এই শহরের গোপন গুহা থেকেই লড়াই শুরু স্পার্টাকাসের

রোমান শাসকদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে বিদ্রোহী দাসেরা ও পরে খ্রিস্টানরা এইসব গুহায় লুকিয়ে থাকত।

পেশাগত কারণেই হিল্লি দিল্লি, এদেশ-ওদেশ, পাহাড়-নদী-সমুদ্র আর মরুকন্দর পেরিয়ে দেশ থেকে বিদেশে যেতে হয়েছে। যে কাজের মূল উদ্দেশ্য হলো, যোগাযোগসমৃদ্ধ একটি ভাষার প্রকাশকে মনেপ্রাণে বন্দি করা। একটু কঠিন হলো? না, তেমন কোনও দুরূহ প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। বরং আয়োজন করার চেষ্টা করছি মানুষের কথা, জীবনের গাথা দিয়ে কীভাবে শব্দে বাক্যে যোগাযোগের ভাষাকে ধরা যায়। এই যে কাজ করতে গিয়ে নানা মানুষের সঙ্গ পাই, তা যতই ক্ষণিকের হোক তার মধ্যেই একটা আন্তরিকতা তৈরি করতে হয়, নইলে কাজ এগোয় না। এমত শিক্ষা সেই কম বয়সেই দাদাদের কাছে পেয়েছি।

 

এর বাইরেও অসংখ্য জানালা আছে খোলা। বন্ধুত্বের আহ্বান আসে, আলো আসে, পরিসর তৈরি হয় যোগাযোগের, অকুণ্ঠ সম্পর্কের মুকুল ফোটে। এভাবেই দেখা হয়, কথা হয়। সেসব মানুষের কখনও ভালোমন্দের তুল্যমূল্য বিচারে যাইনি। এক এক মানুষ এক এক রঙের, এক এক মানুষ এক এক ভাবের। এই যে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্ব, তার মধ্যেই খুঁজেছি দিলদুনিয়ার কথার কথা আর ওই দিলসমুদ্রের দু'-চামচ জল তুলতে চেষ্টা করেছি, যা তাদের আত্মজৈবনিক উপলব্ধির খণ্ড বৈচিত্র, ভঙ্গুর এলিজির দু'-একটা লাইনের মতো। তো এমন দু'-জনকে নিয়ে এবেলায় লিখতে চাই, যারা চলনেবলনে মেরুপ্রমাণ দূরত্বে অবস্থান করে এবং সামাজিক দিক থেকেও তাই। তো এদের সম্পর্কে বলার আগে পরিপ্রেক্ষিতটি একটু জানাই!

 

মধ্য ইতালিতে উমব্রিয়া অঞ্চলের আমেলিয়া একটা ছোট শহর। এই শহরে আমাকে নানা কারণে বারবার যেতে হয়েছে। রোমান আমলে প্রাচীন এক পাহাড়ি দুর্গকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই শহর। এমনিতেই দুর্গনগরী আমার পছন্দের। ইতিহাসের অপার ইশারায় শিহরিত হয়েছি, যখনই গিয়েছি। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৮-এ এই শহরের নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচিতি তৈরি হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব আশিতে সিসেরো বলছেন, এই এলাকাটি ছিল যথেষ্ট সমৃদ্ধ। ফোর্টে এখনও রয়েছে অতি-প্রাচীন বেলেপাথরের চাঁই দিয়ে তৈরি দেওয়াল। চওড়া টানা রোমান রাস্তা। পুরনো পাথরে তৈরি জলনিকাশি ব্যবস্থা। আছে ছোট্ট গির্জা আর অষ্টাদশ শতকের এক থিয়েটার হল। যেখানে নিয়মিত অপেরা হতো। আমেলিয়ার আরেকটি পরিচয় হলো, অত্যন্ত প্রাচীন এই মিউনিসিপ্যাল শহর ছিল শিল্পীদের কমিউন।

 

আরও পড়ুন: যাযাবর, অচ্ছুৎ, আধা-বেশ্যা! যেভাবে বাঁচে রাজস্থানের কালবেলিয়ারা

 

এই আমেলিয়ার ছিমছাম বাজারের এক আড্ডাঘন বন্ধু পরিবেশে একটি ঝুলন্ত রেস্তোরাঁ ছিল আমাদের অনেকেরই প্রিয়। এখানেই এক বন্ধুর সূত্রে আলাপ হয়েছিল সমাজতাত্ত্বিক, অধ্যাপক ফ্রাঙ্কো লরেনসনে-র সঙ্গে। বামপন্থী মননের এই শিক্ষক, যিনি সমগ্র বিশ্বের অনুপুঙ্খ খবরাখবর রাখেন। লাতিন আমেরিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা থেকে এশিয়া, ইউরোপ থেকে আমেরিকা। তাঁর কথার অনুষঙ্গে চলে আসে জিওপলিটিক্স, ইকোলজি, ডেভেলপমেন্ট, ইকোনমিক্স কিংবা সংস্কৃতি। আমি কলকাতা থেকে ছবি দেখাতে এসেছি শুনে আমার শহরের ফিল্ম উৎসবে আন্তোনিওনি দিয়ে শুরু করে জ্যোতি বসু ভায়া বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য টু ঋত্বিক ঘটক আর ছায়ায়-মায়ায় রবীন্দ্রনাথ থেকে সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে কত কথা যে বললেন আর শুনতে চাইলেন, তার ঠিক নেই।

 

