বোল পাপিহে বোল রে থেকে গাঁটছড়া, লতাকে নিজে হাতে রান্না করে খাওয়াতেন সন্ধ্যার মা...

৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২। গত কয়েকদিন ধরেই উৎকণ্ঠার পারদ ক্রমশ চড়ছিল আপামর ভারতবাসীর। গত রাত্রের মেডিকেল বুলেটিন থেকে জানা গেছে শারীরিক অবস্থা ক্রমেই সংকটজনক হচ্ছে হেমার। কোভিডকালে করোনাসুরের কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন বহু বিশিষ্টজন। তালিকা কি আরো লম্বা হবে? নাকি শেষ পর্যন্ত সকল অসুস্থতাকে জয় করে পূর্বের মতোই গানের সরনিতে ফিরবেন তিনি? গানই তো আমাদের বাঁচতে শেখায়, স্বপ্ন দেখতে শেখায় দিনবদলের, হাল না ছেড়ে কন্ঠ ছাড়া গল্প বলে - অথচ সেই গানই যখন হয়ে পড়ে অভিভাবকশূন্য তখন? তাই সমগ্র ভারতবাসীর প্রার্থনা একটাই - সুস্থ হয়ে উঠুন তিনি। মৃত্যুর তালিকা এই করোনাকালে যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর না হয়। না, সমগ্র ভারতবাসীর সমবেত প্রার্থনাও পারেনি শেষ পর্যন্ত হেমার চলে যাওয়াকে আটকাতে। ওই যে বিশ্বকবি বহুদিন আগেই বলে গেছেন না - " চুরিবিদ্যাতে যম পাকা, দামি জিনিসের পরেই তার লোভ।" ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, সকাল ৮.১২ মিনিট নাগাদ মুম্বাইয়ের ব্রিচক্যান্ডি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন হেমা ওরফে লতা মঙ্গেশকর।

না, হেমা নাম শুনে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। প্রথম জীবনে লতা মঙ্গেশকরের নাম ছিল হেমা। জীবনের প্রথম দিন থেকেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছিল একরত্তি হেমা। পিতা দীননাথ মঙ্গেশকার ছিলেন নাট্যাভিনেতা এবং সঙ্গীতজ্ঞ। দীননাথই বোধহয় সর্বপ্রথম হেমার মধ্যে বপন করে দিয়েছিলেন সংগীতের প্রতি অনুরাগের বীজ। যদিও ক্লাসিকাল ব্যতীত অন্যান্য গানের প্রতি খুব একটা সহানুভূতি ছিল না দীননাথের। সেই ছোট্ট বয়স থেকেই কে এল সায়গলের ফ্যান ছিলেন হেমা। ছোট্ট হেমা কিভাবে পরিণত হলেন লতা মঙ্গেশকরে? বাবা দীননাথ পণ্ডিতের ' ভাও বন্ধন ' নাটকের লতিকা চরিত্রটি ছিল হেমার খুব প্রিয়। চরিত্রের নামানুসারেই হেমা পরিবর্তিত হয়ে যান লতাতে। শুধু তাই নয়, পদবিও পরিবর্তিত হয়েছিল লতার। বাবা দীননাথ পদবী পরিবর্তন করে হার্দিকর থেকে হয়ে যান মঙ্গেশকর।

আরও পড়ুন-বাংলা ছবির গান থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় রামধনুর মতো ছড়িয়ে সুরের আকাশে

সালটা ১৯৪২। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের রেশ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দেশে। প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ ইংরেজ বিরোধী বিদ্রোহে যোগ দিচ্ছেন। উল্টোদিকে ব্রিটিশ সরকারও বিপ্লবীদের কণ্ঠরোধের জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। নির্মম শাসনের মাত্রা প্রতিদিনই বাড়ছে। ইংরেজ সরকার প্রতিমুহূর্তে বুঝিয়ে দিতে চাই তারা শাসক, ভারতবাসী শাসিত। সমগ্র দেশ যখন এই অরাজকতার সম্মুখীন তখনই গান হয়ে উঠেছিল ভারতবাসীর অন্যতম আশ্রয়। আর ঠিক এই সময়েই ইন্দোরের এক কিশোরী সুরের মূর্ছনায় আপামর ভারতবাসীকে সম্মোহিত করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সকলের অগোচরে। তবে লতা মঙ্গেশকরকেও গানের জগতে অতিক্রম করতে হয়েছে বহু চড়াই-উৎরাই পথ।১৮৪২ সালে লতা ' কিতি হাসান' নামক একটি মারাঠি সিনেমায় প্রথম প্লে ব্যাক করেন। যদিও পরবর্তী সময়ে ' নাচু ইয়ে গাধে, খেলু শারি মারি ' গানটি ছেঁটে ফেলা হয় সিনেমা থেকে। সঙ্গীত জীবনের শুরুতেই এই ঘটনা লতার জন্য যথেষ্ট যন্ত্রণার ছিল।

