নির্লিপ্ত মুখে চিতায় ঝাঁপ, বাংলার শেষ সতীদাহের ঘটনা অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেবে

১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর। লর্ড উইলিয়াম বেন্টিক আইনত সতীদাহ প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ওইদিন। কেবলমাত্র ইংরেজদের নেতৃত্বে বর্বরোচিত এ প্রথা রদ হয়েছিল, এমনটা ভেবে বসলে ভুল হবে। ব্রিটিশ সরকারের আইনি সিদ্ধান্ত ছিল রামমোহন রায়--সহ বহু বাঙালির দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল। একটি মানুষের মৃত্যুতে তাঁর জীবিত সহধর্মিনীর সহগমন, আমহার্স্টের স্ত্রীর লেখায়  আমরা সেই নৃশংসতার ছবি পাই।

বাংলার কোনও এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে কলেরায় মৃত্যু হয়েছিল এক যুবকের। তৎকালীন রীতি অনুসারে  গাঁয়ের পাঁচজন মাতব্বর মিলে ঠিক করলেন তাঁর স্ত্রীকে যেতে হবে সহমরণে। নির্ধারিত সময়ও এসে পড়ল। ঢাক ঢোল সহ অন্যান্য বাজনার বেদম হট্টগোল। কৌতূহলী জনতার অন্ত নেই। যেন কোনও আনন্দযজ্ঞ চলছে। এমতাবস্থায় হবু সতীকে বেঁধে ফেলা হল চিতার সঙ্গে। জ্বলে উঠল দাউদাউ আগুন। কিন্তু উদ্যোগী জনতার কোলাহলের মধ্যে কেউ কেউ লক্ষ করলেন যে মেয়েটি চিতার বাঁধন ছাড়িয়ে জঙ্গলের দিকে পালিয়েছেন। সকলের মাথায় হাত। গেল কোথায়? খোঁজ খোঁজ। সমস্ত জঙ্গল চষে ফেলে খুঁজে বের করা হল তাঁকে। তারপর ডিঙিতে চাপিয়ে মাঝ নদীতে এনে ডুবিয়ে দেওয়া হল জলে। মৃত্যু হল তাঁর।

সনাতন ধর্মের এই পাশবিক আচারের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে লড়তে হয়েছিল রামমোহনকে। তাঁর নির্ভীক উদ্যোগের ফলেই সতীদাহকে কেন্দ্র করে প্রশাসনিক চিন্তাভাবনা চালয়েছিলেন ইংরেজরা। তবে প্রথা নিষিদ্ধ হলেও, আগুন যেমন নিভে যাওয়ার আগে ফুঁসে ওঠে শেষবারের মতো, তেমনভাবেই হুগলি জেলায় ধুমধাম করে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলার শেষ সতীদাহ। অবিভক্ত বাংলার একসময়কার ছোটলাট হ্যালিডে সাহেব সেই ভয়ঙ্কর উদযাপনের বর্ণনা লিখে রেখেছেন।

হ্যালিডে তখন হুগলির ম্যাজিস্ট্রেট। দিনকয়েক পরেই ইংরেজ সরকার বলবৎ করবে সতীদাহবিরোধী আইন। এমন সময় তাঁর কানে এল, বাড়ি থেকে কিছু দূরেই নদীর পাড়ে সহমরণে তোলা হবে এক সদ্যবিধবাকে। চিকিৎসা বিভাগের ডাক্তার ওয়াইজ এবং গভর্নর জেনারেলকে সঙ্গী করে কৌতুহলী হ্যালিডে নির্দিষ্ট দিনে হাজির হলেন সেখানে। লোকে লোকারণ্য নদীতট, তিল ধারণের জায়গাটুকুও নেই। একপাশে সাজানো হয়েছে মস্ত চিতা, তার সামনে মাথা নীচু করে বসে আছেন সহমরণ যাত্রী সেই মেয়ে। হ্যালিডে তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলেন তাঁকে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এ যাত্রা ভয়ে পিছিয়ে এলে  সমাজ যে তাঁকে আগাগোড়া একঘরে করে রেখে দেবে তা সে মহিলাও বিলক্ষণ জানতেন। হ্যালিডের দেখাদেখি ততক্ষণে সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন এক পাদ্রী। সদ্য বিধবা মহিলাটিকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, সতীদাহে সম্মত হওয়ার ফলে যে প্রবল শারীরিক কষ্ট তিনি ভোগ করতে চলেছেন, সে বিষয়ে কি তিনি অবগত? খানিকক্ষণ গম্ভীরভাবে  তাকিয়ে থেকে পাশের একজনকে ওই মহিলা বললেন একটি প্রদীপ আনতে। 

আরও পড়ুন-জাহাজে টাটার সহযাত্রী, ভারতের বিজ্ঞান গবেষণার রূপরেখা বদলে দিয়েছিলেন স্বামীজি

সাহেবদের সংশয়মুক্ত করতেই প্রদীপের বন্দোবস্ত। প্রদীপ এল, তাতে আগুন ধরিয়ে তার উপর একটি আঙুল রাখলেন মহিলা। সাহেবরা চোখে বিস্ময় নিয়ে দেখলেন, আঙুলটি পুড়ছে। চামড়ার উপর ফোস্কা পড়ে অবশেষে কালো হয়ে নেতিয়ে পড়ল সেটি। অথচ, ভদ্রমহিলার চোখের পাতা পর্যন্ত কাঁপল না। এবার সাহেবদের দিকে ফিরে একটা অবজ্ঞার হাসি দিলেন তিনি। যেন বললেন, কী হে, লোহার শরীর আমার, আগুনে ব্যাথা লাগে না। বিশ্বাস হল তো এবার?

হ্যালিডে এবং তাঁর সঙ্গীসাথীরা কার্যত হাঁ হয়ে গেলেন। এবার চিতায় ওঠার পালা। একটিমাত্র দেহতেই অবশ্য অগ্নিসংযোগ করা হবে, কারণ তাঁর স্বামী মারা গিয়েছিলেন বিদেশে। মৃত স্বামীর প্রতীকী ভূমিকা পালন করবে তাঁর পরিধেয় কাপড়ের কিছু অংশ। কাঠের উপর আগুন জ্বালানোর প্রস্তুতি শেষ হলে প্রায় চার ফুট সমান চিতাটিকে তিনবার প্রদক্ষিণ তিনি। অবশেষে বৈরাগ্যপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে উঠে পড়লেন তার উপর। তাঁর একমাত্র পুত্রসন্তান হাতে পাটকাঠি নিয়ে চিতার গায়ে ধরিয়ে দিল আগুন। তারপর সোল্লাসে জয়ধ্বনি। জয় সতীর জয়, জয় সতীর জয়। হ্যালিডে পাথরের মূর্তির মতো তাকিয়ে রইলেন। একটি জলজ্যান্ত মানুষ পুড়ছে, অথচ উত্তেজনার লেশমাত্র নেই। নেই কোনও ছটফট। বাতাসে শুধুই পাক খেয়ে যাচ্ছে ধোঁয়া । সেই বিষের বাষ্পে চোখ জ্বালা করে আজও।

More Articles