এই ফ্রাঙ্কো থাকে চেনচিতে। চেনচি হলো আমেলিয়া দুর্গের নিচের উপত্যকার গ্রাম। পার্বত্য অঞ্চলের মাঝে। পাহাড়ের গায়ে আছে প্রাকৃতিক সব নানা গুহা। দীর্ঘ ছায়াশীতল আশ্রয়। জনশ্রুতি, রোমান শাসকদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে বিদ্রোহী দাসেরা ও পরে খ্রিস্টানরা এইসব গুহায় লুকিয়ে থাকত। এখানে আছে অসংখ্য গোপন-গুপ্ত চোরা পথ। জানা যাচ্ছে, স্বয়ং স্পার্টাকাস এইখানে থেকে বিদ্রোহ পরিচালনা করেছিলেন। এমন একটা ইতিহাস-ছোঁয়া উপত্যকায় প্রায় কয়েক একর জমি সংগ্রহ করে একটি সংস্থা তৈরি করেছে ফ্রাঙ্কো লরেনসনে। যেখানে প্রয়োজনে পঞ্চাশ থেকে ষাট জন একত্রে থেকে কাজ করতে পারেন। মূলত নানা ধরনের কর্মশালা, থিয়েটার, সেমিনার, মিউজিক আর সিনেমার জন্য ব্যবহৃত হয়। এখানে একটি জনহেঁশেলের ব্যবস্থা আছে। আছে ফ্রাঙ্কোর সংগৃহীত বই, ছবি আর ভাস্কর্য।

 

১৯৮১ সালে নাট্যঋষি জার্সি গ্রোটস্কি ফ্রাঙ্কোর এই 'স্পেস'-টি উদ্বোধন করতে আসেন। সেই সূত্রে ইউরোপ-আমেরিকার বহু স্বনামধন্য ব্যক্তির এখানে যাতায়াত। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমেলিয়া ও পার্শ্ববর্তী শহর-গ্রামের লোক এখানে জমায়েত হয়। দৈনন্দিন লড়াইয়ে ক্লান্ত মানুষদের ঠাঁই এই চেনচি। যারা এখানে কিছু দিন থেকে আবার নতুন করে এনার্জি অর্জন করে সমাজসংকীর্তনের বেকায়দার পথে পরিকল্পনামাফিক চলতে পারে। বলা যেতে পারে, সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ও ব্যক্তিক চর্চা ও ধ্যানের শ্রীক্ষেত্র এই চেনচি। যতবার গেছি, ততবারই আশ্চর্য হয়েছি এখানে দেখা হওয়া  বৈচিত্র‍্যময় মানুষের উপস্থিতি দেখে। সম্ভবত ফ্রাঙ্কো আলাপ করিয়েছিল আবদুল্লা সুরি বলে একটি আফ্রিকান ছেলের সঙ্গে। আপাতদৃষ্টিতে আবদুল্লাকে দেখেই নেশাখোর মনে হয়। অথচ কথা বলে জানতে পারি, সে বেকেট নিয়ে গবেষণা করছে। আমেলিয়ার বাজারের কাছে একটা গাড়ি সারানোর গ্যারেজে আছে তার। একজন অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ইতালিয়ান মহিলার সঙ্গে থাকে, আনন্দে থাকে।

 

আবদুল্লার সমস্ত কথাই দর্শনের সুরে বাঁধা। যেমন বলে, মনের পাহাড়ে এক নদী বইছে বা সময় বলে কিছু হয় না কিংবা যৌনতা, নেশা আর কর্ম নিয়ে অলীক সমস্ত ধারণার কথা। কিন্তু যেটা না বললে আবদুল্লার কথা সম্পূর্ণ হয় না, তা হলো তার গাঁজাপাতা নিয়ে পরীক্ষামূলক রান্নাবান্না। সে গাঁজার পাতা দিয়ে স্যুপ, তরকারি ইত্যাদি তো নিয়মিত খায়ই, সঙ্গে তৈরি করে গাঁজা থেকে উৎপন্ন সবুজ মদ। সে একেবারে যাকে বলে, বিষ। দু'-চার চুমুকেই মাথার ছিটকিনি খুলে যাবে। শরীরের খিল যাবে খুলে। আর এইসব গলাধঃকরণ করে আবদুল্লা বেকেট নিয়ে অনর্গল বলে চলে কোনও এক গুহার বাঁকে বসে। ঠিক তখনই বোঝা যায়, ওর দার্শনিকতার চালিকাশক্তিটি কী! কথা বলতে বলতে আবদুল্লা গুহার ইতিবৃত্ত যোগ করে।

 

একটা গা ছমছমে ইতিহাসের খোলা পাতা যেন।

 

যে গ্রামের মাটিতে-পাথরে, নিদর্শনে-কথাসরিতে, আছে ইতিহাসের স্পর্শ , সটান-তীক্ষ্মতায়। এই প্রকৃতি-আদৃত অঞ্চলটা নিয়ে কখনও কিছু একটা করব ভেবেছিলাম। দেখা, শোনা, লেখা, পড়ার মধ্য দিয়ে একটা ওরাল হিস্ট্রির সঙ্গে চলা, একটা অন্বেষণ, প্রাচীন একটা গীতি-বীরত্ব-গাথা। কিন্তু আজকের এই বেয়াড়া প্রচার-বিভ্রান্ত জগতে তা আর হয়ে ওঠেনি, হয়নি।

 

তো কী আর করা যাবে! 

More Articles