মাছওয়ালা, রংমিস্ত্রিদের প্রার্থী করছে বামেরা, স্বাভাবিকতার ঢক্কানিনাদে কি চিঁড়ে ভিজবে

সামাজিক গণমাধ্যমে বামপন্থী কর্মী-সমর্থকরা আসন্ন পৌরনির্বাচনে তাঁদের দলগুলি থেকে বেশ কিছু খেটে খাওয়া মানুষকে প্রার্থী করার বিষয়টি খুব গুরুত্ব সহকারে প্রচার করছে। তাঁদের সেইসব প্রচার থেকে জানতে পারা যাচ্ছে যে, বাজারে মাছ বিক্রি করেন, রং মিস্ত্রির কাজ করেন - তরুণ প্রজন্মের এমন কিছু মানুষকে বামপন্থী দলগুলো আসন্ন পুরনির্বাচনে তাঁদের প্রার্থী করেছেন। তার পাশাপাশি কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে নোয়াপাড়ায় এক যুবক চিকিৎসাব্যবস্থার গাফিলতি শিকার হয়ে  অকালে মারা যান। তাঁর মাকে এবার বামপন্থীরা আসন্ন পুরনির্বাচনে প্রার্থী করেছেন।

ব্র্যান্ডেড শার্ট, প্যান্ট, ঘড়ি, চশমার পাঁচমিশালি প্রার্থীদের তুলনায় এইসব প্রার্থীদের ঘিরে স্বাভাবিক ভাবেই সব মহলে একটা উৎসাহ তৈরি হয়েছে।  বামপন্থীরা দীর্ঘদিন এ রাজ্যে শাসন ক্ষমতায় ছিল। ছয়, সাত , এমনকী আটের দশকে ও শ্রমিক-কৃষক মেহনতী মানুষের ভেতর থেকে প্রার্থী করার যে প্রবণতা বামপন্থীদের ছিল। সেই প্রবণতার ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মতোই নেতা বা নেত্রীর সন্তান-সন্ততিদের ধরে এনে নেতা বানিয়ে দেওয়া এবং তাদের প্রার্থী করার রেওয়াজ বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাড়তে থাকে।

নেতার ছেলে বলে যে তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না, নেতা হতে পারবেন না বা প্রার্থী হতে পারবেন না-এমন কথা একটিবারের জন্য বলা হচ্ছে না।নেতার ছেলে যদি একটি রাজনৈতিক পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে, গণ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আসেন, নেতা হন, বা নির্বাচনে প্রার্থী হন তাহলে তো আপত্তির কিছু থাকতে পারে না। আর তার থেকে ভালো কিছু হতেও  পারে না। কিন্তু তেমনটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘটছে না। বুর্জোয়া রাজনীতিতে যেমন দেখা যায়, নেতার মৃত্যুর পর তার ছেলেমেয়েকে প্রার্থী করে একটা আবেগের পরিবেশ তৈরি করা এবং সেই আবেগকে ব্যবহার করে ভোটে জেতা-তেমনটাই কিন্তু বামপন্থীদের ক্ষেত্রেও অনেক সময়েই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

তাই মাছ বিক্রেতা বা সবজিবিক্রেতা, রংমিস্ত্রি --এঁরা যে প্রার্থী হতে পারেন, এটাই হয়তো এখন একটা অংশের মানুষ, যাঁরা নিজেদের বামপন্থী বলে প্রচার করতে ভালোবাসেন ,তাঁদের কাছে একটা ব্যতিক্রমী কার্যক্রম বলে মনে হচ্ছে। আসলে তাঁরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন, শিক্ষিত অভিজাত ও মধ্যবিত্তের ভেতর থেকে উঠে আসা বামপন্থীদেরই প্রার্থী হিসেবে  দেখতে।

বামপন্থীরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে অনেক ক্ষেত্রেই এমন একটা অভ্যস্ত ব্যবস্থা চালু করে দিয়েছিলেন যাতে, তাঁদের কর্মী সমর্থকরা ভুলে যেতেও বসেছিলেন, বামপন্থী রাজনৈতিক দল হল শ্রমিক-কৃষক - মেহনতি জনতার দল। অভিজাত, মধ্যবিত্ত সেখানে থাকবেন না কেন ,অবশ্যই থাকবেন, কিন্তু নেতৃত্বে কেবলমাত্র অভিজাত মানুষেরা,  কেবলমাত্র মধ্যবিত্ত মানুষেরা -  এটা কখনও বামপন্থী রাজনৈতিক দলের কর্মপদ্ধতির অঙ্গ হতে পারে না। বাংলা তথা ভারতের বামপন্থী রাজনীতির উদ্ভবের সময়কাল থেকে অভিযাত্রার বিকাশের ক্ষেত্রে ,অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন জ্যোতি বসু, সৈয়দ মনসুর  হাবিবুল্লাহ,  স্নেহাংশুকান্ত আচার্য- এঁদের নাম এই প্রসঙ্গে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করতে হয়। এইসব মানুষেরা কখনো আভিজাত্যে নিজেদের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনাকে আবদ্ধ রাখেননি।়

