কার্শিয়াং, এক মায়ানগরী।

মানুষ আজন্মকাল ধরে একটা জানলা খোঁজে। দমবন্ধ করা ঘরে, আলো বাতাসহীন জীবনে, অফিসের ব্যস্ততা, সংসারের তুমুল চাপ, মূল্যবৃদ্ধির চাল ডাল আনাজ, কপালে চিন্তার ভাঁজের মত সুস্পষ্ট নিরাশার ঘন জমাট কুয়াশা ভর্তি চার দেওয়ালের ভিতরে মানুষ ছটফট করে একটুকরো জানলার জন্য। যে জানলা দু'হাট করে খুলে দিলেই একটা দমকা বাতাস হু হু করে ঢুকে পড়ে, আর আমাদের শরীর ছুঁয়েই মুছে দিয়ে যায় সমস্ত হার হতাশা গ্লানির যন্ত্রণা। সে দমকা বাতাস মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আজীবন ডানা মেলে উড়তে চাওয়া আমাদের মনের আনাচেকানাচে। যে জানলা দু'হাট করে খুলে দিলেই আলোর অবাধ প্রবেশ মুছে দেয় ঘ্যানঘ্যানে জীবনের জমাট অন্ধকার, মনের চৌদিকে জমা নিকষ অন্ধকার। মানুষ আজন্মকাল এরকম একটা জানলা খোঁজে, যে জানলা তাকে ডানা মেলার আমন্ত্রণ দেয়। আমার জীবনে এরকম একটা জানলার নাম কার্শিয়াং।

কার্শিয়াং, এক মায়ানগরী।

চিত্রঋণ : লেখকের নিজস্ব সংগ্রহ

কার্শিয়াং, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিকে খুব পরিচিত এবং জনপ্রিয় হিল স্টেশন দার্জিলিংয়ের ঠিক নীচে অবস্থিত একটা ছোট্ট পাহাড়ী শহরের নাম। মেঘ, কুয়াশা, ঘন পাইনের জঙ্গল, টয়ট্রেন আর আঁকা বাঁকা পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে ঘেরা এই শহরের জনবসতি ৫০,০০০ এর কাছাকাছি। সমতল থেকে ১৫০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই পাহাড়ী শহর শিলিগুড়ি এবং দার্জিলিংয়ের ঠিক মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। কার্শিয়াং কে 'ল্যান্ড অফ হোয়াইট অর্কিড' বলা হয়। ছোট ছোট সাদা রংয়ের অর্কিডে ঢাকা এই ছিমছাম পাহাড়ী শহরে পৌঁছানোর পর চারিদিকের সবুজ আর তারই মাঝে অর্কিডের মেলার দিকে চোখ মেলে দিলে মনে হয়, কোনও পাহাড় প্রেমিক চিত্রকর যেন তার মুক্ত ক্যানভাসে খুলে দিয়েছেন সবুজ রংয়ের শিশির ঢাকনা। তারপর দু'হাতে করে স্বযত্নে সেই সবুজ ছড়িয়েছেন গোটা ক্যানভাস জুড়ে আর তারপর রংতুলি কে সাদা রংয়ের শিশির মধ্যে ডুবিয়ে ছিটিয়ে দিয়েছেন গোটা ক্যানভাসে। সবশেষে তিনি সে ছবির নাম দিয়েছেন কার্শিয়াং।

বিস্তৃত ভ্যালির পাশে গড়ে ওঠা এই শহর থেকে যেদিকেই তাকানো যায়, দেখতে পাওয়া যায় মেঘেদের ভেলা, মেঘেদের খেলা, রংয়ের সমাহার, নীলচে আকাশ, সবুজ পাহাড়, দূরে বয়ে যাওয়া সিঁথির মতো তিস্তা, কুয়াশার ক্যারামতি। আবহাওয়া এখানে প্রত্যেক ১০ মিনিট অন্তর অন্তর বদলায়। এই রোদ তো এই বৃষ্টি আবার এই কুয়াশা। কুয়াশা নেমে আসলে কার্শিয়াংয়ে পৌঁছান এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাদুগর। তিনি কোনও অজানা গিলিগিলিতে মায়া ছড়িয়ে দিন ছোট্ট পাহাড়ী শহরটা জুড়ে। দু'হাত দূরের মানুষকে দেখতে পাওয়া যায় না ঠিক করে। এই ছিল, এই নেই। ম্যাজিক। হোম স্টের জানলা খুলে, এক কাপ চা হাতে নিয়ে গিলে নিতে হয় এ দৃশ্যের সবটুকু, ছুঁয়ে নিতে হয় গায়ে উঠে আসা মেঘের দল, গেঁথে নিতে হয় দূরে উঁকি দেওয়া পাহাড়ের সবটুকু।

