ছেও ছিল। কিন্তু পুরীতে ফেরার পর দাদা অনিলের চেহারা দেখে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হলেন। এ কি চেহারা হয়েছে ভাইয়ের? অবিকল শুকনো হ্যঙ্গার! দাদা নিজে ছিলেন জাতীয় স্তরের বডিবিল্ডার। ইস্টার্ন ইন্ডিয়া কম্পিটিশনে সোনাও জিতেছিলেন এককালে। কিন্তু অনিল তার বছর তিরিশেক বয়সে যখন জিমে ঢুকলেন, ২০০৯ সাল, তার বহু আগে দাদাকে বডিবিল্ডিং ছাড়তে হয়েছে। বাবা মারা যাওয়ার পরে পারিবারিক ব্যবসা সামলানোর ব্যাপার ছিল, কিছু আইনি মামলাও ফেঁসে ছিল, সব মিলিয়েই নিজের যাপন বদলাতে হয় দামোদরকে।

আরও পড়ুন-চোখ ধাঁধানো সাজ, একটি টিকিটের দাম ৩৮ লাখ টাকা, ভারতের রাজকীয় ট্রেনের অন্দরে চলুন

নিজস্ব শরীরচর্চার আখড়া

শরীরচর্চা শুরু করার প্রথম দিকে অনিলের এলাকায় তেমন দুরস্ত জিম ছিল না। পুরী বিচের কাছেই একখানা ছোট জিম। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সেই অনিলের যাত্রা শুরু। কোচ ছিলেন সঞ্জয় নামক জনৈক ব্যক্তি। কিন্তু একে ছোট জিম, উপযুক্ত জিনিসপত্র নেই, উপরন্তু কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিয়েও সময় নিয়ে কথা শুনতে হয়, সাপ্লিমেন্টের চড়া দাম--এসব মিলিয়ে বিশ্রী অবস্থা! খাটতে চাইলেও যথেষ্ট খাটা যায় না! এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতে এগিয়ে এলেন ফের দাদা দামোদরই। ২০১০ সালে খুললেন তাঁদের নিজস্ব জিম। দাদার অনুপ্রেরণা ও অনিলের উৎসাহে চলল তাঁদের শরীরচর্চা। বর্তমানে বহু তরুণ সেখানে শরীরচর্চা করে, ‘গোচিকার লাইফস্টাইল জিমে’। সময়ের কোনও বিধিনিষেধ নেই সেখানে।

অনিলের যাত্রাপথ

নেটদুনিয়ায় হালে বিখ্যাত হলেও অনিল এই স্পোর্টসের জগতে নাম কিনেছেন বেশ কিছুদিন। ২০১২ সালে মিঃ ওঢ়িশা ৫০তম সিনিয়র স্টেট বডি বিল্ডিং প্রতিযোগিতায় ৬৫ কেজির ক্যাটাগরিতে অনিল সোনা জেতেন। এরপর আর তাঁকে পিছন ফিরে দেখতে হয়নি। ফেডারেশন কাপে রূপো, ২০১৪ সালে ওয়র্ল্ড বডিবিল্ডিং অ্যাণ্ড ফিজিক ফেডারেশনে ব্রোঞ্জ এবং ২০১৬ সালে দুবাইতে মিঃ ইণ্টারন্যাশনাল ইণ্ডিয়ান খেতাব পান।

জগন্নাথের প্রহরী নিরামিষভোজী

শুনলে হয়তো অনেকেই অবাক হবেন, এই বিশ্বখেতাব জয়ী বডিবিল্ডার খান সম্পূর্ণ নিরামিষ খাবার। এমনকি একটা ডিম পর্যন্ত তিনি কখনও খাননি! এ বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে অনিল জানান, আমিষ ছাড়া শরীরচর্চা অসম্ভব--এ একটা মিথ মাত্র। তাঁর প্রয়োজনীয় পুষ্টি পুরোটাই আসে ডেয়ারি প্রডাক্ট থেকে। বাকি প্রয়োজন সাপ্লিমেণ্ট মেটায়। তাঁর বহু ছাত্র তাঁর পথই বেছে নিয়েছে। কিন্তু সেটা স্বেচ্ছায়। কারোর খাওয়ার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চান না অনিল।

