শেষ মুহূর্তে চেয়েছিলেন একটু কমলালেবু, জীবনানন্দের মৃত্যুর পর পুড়ে যায় 'ঘাতক' ট্রামটিও

Last Days of Jibanananda Das : জীবনানন্দ দাশ। শরীরে ব্যান্ডেজ বাঁধা, চোট আঘাতের ছাপ পড়েছে মুখেও। তবুও প্রবলভাবে বাঁচতে চেয়েছিলেন।

১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর। অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছে তখন। শীতের পরশ কয়েকদিন পরেই তার তেজ বাড়াবে। আপাতত এই রাতটা বেশ শুনশান, ধু ধু করছে বলা চলে। কলকাতার অনেক বাড়িতে আলো নিভে গিয়েছে। জেগে আছে গণেশ এভিনিউয়ের বাড়িটি। মেঝেয় শূন্য দৃষ্টি নিয়ে বসে আছেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য। কবি, সাহিত্যিক, ‘পূর্বাশা’ পত্রিকার সম্পাদকের চোখ থেকে অনবরত ঝরে যাচ্ছে জল। তাঁর চারপাশটা যেন এক মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, জানতেন, এই দিনটি একদিন না একদিন দেখতে হবেই। তবুও তো আশা ছিল মনে! যদি অবিশ্বাস্য কিছু হয়! না, সেসব কিছুই হল না। সঞ্জয় ভট্টাচার্যের হাতে উঠে এল কাগজ, কলম। খসখস করে লিখে ফেললেন একটি কবিতা, যদি এতে শান্তি পান…

“একটি জাহাজ ছেড়ে গেল।
হলো নিরুদ্বেল ও
মনের জেটির কাঠ নেই আর ওঠা-নামা মাল।

যাত্রীর যন্ত্রণা গোলমাল গেছে সমস্ত সকাল
এখন সবাই মোহনায়,
সমুদ্রের লোনা হাওয়া মেখে ঘামে কেউ-কেউ,
কেউ শিস দিয়ে গান গায়…”

ওইদিনই কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের ঘরটির বাইরে অদৃশ্যে নেমে এসেছিল মহীনের ঘোড়াগুলি। অদ্ভুতভাবে, সেদিন ছিল কার্তিক মাস। কার্তিকের জ্যোৎস্নায় ঘাস খাওয়ার স্বপ্ন দেখছিল তারা। আর হাসপাতালের বেডে একটু একটু করে শেষ নিঃশ্বাসটুকু পৃথিবীকে দিয়ে গেলেন তিনি। জীবনানন্দ দাশ। শরীরে ব্যান্ডেজ বাঁধা, চোট আঘাতের ছাপ পড়েছে মুখেও। তবুও প্রবলভাবে বাঁচতে চেয়েছিলেন। সমস্ত দুঃখ কাঁধে নিয়ে, নিজের লেখার জগতে অবাধ মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে ঘুরেছেন। চেয়েছেন, সংসারের অবস্থা একটু ভালো হোক, আলো আসুক জীবনে। শেষবেলায় কার্তিকের মরা জ্যোৎস্না কি পড়েছিল তাঁর মুখে?

আরও পড়ুন : সুনীলের মাথায় অন্তর্বাস, প্রফুল্ল চন্দ্রের সামনে আবর্জনা! এই সৌন্দর্যায়ন চেয়েছিল কলকাতা?

১৯৫৪ সালের ১৩ অক্টোবর। বরিশালের জীবনানন্দ তখন একেবারে কলকাতার বাসিন্দা। দেখেছেন বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ। সংসার টালমাটাল, একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেছেন এক দরজা থেকে অন্য দরজায়। অপমান সহ্য করেছেন প্রতিনিয়ত। শেষ কয়েকটা দিন যেন পরিস্থিতি একটু বদেছিল। সেই সময়ের বাংলার তরুণ কবিদের কাছে জীবনানন্দ ছিলেন এক মহাপৃথিবীর যাত্রী। সমসাময়িক কবিদের অনেকেই তাঁকে খুব একটা আমল দেননি। বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের মতো হাতে গোনা কয়েকজনই ছিলেনতাঁর অনুরাগী।

সেই জীবনানন্দ ১৩ অক্টোবর ডাক পেলেন রেডিওতে কবিতাপাঠের জন্য। সেদিন পরিপাটি হয়ে গেলেন সেখানে, পড়লেন ‘মহাজিজ্ঞাসা’ কবিতাটি। নিজের কণ্ঠে পাঠ করা জীবনানন্দের শেষ কবিতা ছিল এটি। কিন্তু কোনও অস্বাভাবিকতা ছিল না। কিন্তু এই কবিতাটাই কেন বাছলেন তিনি?

