বেহালা থেকে ইটালি, পকেটমারের দুনিয়াদারি চলছে

লিখতে চাই না, কিন্তু লিখি। লিখি মনের দায়ে, প্রাণের দায়ে, পেটের দায়ে, সমাজের দায়ে। ওই যে কুতকুতে চোখের মানুষটি বলে গিয়েছিলেন না! আপনি বাঁচলে সমাজের নাম। সমাজ বাঁচলে বাপের নাম!  ফলে সমাজ সংস্থার আশা নিরাশায় আর প্রচার বিভ্রান্ত এই সমসাময়িক অবস্থান নিয়ে খানিক আঁক কাটতেই হয়। যাক সে কথা। এখানে প্রসঙ্গ হল নতুন এক ধারাবাহিকে কথা-কাহিনির উপস্থাপন। সম্পাদকের আদেশ মেনে সে সব লেখা লিখতে হবে। তাই সেই আয়োজনের শুরুতেই খানিক ইঙ্গিত দেওয়া যেতে পারে যে কী লিখবো আর কি ...

আসলে লিখতে চাই ভিন্ন এক কথাসাগরচরিত। যা আমারই জীবনের যথেচ্ছ যাপনের দিনলিপি। বলা যেতে পারে। বলা যেতে পারে মূল ধারার বিপ্রতীপে পরিবর্ত জীবনের আগডুম বাগডুম। দেশে বিদেশে কাজে অকাজে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে যে প্রান্তিক মানুষগুলোর সাথে দেখা হয়েছিল, তাদের দৈনন্দিনের সঙ্গে আমার বোঝাপড়া আর মজা মারা থেকে ব্যক্তিক সময়ের নিরবচ্ছিন্ন সরগরম লেখার চেষ্টা করব। এ কোনো কবুলতি নয় , না কোনো প্রতিশ্রুতি। চোখ পালটে চলে যাব এক বিশেষজ্ঞের শোভিত ড্রইংরুমে বা কোনো এদেশ বিদেশের বাবুবিবির কাণ্ডকারখানায়। কিন্তু দুনিয়াদারির বৃহত্তর পরিসরে, কানাগলিতে, আমি ব্রাত্য জীবনের অন্তর্নিহিত এক ভগ্ন সহজপাঠের অবতারণা করব। সেখানে সব থাকবে। কবি থেকে পুলিশ, নেতা থেকে গণিকা, মাতাল থেকে পুরোহিত,  আড়কাঠি থেকে গেঁজেল, গৃহস্থ থেকে সাধু , ব্যবসায়ী থেকে চ্যাংড়া-লোফার,  চোর-ডাকাত- বাটপার- পকেটমার ঘুরে ফিরে আসবে স্বমহিমায়, ভদ্র- অভদ্রের সীমারেখারহিত সে এক আজব কারখানা।

এবার শেষ থেকে শুরু করা যাক। হ্যাঁ, পকেটমার নিয়েই লিখব। লিখব তার কতিপয় খন্ডাংশের অভিজ্ঞতা। যাদের দেখেছি ও কিঞ্চিৎ সঙ্গ করেছি । তো ভালো ইস্কুলের কৃতী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও আমার চলাফেরা ছিল বস্তি-মহলের ছায়ায় ছায়ায়। কত না বকাঝকা আর কত না মার খেয়েছি তা ভগাই জানে। কিন্তু আমার তাতে কোনো তাপ-উত্তাপ ছিল না। তখন আমার পথ চলাতেই আনন্দ। তো সেই বস্তিবাসী মদনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব মূলত খেলার মাঠে। খুব ভালো বল করত। দুজনেই বহুবার খেপ  খেলতে গিয়েছি একসঙ্গে  এবং ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হয়েছি। এই মদন আসলে মহম্মদ। কিন্তু ওদের নিম্নবিত্ত পরিবারে প্রত্যেকেই হিন্দুনাম ব্যবহার করত।

বাবা লেদ মেশিনের শ্রমিক ছিলেন। যক্ষ্মায় তখন শয্যাশায়ী। মা লোকের বাড়িতে কাজ করেন। তিন বোনকে মা শিক্ষা দিয়েছেন  খুঁটে খেতে।
যেভাবে মদনকেও রোজগার করতে হতো। পকেটে বেশ ভালো টাকা থাকতো নেশাভাঙের জন্যে। একবার রাত্রিঘন আড্ডায় অন্যান্যরা চলে গেছে। মদনের সেদিন নেশা খানিক বেশিই ধরেছিল। বলতে গেলে সেই সুযোগেই আমি আমার কৌতূহল বশত মদনকে জিজ্ঞেস করি যে তার এই টাকাপয়সার উৎস কি? নেশাগ্রস্ত  সে তখন অকপট। এক দীর্ঘ কাহিনি সবিস্তারে বলে ফেলে মদন। কোনো এক সময় তাকে পেটি কেস দিয়ে শ্রীঘরে পাঠায় পুলিশ। সেখানে তার সঙ্গে দেখা হয় পারভেজের। সেইই তাকে এই লাইনে নিয়ে আসে। মদনের কথায় , 'সব কিছু কি আর শিখিয়ে দিতে পারে? হাতের কাজ করতে করতে চোখ তৈরি হয়ে যায়।' জেল থেকে তারা বেরিয়ে কিছুদিন একত্রে কাজ করে। পরে যে যার লাইন খুঁজে নেয়।