আরও পড়ুন-নাৎসিদের হাত থেকে ২৫০০ শিশুকে উদ্ধার করেছিলেন, জেদের অন্য নাম ইরিনা…

“আমি মাংস খাই না বলে আর কেউ খাবে না--এ নীতিতে আমার বিশ্বাস নেই। বরং শরীরচর্চাকারী যে কেউ মাংস খেতে পারেন! অন্তত আমার তেমনটাই মনে হয়, অবশ্যই কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারেন।”--এই ছিল খাওয়ার বিষয়ে অনিলের বক্তব্য। ডায়েটের ব্যাপারে তিনি এবং তাঁর মা অত্যন্ত হিসেবী। অনিল জানান, তাঁর মা তেল, নুন মশলা কম দিয়েও অনবদ্য রান্না করতে পারেন। বাড়িতে একটা পেল্লাই ফ্রিজে গাজর, মুলো, শশা, আপেল, আঙুর, আনারস ইত্যাদি রাখা থাকে।

অনিলের ডায়েট

দিনে খান ৪ থেকে ৫ লিটার দুধ, দু থেকে আড়াই কিলো ফলমূল এবং ৫০০ গ্রাম মতো চিজ। সাপ্লিমেণ্টের ক্ষেত্রেও অনিল অত্যন্ত সাবধানী। মাস গেইনার, গ্লুটামিন, ডিসিএ, হে প্রোটিন, অ্যাস্টামিন, মাল্টিভিটামিন--এমন সব রকমারি নাম তাদের। দুঃখের বিষয় পুরীতে দীর্ঘদিন এইসব পাওয়া যেত না। ২০১৬ সালেও নিকটতম দোকানটি ছিল ৬০ কিলোমিটার দূরে। তাই মুম্বই, দিল্লি, গুজরাট থেকে অনলাইনেই সাপ্লিমেণ্ট আনান। দিনে এর পেছনে তাঁর খরচা প্রায় ৫০০-৬০০ টাকা।

শরীরচর্চা রোজ

সপ্তাহে ৬ দিন শরীরচর্চা করেন। সাধারণত শনিবার তাঁর ছুটি। তবে ইচ্ছে হলে সেদিনও লেগে পড়েন কখনও সখনও! সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে এক খেপ চলে সকাল আটটা অবধি, আবার বিকেলে চারটে থেকে সাড়ে ছটা অবধি চলে আরেক খেপ। রোজ ৪-৫ ঘণ্টা। সিজনে দিনে চারটে মাসল, অফ সিজনে দিনে দুটো-এই নিয়ম চলে আসছে বহুদিন। লেগ প্রেসে ২২০ কিলোরও বেশি ওজন তোলেন অনিল।

ঘরোয়া 'যুবক'

নিয়ম মেনে শরীরের যত্ন চললেও অন্যদিকে তিনি একেবারেই সাংসারিক মানুষ। দাদার দু'টি এবং নিজের একটি বাচ্চাকে নিয়ে অত্যন্ত আনন্দে কাটান। মেয়ে তাঁর প্রফেশন পছন্দ করে খুব। তবে ফিটনেসের দিকে মেয়ের ঝোঁক বেশি। স্কুলের লং জাম্পে ফার্স্ট হয়েছে। অনিল জানান, মেয়ে পেশা হিসেবে বডি বিল্ডিং বেছে নিলে তিনি নিজেই তাঁকে প্রশিক্ষণ দেবেন।  বড় ভাইপোও ক্যারাটেতে ব্রোঞ্জ জিতেছে ন্যাশনাল সাব জুনিয়রে। আর ছোট ভাইপো বেশ দুরন্ত । সব মিলিয়ে ভরা সংসার। সেই সমস্ত কিছুর সঙ্গে অত্যন্ত একাগ্র ভাবে নিজের স্বকীয় বাঁচার পদ্ধতির চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন বছর ৪৩ বয়েসের এক ‘যুবক’; অন্তত শরীরচর্চাকে এক বিশেষ যাপন বলেই মনে করেন তিনি। সোনা জিতেও এতদিন তা ছিল খানিকটা লোকচক্ষুর অন্তরালেই। যদিও লক ডাউনের রথ যাত্রা সেই নিভৃতবাসের ওপর আলো ফেলেছে। তাতে বিন্দুমাত্র আড়ষ্ট নন, বরং এই উদযাপনকে আনন্দের সঙ্গে মেনে নিয়েছেন অনিল ও দামোদর। সোস্যাল মিডিয়ায় যাদের খেতাব ‘জগন্নাথের বডিগার্ড’।

তথ্য ঋণ-

Ritik Gupta, Meet Anil Gochikar: The real baahubali of Odisha, Odisha News

Team IBB, In Conversation With Mr Odisha and Rising Star – Anil Gochikar, Indian Body Building

Kalinga TV Bureau, Meet Puri’s ‘Baahubali’ Servitors Anil Gochikar & Damodar Gochikar, Kalinga TV

 

More Articles