আরও পড়ুন-বিদায়ের বিষাদে ফিরে দেখা ভারতের নাইটিঙ্গলের জীবন

শ্রমিক মেহনতি জনতার অংশ হয়ে উঠতে এদের  উদাহরণ  মানুষ বাংলা রাজনীতিতে দেখেছেন। কিন্তু এঁরা  আজকের প্রজন্মের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষজনের কাছে প্রায় অজানাই থেকে গেছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় সৈয়দ মনসুর হাবিবউল্লাহ, হারাধন রায়- এঁদের মত কৃষক, শ্রমিক নেতার জীবনাদর্শকে পরবর্তীকালে বামপন্থীরা তাঁদের আলাপ-আলোচনায় সেভাবে তুলে ধরেন না। মেলে ধরেন না ।ফলে নতুন প্রজন্মের মানুষ যাঁরা রাজনীতিতে আসছেন ,তাঁদের ক্ষেত্রেও এই সমস্ত মানুষদের জীবন চর্চা, জীবনসংগ্রাম জানবার সুযোগ সেভাবে থাকে না  ।তাই হয়তো আটের দশকে র শেষ দিক থেকেই বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষজন, তাঁদের দল এবং দলীয় প্রার্থী হিসেবে অভিজাত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা ব্যক্তিদের দেখতে বেশিরভাগ সময় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কৃষক আন্দোলন থেকে উঠে এসে কৃষক নেতৃত্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, শ্রমিক আন্দোলন থেকে উঠে এসে সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা -এই ধারাগুলি বামপন্থীদের মধ্যে জন্ম লগ্নে ছিল ।ক্ষমতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে নেতৃত্ব তৈরি র সেই ঐওইহ্য বামপন্থীরা রক্ষা করেননি। ফলে মধ্যবিত্ত অংশের ভেতর থেকে ধরে এনে কাউকে শ্রমিকনেতা করে দেওয়া হয়েছিল। কাউকে করে দেওয়া হয়েছিল কৃষকনেতা।

স্বভাবতই কৃষক ,শ্রমিক মেহনতি জনতার অংশ থেকে একদম বিচ্ছিন্ন এইসব মানুষরা এঁদের নেতা হয়ে কখনোই কোনো অবস্থাতে শ্রমিক-কৃষক মেহেনতি জনতা অংশ হয়ে যেতে পারেননি ।ভাবলে অবাক হতে হয় ,দক্ষিণবঙ্গ থেকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষদের তুলে এনে উত্তরবঙ্গের চা-শ্রমিক এলাকার নেতা বানানো হয়েছিল  চা শ্রমিকদের মধ্যে সেইসব চাপিয়ে দেওয়া নেতারা কখনোই রাজনৈতিক মতাদর্শের বিস্তারের ক্ষেত্রে এঁদের কাছে আদর্শ  হতে পারেননি ।মতাদর্শের প্রচারের ক্ষেত্রেও  একপা অগ্রসর হতে পারেননি। তাই হয়তো আজকের প্রজন্মের বামপন্থী কর্মী, সমর্থকদের কাছে এই যে বাজারের মাছবিক্রেতা, রংমিস্ত্রিদের  প্রার্থী করার বিষয়টা এত অভিনব বলে মনে হচ্ছে। একটু ব্যতিক্রমী বলে মনে হচ্ছে।

আর বামপন্থীদের ক্ষেত্রে যেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়, সেই স্বাভাবিক বিষয়টাকেই ব্যতিক্রমী  মনে করে ,তারা প্রচার করছেন। সেখানে থেকেই বামপন্থীদের অনন্যতা তারা দেখাতে চাইছেন ।শ্রমিক-কৃষক মেহনতি জনতার বাইরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভেতর থেকে বামপন্থী নেতৃত্ব তৈরি হবে, তাঁদেরকে প্রার্থী করা হবে, তাঁদেরকে সংসদীয় গণতন্ত্রের বিভিন্ন পর্যায় বসানো হবে, এটাই তো বামপন্থীদের  মতাদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়। আজকের বামপন্থী কর্মী-সমর্থকদের কে বোঝাবে সে কথা?  বিড়ালের গলায় ঘণ্টা কে বাঁধবে?