সেভাবেই মদনের লাইন হয়ে ওঠে বেহালা রুটের সাত নম্বর সরকারি বাস। সপ্তাহে তিন থেকে চারদিন সে লাইনে থাকে। তার কাছেই শুনেছি এই লাইনে দু'রকম ভাবে কাজ করা যায়। এক হলো কোনো দলের সঙ্গে থেকে করা অথবা একদম একা কাজ করা। একার কাজে ঝুঁকি বেশি। দলের হয়ে কাজ করলে অধিকাংশ সময় দু'জন কি তিনজন থাকে। কেউ ধরা পড়লে অন্যরা সাধারণ যাত্রী সেজে তাকে পালানোর ব্যবস্থা করে দেয়।

মদন বলছিল তার একবার ধরা পড়ে যাওয়ার গল্প। ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় মার। 'পকেটমারের মার কথাটা শুনিসনি?' প্রায় তিন মাস জেল হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল তাকে। প্রথম দু'মাস উঠে বসতে পারেনি।

যে সময়ের ঘটনা লেখা হলো , তখন আমরা দু'জনে বছর কুড়ির আশেপাশে। মদন আমার থেকে সম্ভবত বছর দেড়েকের বড় ছিল। তারও বছর দশেকের পরের কথা। তখন আর যোগাযোগ নেই। সেই বস্তিবাসী সংলগ্ন বাসাবাড়ি ছেড়ে আমরা অন্যত্র চলে গেছি। আমার ভবঘুরে জীবন অন্য স্বপ্নে ভেসে গেছে। তা সে সময় একদিন সাত নম্বর বাসে উঠেছি , বেহালা থেকে টালিগঞ্জ যাব। বাসটায় মাঝারি ভিড়। আমি পিছনের দিকে উঠেছি। দু'চার স্টপেজ যাওয়ার পর পরই শুনি সামনের দিক থেকে  'পকেটমার পকেটমার' বলে সমবেত এক ক্রোধ-চিৎকার। ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে। বেধড়ক প্যাঁদানো হচ্ছে পকেটমারকে। ভিড় আর হল্লায় ঠিক ভাবে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। বাস তখন বেহালা থানা পর্যন্ত পৌঁছেছে। সেই জটলা চিৎকার আর একতরফা  মারের মধ্যে এক মহিলার আর্তনাদ শুনতে পেলাম। 'আরে লোকটা তো মরে যাবে! বরং ওকে পুলিশে দিন।'

ততক্ষণে বাসের ড্রাইভার বেহালা থানার সামনে বাসটা ঢুকিয়ে দিয়েছে। বাস থেকে যাত্রীরা নামতে শুরু করেছে। আমিও ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখি রক্তাক্ত অবস্থায় প্রায় বেহুঁশ ছেলেটিকে চ্যাংদোলা করে কজন থানার মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে। এক ঝলক দেখেই চিনতে পারি এ সেই মহম্মদ ওরফে মদন। আমার শরীরটা কেমন যেন শীতল হয়ে এল। শুনতে পেলাম দূর থেকে কেউ যেন বলছে, 'পকেটমারের মার কথাটা শুনিসনি?' এরপর আর কোনো দিন মদনের সঙ্গে দেখা হয়নি।

তবে এরপরেও পকেটমারের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সে ছিল নেহাতই এক কিশোর। শিয়ালদহ থেকে লালগোলা ছিল তার লাইন। সুন্দর দেখতে সেই কিশোর চিকন গলায় গান গাইত আর ট্রেনের গায়ে বাজাত। গান শুনে অনেকেই কাছে ডাকত আর সেই সুযোগে সে কম্মটি সেরে ফেলতো। তার বাবা ছিলেন এক দরিদ্র বাউল গায়ক। ছেলে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার ধরা পড়েছে। কিন্তু তাতে কি? এ ট্রেন ছেড়ে সে অন্য ট্রেনের লাইন ধরেছে।

