বুকে ব্যথা নিয়েও শট দিয়েছিলেন, ফিরে দেখা মহানায়কের শেষ দিন

চিরদিনের মতো বাঙালিকে ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন তার রূপকথার নায়ক? অবশেষে উত্তমকুমারের বাড়ির লোকের তরফে তাঁর মৃত্যুর খবর প্রকাশ করা হল। সারা কলকাতা যেন মুহূর্তের মধ্যে শোকস্তব্ধ হয়ে গেল।

 

‘ক্লোজ শট'-এ ধরা আছে তাঁর মুখ। চোখে হালফ্যাশনের সানগ্লাস। ঠোঁটে জ্বলন্ত ‘ফাইভফিফটিফাইভ’ সিগারেট। চলতি হিন্দিতে অনেকে যার নাম দিয়েছিলেন, ‘পাঁচশো পচপন’। ‘নায়ক’ ছবির এই দৃশ্যের সঙ্গে আপামর বাঙালি পরিচিত। তাঁকে ছাড়া এই ছবির মূল অভিনেতা হিসেবে কারও কথা ভাবতে পারেননি সত্যজিৎ রায়। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লিখেছিলেন, ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’। কিন্তু বাঙালির একমাত্র ম্যাটিনি আইডল খুব একটা নীরবে আসেননি। তিনি এসেছিলেন যথেষ্ট কোলাহল সঙ্গে নিয়ে। চলেও গিয়েছিলেন রাজার মতো। তারপরেও বাঙালির ম্যাটিনি আইডলের অনুসন্ধান থামেনি। কিন্তু, জীবনানন্দর থেকে খানিক ধার করেই বলা চলে, ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।’

তারকার মৃত্যু হয় নিঃশব্দে। পৃথিবী থেকে তার আঁচটুকুও পাওয়া যায় না। আর এমন উজ্জ্বল তারকার মতোই মৃত্যু হয়েছিল ‘নায়ক’-এর অরিন্দম মুখার্জির চরিত্রাভিনেতার। বাঙালি যাঁকে চেনে উত্তমকুমার নামে। কেমন কেটেছিল মহানায়কের মৃত্যুর আগের চব্বিশ ঘণ্টা?

দিনটা ছিল ১৯৮০ সালের ২৩ জুলাই। ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ছবির শুটিং তখন পুরোদমে চলছে। সকাল সকাল নিয়মমাফিক পুজো সারলেন উত্তম। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে রওনা দিলেন স্টুডিওর দিকে। সঙ্গে ছিলেন প্রযোজক অসীম সরকার। উত্তমের শারীরিক অবস্থা তখন ভালো না। ‘ছোটি সি মুলাকাত’ ছবি ফ্লপ হওয়ার দরুন বাজারে বিস্তর ধার-দেনা। তার ওপর সুপ্রিয়া দেবী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। দুশ্চিন্তা যেন আর কাটে না। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও নিয়মমাফিক লৌকিকতা সারছেন তিনি। প্রত্যেকবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেই হয়ে উঠছেন এক অন্য জগতের মানুষ। তখন আর তিনি টলিজগতের চিরপরিচিত খাদ্যরসিক, আড্ডাপ্রিয় উত্তমকুমার নন। অভিনয়ের মুনশিয়ানায় তিনি তখন মহাকাব্য রচনা করেছেন। অকল্পনীয় অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলছেন, ‘বাঘবন্দী খেলা’ বা ‘নগর দর্পণ'-এর চরিত্রদের।

আরও পড়ুন: এক তরুণী লাল ব্লাউজ ছুড়েছিলেন উত্তমকুমারের দিকে

সেদিন গাড়িতে উঠতে গিয়ে প্রথম ধাক্কাটা খেলেন উত্তম। তিনি দেখলেন, তাঁর বহু পুরনো টেপরেকর্ডারখানা গাড়ির ভেতর থেকে বেমালুম উধাও হয়ে গেছে। বুঝতে বাকি রইল না, যন্ত্রটা চুরি হয়েছে। তাঁর কত বছরের বন্ধু এই টেপরেকর্ডার। শুটিংয়ে যাওয়ার সময় প্রত্যেকদিন এই টেপরেকর্ডারে নিজের পছন্দ মতো গান বাজাতেন তিনি। আজ তার অনুপস্থিতি যেন সত্যিই বন্ধু-বিচ্ছেদের মতো। বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন উত্তম। স্টুডিওতেও সারাদিন আনমনা হয়ে রইলেন। অবশেষে ডাক পড়ল শুটিং ফ্লোরে। শট তৈরি। সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক ধুন্ধুমার ঝগড়ার দৃশ্যে অভিনয় করবেন তিনি।

শোনা যায়, এটাওয়া ঘরানার বুজুর্গ উস্তাদ এনায়েত খাঁ, কন্যার মৃত্যুর খবর শুনেও রেওয়াজের আসন ছেড়ে উঠতে পারেননি। সুরবাহার হাতে নিয়ে তিনি কন্যার মৃত্যুর বেদনা বুকে চেপে বেহাগ বাজিয়েছিলেন। নিজের শিল্পকর্মের প্রতি এনায়েত সাহেবের এমন নিষ্ঠার সঙ্গে বোধহয় তুলনা চলে একমাত্র উত্তমকুমারের।