“শূন্যকে শূন্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে শেষে
কোথায় সে চলে গেল তবে।
কিছু শীত কিছু বায়ু আবছা কিছু আলোর আঘাতে
ক্ষয় পেয়ে চারিদিকে শূন্যের হাতে
নীল নিখিলের কেন্দ্রভার
দান করে অন্তহীন শূন্যতাময় রূপ বুঝি”

কবিতাটির এমন কিছু লাইনের দিকে আজ তাকালে ভারী আশ্চর্য লাগে। জীবনানন্দ মানে এক বিমর্ষ পৃথিবী, ঝরা পালক সেখানে উড়ে বেড়ায় অহরহ – এমন ভাবনাই অধিকাংশ পাঠকের মনে। তাঁর কবিতা হোক বা উপন্যাস, মৃত্যুভাবনা, মৃত্যুচেতনার পাশাপাশি আবহমান বাংলার জীবন-প্রকৃতিও ছুঁয়ে গিয়েছে। ১৯৫৪ সালের ১৩ অক্টোবর, রেডিওয় কবিতাপাঠের সময় কী চলছিল তাঁর মাথায়, জানা নেই। নিয়তিই কি হাত ধরে সামনে তুলে আনল এই লেখা?

ঠিক তার পরের দিন, ১৪ অক্টোবর। ডায়াবেটিস ছিল বলে প্রতিদিন বিকেলে হাঁটতে বেরোতেন জীবনানন্দ দাশ। দেশপ্রিয় পার্কের কাছে রাসবিহারী এভিনিউয়ের রাস্তা ধরেই হাঁটতেন তিনি। সঙ্গী ছিলেন প্রতিবেশী সুবোধ রায়। সেদিনও রুটিন মেনে জীবনানন্দ হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। শরীর খারাপ ছিল বলে একটু দেরি করে বেরোবেন বলে ঠিক করেন সুবোধ রায়। একা একাই নিজের রাস্তা বেছে নেন তিনি। তারপরই ঘটে সেই ‘ঘটনা’। কলকাতা শহর আর কখনও এমন ঘটনার সাক্ষী থাকেনি, ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবে না।

আরও পড়ুন : হাতে পেরেকবিদ্ধ ‘গীতাঞ্জলি’, রবীন্দ্রনাথের ‘বিতর্কিত’ মূর্তিই প্রতিবাদের চিহ্ন হয়ে উঠল বাংলায়

পরবর্তীকালে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাসবিহারী এভিনিউয়ের কাছে রাস্তা পেরনোর সময় বড্ড বেশি অন্যমনস্ক ছিলেন জীবনানন্দ। যেন কোনও চিন্তায় ডুবে আছেন। রুটিনমাফিক হাঁটতে হয় বলে হাঁটছেন। এদিকে খেয়াল করলেন না, তাঁর ঠিক কয়েক হাত দূরেই হাজির হয়েছে একটি চলন্ত ট্রাম। চালক বারবার ঘণ্টা বাজাচ্ছেন, হাঁকডাক করছেন, কিন্তু মানুষটির কোনও সাড়া নেই। শেষমেশ সেই চলন্ত ট্রামের ক্যাচারের নীচেই পড়ে গেলেন জীবনানন্দ দাশ। ব্রেক কষলেও ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। রক্তাক্ত, অজ্ঞান হয়ে পড়া জীবনানন্দকে টেনে বাইরে বের করে আনলেন আশেপাশের মানুষজন। একটা সময় পর চোখ খুললেন। নিজের নাম, ঠিকানা বলে ফের হাঁটতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু পারলেন না। পায়ের হাড় আর আস্ত নেই। বুকের পাঁজরও ক্ষতিগ্রস্ত। চোখ, মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে অনবরত। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হল শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে।