জনান্তিকে এই কিশোর ছেলেটির কথা শুনেছি। তা একদিন সকাল সকাল এই শীতল দাসকে নিয়ে আমার বাড়িতে উপস্থিত হন নদিয়ার প্রখ্যাত বাউলগুরু সুবল দাস বাউল। সুবল গোঁসাই বললেন, এই ছেলেটি আমার ছোটবেলার বন্ধু অনন্ত দাসের ছেলে। ওর বাবা দেহ রেখেছে। বাবার কাছেই গানবাজনা শিখেছে। একটু দুষ্টু প্রকৃতির। ভাবছি ওকে নিয়ে  কিছু দিন ঘুরব। যদি কিছু শেখে! যদি ভদ্রলোকদের সাথে মেলামেশা করে কিছু করতে পারে। এক্ষেত্রে আমার আর কী বলার থাকতে পারে! সুবল গুণী ও গুরু। এই পথ হয়তো ছেলেটাকে পাল্টেও দিতে পারে!এই হল যোগাযোগের শুরু।

বাউলফকির বিষয়ে ছিল আমার এক ধরনের অনুসন্ধিৎসা। ফলে শীতলের সঙ্তে তারপর দীর্ঘদিন কাজ করেছি। সে ক্রমে দীক্ষাশিক্ষা নিয়ে বাউল হয়ে ওঠে। মাঝে মধ্যে এর ওর টাকা হারানোর কথা যে শুনিনি তা নয়। কিন্তু আসতে আসতে সে তার জীবনকে পাল্টে ফেলে। কয়েক বছর আগে দেখা হয়েছিল ইতালির একটা ছোট্ট শহরে। দারুণ গানবাজনা করছে। ইউরোপেই থাকে বছরের অধিকাংশ সময়। বাউলদের প্রভাব তার দৈনন্দিনকে পাল্টে দিয়েছে। শীতল এখন ভদ্দরলোক। শীতল দাস বাউল...

আর একটা ছোট্ট ঘটনা বলে এই প্রথম পর্যায় শেষ করব। তখন আমরা বন্ধুবান্ধব মিলে একটি বুক স্টল চালাই।কাগজের বাঘ নামের সেই দোকান ছিল কলেজ স্ট্রিটে। সেই দোকানের উল্টো দিকে ছিল বুড়োর চায়ের দোকান। বুড়োর সাথে আমাদের মেলামেশা ছিল অবাধ। পুজোর সময়টা ছিল তার সবচেয়ে বড় কাজের সময়। দিনরাত খেটে ওই সময় সে উপর্যুপরি বেশ খানিকটা লাভ করতো। তেমনি এক পুজো শেষে ওর দোকানে গিয়ে শুনি ওর সেই সারা পুজোর সঞ্চিত অর্থ বনগাঁ লোকালে বাড়ি ফেরার পথে পকেটমারি হয়ে গেছে। বুড়ো কান্নাকাটি করছে আর বন্ধুরা তো বিরাট  চিন্তিত।

আমার তখন হঠাৎই মনে পড়ে গেল হামজা মিঞার কথা। এই হামজার সাথে আমার আলাপ হয়েছিল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। সে ছিল সাজাপ্রাপ্ত,  আমার ওয়ার্ডের মেট। জেলে চোরডাকাতদের অ্যাপ্লিকেশন লিখতে এদের সাথে ভাবখাতির। সেখানেই শুনেছিলাম অন্যান্য নানা অপরাধের সঙ্গে হামজা একটা পকেটমারি দল চালাতো। সে সময়ই সে আমাকে বলেছিল যে শিয়ালদহ লাইনে কিছু হারালে আমি যেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। সে কথা মনে পড়তেই রাজাবাজারের গলিঘুঁজি পেড়িয়ে পৌঁছালাম বুড়োকে নিয়ে। হামজা মিঞা তার বেশ কিছু দিন আগেই খালাস পেয়েছে। গিয়ে বললাম বুড়োর ঘটনা। হামজা সব শুনে নির্বিকার ভাব নিয়ে চা খেতে বললো। অন্য অনেক কথা বললো। কিন্তু আসল কথা নেই। এর পর আমিই খানিকটা উদ্বেগ বশে জিজ্ঞেস করতে বলল। সন্ধ্যার সময় লোক আসবে তখন দেখছি কি করা যায়। সন্ধ্যার সময় একে একে তার দলের লোক আসতে আরম্ভ করল। তার মধ্যে একটি ছেলেকে চাপা স্বরে কী যেন একটা বলল। তার কিছুক্ষণ পরে ছেলেটি বুড়োর ব্যাগ সমেত ফেরৎ দিয়ে গেল। হামজা মিঞা গর্বের সঙ্গে বলল, ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে গেলে আর পেতেন না। আমি অবাক হয়ে ওদের নেটওয়ার্কের কথা ভাবতে ভাবতে 'লোয়ার ডেপথ'-এর পাতায় পাতায় মন ঘোরালাম।

আপাতত এইটুকুই।

More Articles