দৃশ্যটা ছিল সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার। এমতাবস্থায় উত্তমকুমার দাড়ি কামাতে কামাতে তাঁকে বলবেন, ‘আমিও দেখে নেব, আমার নাম গগন সেন...।’ দৃশ্য হলো পরিকল্পনামাফিক। উত্তমকুমার সংলাপও বললেন। কিন্তু দৃশ্য শেষ হওয়ামাত্র অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বুকে ব্যথা শুরু হয়েছিল আগেই। শট দিতে দিতে একহাতে বুক চেপে ধরেছিলেন তিনি। কিন্তু একবারের জন্যও সংলাপ থামাননি।

শুটিং থেকে ফিরে ফের নিয়মরক্ষার খাতিরে ছুটতে হল বন্ধু দেবেশ ঘোষের বাড়িতে। বিশ্রামের জো নেই তাঁর। বন্ধুর বাড়ি থেকে আড্ডা দিয়ে ফিরলেন রাত করে। বাড়ল অসুস্থতা। বাড়ির লোকেরা সঙ্গে সঙ্গেই দক্ষিণ কলকাতার ‘বেলভিউ’ নার্সিংহোমে তাঁকে ভর্তি করালেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। চব্বিশ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই মৃত্যু হল মহানায়কের। তাঁর চিকিৎসার জন্য পাঁচ জন ডাক্তারের একটা মেডিক‍্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু করা গেল না।

মহানায়কের মৃত্যুর খবর সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু চাপা গুঞ্জন কি আর আটকে থাকে? ২৫ জুলাই ভোর থেকেই উত্তমকুমারের গিরিশ মুখার্জি রোডের বাড়ির সামনে ভিড় করছিল মানুষ। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন সাংবাদিক। প্রশ্ন একটাই, সত্যিই কি তাহলে ইন্দ্রপতন ঘটেছে? চিরদিনের মতো বাঙালিকে ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন তার রূপকথার নায়ক? অবশেষে উত্তমকুমারের বাড়ির লোকের তরফে তাঁর মৃত্যুর খবর প্রকাশ করা হল। সারা কলকাতা যেন মুহূর্তের মধ্যে শোকস্তব্ধ হয়ে গেল। স্রেফ ধুতি আর বাংলার শার্ট পরে হাজার হাজার দর্শকের মন জিতে নিতে আর কেই-ই বা পেরেছেন?

স্বর্ণযুগের এক মহাকাব্যিক অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়ে সেদিন চলে গিয়েছিলেন উত্তমকুমার। এই আলো-আঁধারির স্বর্ণযুগই তো এসে উপস্থিত হতো মান্না দে বা শ্যামল মিত্রর গানের ইন্টারলিউডে। সেই যুগের সন্ধেগুলো ছিল মায়াময়। গরিব কেরানি দশটা-পাঁচটার চাকরি সেরে বাড়ি ফিরতেন। তারপর সপরিবারে ভিড় জমাতেন বসুশ্রী বা উজ্জ্বলা সিনেমায়। হলের বাইরে বাদামি রঙের ঠোঙায় পাওয়া যেত অদ্ভুত সুস্বাদু চানাচুর। আর ভেতরে সেলুলয়েড স্ক্রিনে চলত অপূর্ব সব কাণ্ডকারখানা।

কখনও বিশ্বজিৎ রেড রোড দিয়ে চলে যেতেন গাড়ি হাঁকিয়ে। লিপ মেলাতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের সঙ্গে, ‘কাছে রবে, কাছে রবে, জানি কোনওদিন হবে না সুদূর।’ কখনও আবার স্বয়ং উত্তমকুমার মাথায় বাঁকা টুপি পরে ঠোঁটের কোণে সিগারেট নিয়ে আড়চোখে পিছন ফিরতেন। শুধু সেই দৃষ্টির জোরেই একধাক্কায় গোল্ডেন জুবিলি পার করত বাংলা ছবি।

এক সময়ে এমনই প্রেম ছিল বাংলা ছবিতে। অনিল চট্টোপাধ্যায় সংলাপ বলতেন ধ্রুপদী মীড়ের ঢঙে, টেনে টেনে। সেই সংলাপের মধ্যে দিয়েই যেন ফুটে উঠত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের সপ্তসিন্ধু, দশ দিগন্ত। তারপর এল ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’-এর যুগ। পেশিবহুল নায়ক গুণ্ডাচক্র ধ্বংস করে নায়িকাকে একা হাতে উদ্ধার করবেন। নায়িকা হয়ে উঠবেন তাঁর শেষ বেলার বিজয়ী ট্রফির মতো। এমনই হয়ে উঠল অধিকাংশ মূলধারার বাংলা ছবির ছাঁচে বাধা গল্প। আসল কথা হলো, এই ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান'-এর ধারণার প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, নায়করা যেন প্রবলভাবে পুরুষ হয়ে উঠলেন। প্রেমিক হতে ভুলে গেলেন। 

More Articles