কার্শিয়াং, এক মায়ানগরী।

চিত্রঋণ : লেখকের নিজস্ব সংগ্রহ

গোটা শহর জুড়ে ছড়ানোছেটানো টয়ট্রেনের পথ। ভ্যালির পাশ দিয়ে অজগরের মতো এঁকেবেঁকে চলা সে টয়ট্রেনে চেপে ঘুরে নেওয়া যায় ছোট্ট শহরটা। কার্শিয়াং থেকে কিছু মিনিটের দূরত্বেই অবস্থিত ডাওহিল। ডাওহিল হলো মায়াবী পাইনদের রাজ্যপাঠ। দুপাশে ঘন পাইনের জঙ্গল দিয়ে ঘেরা আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে শোনা যায় বাতাসের শনশন, পাখিদের কলরব। ডাওহিলের পাইন বোনে মেঘ ঢুকে গেলে, আটকে যায়। সে মেঘে এসে পড়ে রোদের মিহি আলো, আর ঠিক তখনই সৃষ্টি হয় সম্মোহনের। যে সম্মোহন কাটানো যায় না। ইচ্ছা করে থেকে যাই, এখানেই থেকে যাই। এ ছাড়াও কার্শিয়াং থেকে বিভিন্ন জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রগুলো খুবই কাছে। যেমন গিদ্ধা পাহাড় (৪ কিমি), মহানদী (৮ কিমি), গয়াবাড়ী (১৪ কিমি), ঘুম (২৪ কিমি), দার্জিলিং (৩৪ কিমি), মিরিক (৩৫ কিমি), শিলিগুড়ি (৩৫ কিমি), তিস্তা ভ্যালি (৫০ কিমি), কালিম্পঙ (৭০ কিমি) দূরে অবস্থিত। সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরে সন্ধ্যাবেলা ফেরত আসুন কার্শিয়াংয়েই। কারণ সন্ধ্যাবেলার কার্শিয়াংয়ের যে বৈশিষ্ট্য আছে, তা আর কোত্থাও নেই।

সন্ধ্যা বেলা হোম স্টে এর বারান্দা কিংবা জানলা থেকে দাঁড়িয়ে ভ্যালির দিকে তাকালে দেখবেন আস্তে আস্তে যত অন্ধকার নামবে তত একটা একটা করে জ্বলতে থাকবে ভ্যালিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঘর বাড়ির আলো। আস্তে আস্তে সব আলো জ্বলে উঠলে মনে হবে কেউ হীরে জহরত ছড়িয়ে দিয়েছে গোটা ভ্যালি জুড়ে নির্ভুল অকৃপণতায়। মানুষ বৃথাই মণি মুক্ত খুঁজতে মাটি খুঁড়ে মরে। ধীরে ধীরে যত রাত বাড়বে, তত উজ্জ্বল হবে আলোদের মিটিমিটি। সেদিকে তাকিয়ে থাকলে ঝিম ধরে যায় চোখে। ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টিশক্তি। আস্তে আস্তে চোখের পর্দায় নেমে আসে শান্তি, সুখ আর বুকের ভিতর হু হু করে ঢুকতে থাকে ফের ইঁট চুন বালি শুরকির শহরে ফিরে এসে লড়াই করার উদ্যম। কী বললেন? কতটা উদ্যম? পরের বার কার্শিয়াং এ ফেরত আসা অবধি...

কার্শিয়াং, এক মায়ানগরী।

চিত্রঋণ : লেখকের নিজস্ব সংগ্রহ

  • কীভাবে পৌঁছাবেন?

◆ ট্রেন ধরে যেতে চাইলে নিউ জলপাইগুড়ি গামী যে কোনও ট্রেনে চেপে পৌঁছে যান নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। সেখান থেকে ডিরেক্ট রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে পৌঁছে যান কার্শিয়াং। ৩৫ কিলোমিটার দূরত্ব, ১:৩০ ঘন্টায় পৌঁছে যাবেন। আর যদি শেয়ার গাড়িতে যেতে চান তবে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং মোড় অবধি আসুন অটোতে বা টোটোতে চেপে। তারপর দার্জিলিং মোড় থেকে শেয়ার গাড়িতে চেপে পড়ুন কার্শিয়াং পৌঁছানোর জন্য।

◆ ফ্লাইটে গেলে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে পৌঁছান। সেখান থেকে গাড়ি ধরে কার্শিয়াং। সময় লাগবে ঘন্টা দেড়েক মতোই।

  • কোথায় থাকবেন? খরচ কেমন?

প্রচুর ছোট ছোট হোম স্টে এবং হোটেল আছে গোটা শহর জুড়ে। নীরবতা এবং ভিউ ভালোবাসালে প্রধান বাজার চত্বরের হোম স্টে এবং হোটেল গুলোকে ছেড়ে এগিয়ে যেতে পারেন একটু ভিতরের দিকে। ভিউ সাইডে থেকে যে কোনও হোম স্টেতেই থাকতে পারেন। থাকা খাওয়া মিলে খরচ মাথাপিছু ১২০০ মতন পড়ে।

  • কার্শিয়াংই কেন?

১. পকেট ফ্রেন্ডলি।

২. সপ্তাহান্তে ঘুরে আসা যায় চট করে।

আর,

৩. কারণ পাহাড় আর ঘিঞ্জি এলাকা দুটো একসাথে যায় না। পাহাড় মানে নিশুতি উপত্যকা, নীরব নিস্তব্ধ  ফাঁকা ফাঁকা আঁকাবাঁকা রাস্তা, উঁচু উঁচু মেঘ ছুঁইছুঁই পাইনে ঘেরা, উছ্বল ঝর্ণায় ভরা, ফুলের সমাহার, গাড়ির হর্ন বিহীন এক রাজত্ব। কার্শিয়াং এই সবকিছু দেয় পর্যটককে। সবকিছু। তাই কার্শিয়াং। একবার কার্শিয়াং। দু'বার কার্শিয়াং। বারবার কার্শিয়াং।

 

সোর্স : লেখকের নিজস্ব সংগ্রহ

More Articles