গানের জগতে যখন প্রায় মধ্যগগনে বিচরণ করছেন লতা, তখন এই গানের জন্যই পারিবারিক সম্পর্কে চিড় ধরেছে তার। সংগীতের মঞ্চে লতার তুলনায় আশা তখন বেশ খানিকটা ব্যাকফুটে। লতার উত্থান ঘটেছে একপ্রকার উল্কার গতিতে। তার এই উন্নতি চক্ষুশূল হয়ে ওঠে ওঠে আশার স্বামী গণপত রাওয়ের। তিনি বিশ্বাস করতেন লতার কারণেই বেশ কিছু কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন আশা। গণপত আশাকে লতার সঙ্গে মেলামেশা করতেও নিষেধ করেন। যদিও এই মান-অভিমানের পর্ব বেশিদিন চলেনি। রাহুল দেববর্মনের হাত ধরে অভিমানের পালা সাঙ্গ হল গানের জগতের দুই মহারথীর।

৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২। ভারতীয় সঙ্গীত জগতের কাছে এক কালো দিন। আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন সুরের জগতে জাদুকরী প্রতিভার অধিকারী লতা মঙ্গেশকর। ঠিক সেই দিনেরই পুনরাবৃত্তি যেন ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২। মাঝে মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যবধান। আরও একবার শোকসাগরে ডুব দিল আসমুদ্রহিমাচল। চলে গেলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সংগীত জগতে রেখে গেলেন এক অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর।

আরও পড়ুন-আজীবন সাদা শাড়ি, গলায় আঁচল, কেন এই পোশাক বেছে নিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর

সালটা ১৯৪৫। ইংরেজদের নাগপাশে ভারতের আম - আদমির জীবন হয়ে উঠেছে নরক। বছর দুই আগে থেকেই বাংলার বুকে শুরু হয়েছে তীব্র খাদ্য সংকট, যা কালে কালান্তরে পরিণত হয়েছে ভয়াল প্রাণঘাতী দুর্ভিক্ষে। অসহায় নারী পুরুষ বৃদ্ধ শিশুর মৃতদেহের সঙ্গে ক্রমেই পরিচিত হয়ে উঠেছে বঙ্গবাসী। জগৎ জুড়ে যেন একটাই রব - ফ্যান দাও ফ্যান। জঠরাগ্নির দহনজ্বালা থেকে পরিত্রাণ পেতে দলে দলে মানুষ ছুটছেন শহরে। এমন সময় সুদূর কলম্বিয়া থেকে প্রকাশ পেল এক ক্ষণজন্মা প্রতিভার গানের প্রথম রেকর্ড - " তুমি ফিরায়ে দিয়াছো।" সেদিন বড় কোন সঙ্গীত সমালোচকও কি ভাবতে পেরেছিলেন সন্ধ্যার গান দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের কাছে হয়ে উঠবে ' পিচগলা রোদ্দুরে বৃষ্টির বিশ্বাস।" না, এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সন্ধ্যাকে।' অঞ্জনগড়' ছবিতে ডেবিউয়ের মধ্যে দিয়ে যে জয়যাত্রা শুরু তার চলমান ছিল আজীবন। লতার সঙ্গেও বেশ কিছু স্মৃতি মানসপটে আঁকা হয়েছিল সন্ধ্যার।' তারানা' ছবিতে জুটি বাঁধলেন লতা এবং সন্ধ্যা। তারপর যত দিন গেছে দুই সুরসাম্রাজ্ঞী দুজনকে চিনে নিয়েছেন আরো ঘনিষ্ঠভাবে।' বোল পাপিহে বোল রে' - গানের মধ্য দিয়ে লতা- সন্ধ্যার যুগলবন্দি শুরু, পরবর্তী সময়ে এই সম্পর্কের উষ্ণতা পৌঁছে গিয়েছিল গীতশ্রী রান্নাঘরেও। দু'জনের সাক্ষাতে যেমন উঠে আসত বহু বন্ধুর পথ পেরিয়ে আসার গল্প,তেমনই লতাকে প্রায়ই রান্না করে খাওয়াতেন সন্ধ্যার মা। গানে গল্পে ভরে উঠত ইমন সন্ধ্যাগুলি।

১৯৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আলাউদ্দিন খাঁ, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত বিচারকের সামনে পরীক্ষা দিয়ে জিতে নিয়েছিলেন গীতশ্রীর মতো সম্মান। লতার চলে যাওয়া কি কোথাও একা করে দিয়েছিল তাঁকে? উত্তর অমিল। মৃত্যুতেও যেন এক হয়ে গেলেন সঙ্গীত জগতের দুই দিকপাল। হয়তো দর্শকদের মনে চিরদিন অনুরণন তুলে যাবে 'বোল পাপিহে বোল রে।' কারণ শিল্পীর যে মৃত্যু নেই। তারা অমর।

More Articles