ডাক্তাররা বললেন, শরীরের ভেতরেও অনেক ক্ষতি হয়েছে। রক্ত জমে আছে ফুসফুস, মাংসপেশিতে। পাঁজর ভেঙে গিয়ে ফুসফুসও ক্ষতিগ্রস্ত। ১৪ থেকে ২২ অক্টোবর – এই কয়েকটা দিন চলল যমে-মানুষে প্রবল টানাটানি। যে ঘরে জীবনানন্দকে রাখা হয়েছিল, সেখানেই নাকি এক খুনের আসামিও ছিল। অজস্র পুলিশ সেখানে, তার মধ্যেই প্রলাপ বকে চলেছেন কবি। স্ত্রী লাবণ্য দাশ ও সন্তানদের পাশাপাশি হাসপাতালে বারবার হাজির হচ্ছেন ভূমেন্দ্র গুহ, সঞ্জয় ভট্টাচার্যরা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে শেষের দিকে হাসপাতালে আসাই বন্ধ করে দেন লাবণ্য দাশ।

কিন্তু সবার একটাই বক্তব্য, চিকিৎসা ঠিকমতো হচ্ছে না। এখানেই আসরে নামলেন একজন। ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। একটা সময় জীবনানন্দকে প্রতি মুহূর্তে আক্রমণ করতেন তিনি। তাঁর কবিতাকে চাঁছাছোলা ভাষায় সমালোচনাও করতেন। জীবনানন্দের সমর্থনে যে কয়েকজন কথা বলতেন, তাঁদেরকেও ছাড়তেন না। সেই সজনীকান্ত দাসই যেন হয়ে উঠলেন শেষ মুহূর্তের ত্রাতা। তিনি নিজে এগিয়ে এসে জীবনানন্দের সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত তো করলেনই; সেইসঙ্গে নিজের উদ্যোগে খবর পাঠান তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধানচন্দ্র রায়কে।

আরও পড়ুন : ‘সুনীল-শক্তি, ওঁরাই তো কবি… আমরা কবি নই’! অরুণেশ ঘোষকে যেভাবে চিনেছি চিঠিতে

কিন্তু সেই কাজই সার। চিকিৎসা শুরু হলেও, স্বয়ং জীবনানন্দ যেন অন্য গ্রহের মানুষ হয়ে গিয়েছেন ততক্ষণে। পরবর্তীকালে সঞ্জয় ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন, হাসপাতালে বেশিরভাগ সময়ই অচৈতন্য থাকতেন তিনি। মাঝে মধ্যে সজাগ হয়ে উঠতেন। সেরকমই একটা সময় সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কাছে একটা অনুরোধ জানান জীবনানন্দ। বেশি কিছু না, একটা কমলালেবু খেতে চান তিনি! না, সেই সুযোগ আর হয়নি। ২২ অক্টোবর, রাত প্রায় সাড়ে ১১টা। সমস্ত গণ্ডি পেরিয়ে সত্যিকারের মহাপৃথিবীর পথিক হলেন জীবনানন্দ দাশ।

আজও জীবনানন্দের মৃত্যুদৃশ্য এক অদ্ভুত ঘোর তৈরি করে বাংলায়। ভেবে দেখুন, ট্রামের মতো একটি ধীরগতির যানে চাপা পড়ে মৃত্যু, ব্যাপারটা রহস্যময় তো বটেই। ট্রামের ক্যাচারে পড়ে তার আগেও কেউ মারা যাননি, তার পরেও নয়। জীবনানন্দের মৃত্যুই এক ও একমাত্র ঘটনা। কী করে এমন ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটে? আজও উত্তর নেই এই প্রশ্নের। আর সেই ট্রামটি? নিয়তির অদ্ভুত পরিহাস তাকেও গ্রাস করে নেয়। পরবর্তীকালে সেই ট্রামে কী করে যেন আগুন লেগে যায়। সেই দুর্ঘটনাই শেষ করল কবির ‘ঘাতক’কে। শেষ হল এক ব্যতিক্রমী ঘটনা, প্রতিভার।

More Articles