আরও পড়ুন-আজও সুরের মসনদের রানি লতা মঙ্গেশকর

প্রথম  বামফ্রন্ট সরকার, সেখানে শ্রমিক, কৃষক, মেহনতী জনতার ভেতর থেকে উঠে আসা ,আভিজাত্যের গৌরবহীন, অনেক ক্ষেত্রে প্রথাগত শিক্ষার সেভাবে সুযোগ না পাওয়া মানুষজন যে সাফল্যের সঙ্গে সরকার পরিচালনা করেছিলেন, আমলাতন্ত্রের সঙ্গে মোকাবিলা করেছিলেন, সেটা কি পরবর্তীকালে আমরা মধ্যবিত্তের নেতৃত্বদানকারী সমাজ থেকে উঠে এসে  সরকারের মন্ত্রী হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে পেয়েছি?  অনেকে হয়তো এই যুক্তির উপস্থাপনা করতে পারেন যে প্রকৃতির নিয়মে কৃষ্ণপদ ঘোষ,  প্রভাস রায়, সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ, মহম্মদ আমিন, যতীন চক্রবর্তী, কানাইলাল ভট্টাচার্য, বিনয়কৃষ্ণ চৌধুরীর মতো মানুষ যখন বিদায় নিয়েছেন, তখন তাঁদের শূন্যস্থানগুলো শূন্য থাকতে পারে না। তাই তাঁদের জায়গায় পরবর্তী প্রজন্মের ব্যক্তিত্বদের নিয়ে আসা হয়েছে প্রশাসনিক পদে।

এখানে প্রশ্ন হল বিনয় চৌধুরীর মতো, মনসুর হাবিবুল্লার মতো কৃষক নেতাদের পরবর্তী প্রজন্মকে  একবারও কি বামপন্থী দলগুলো, শ্রমিক কৃষক মেহেনতি জনতা ভেতর থেকে নেতৃত্ব তুলে আনার কথা ভেবেছেন?  আটের  দশকের মধ্যবর্তী সময় থেকে, বামপন্থী রাজনীতি ,দল, সরকার ,সংসদীয় রাজনীতির তাই  মেহেনতি জনতা নেতৃত্বদানকারী হিসেবে কি আমরা সেভাবে দেখেছি এই অংশের নতুন প্রজন্মের মানুষদের?

মৃত্যুজনিত সহানুভূতিকে উপকরণ হিসেবে সামনে তুলে ধরে, ভোট রাজনীতিতে যাওয়ার বিরোধিতা বামপন্থীরা চিরকাল করে এসেছে। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর যে সহানুভূতির রাজনীতি তৈরি হয়েছিল, সেই রাজনৈতিক পরিবেশকে একটা আশাতীত সাফল্যের সামনে এনে দাড় করিয়ে দিয়েছিল কংগ্রেসকে। সেই সময় জ্যোতি বসু অসাধারণ রাজনৈতিক মূল্যবান করে বলেছিলেন;  জীবিত ইন্দিরার  থেকে মৃত ইন্দিরা অনেক বেশি শক্তিশালী। তবে বামপন্থীরা যে কখনো মৃত্যুকে ঘিরে রাজনীতি করেননি ,তা যদি আমরা খাদ্য আন্দোলন জনিত সময়কাল এবং খাদ্য আন্দোলনের শহিদ ব্যক্তিত্বদের ঘিরে আলাপ-আলোচনা করি ,তবে তেমন দাবি করা যায় না।

যদিও বামপন্থীরা চিরকাল মৃত্যু বা মৃত ব্যক্তিত্বকে  ঘিরে নির্বাচনী সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া নিয়ে বিরোধী রাজনীতিকদের কখনো রাজনৈতিক, কখনো ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন। মৃত্যু  রাজনীতি শব্দটি বামপন্থীদের নির্বাচনী সংগ্রামের ক্ষেত্রে বিরোধীদের আক্রমণের সময় বহুল ব্যবহৃত হতে আমরা দেখেছি। সেই বামপন্থীরাই যখন কোভিদে মৃত এক যুবকের মাকে প্রার্থী করে ,মায়ের  সন্তানহারা হওয়ার বেদনাকে ব্যবহার করে, ভোটের রাজনীতি অবতীর্ণ হয়েছেন,  তখন একটু আমাদের অবাক হয়ে যেতে হয়।

এমন নয় সেই মৃত ব্যক্তির মা একজন পরিচিত রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে এলাকায় দীর্ঘদিন কর্মরত রয়েছেন  সেই মৃত যুবকটিও প্রত্যক্ষ রাজনীতি করতো এমন টা শোনা যায়নি। তাহলে কেন মৃত্যুর দুঃখজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভোটে ছেতার  জন্য তাঁর মাকে প্রার্থী করা হলো?  কোভিড যুদ্ধে হেরে যাওয়া কোন ব্যক্তির আত্মীয়-পরিজনকে প্রার্থী করা যাবে না, একথা একটিবারের জন্য বলা হচ্ছে না  কিন্তু সেই মৃত্যুকে কেন ভোটে জেতার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, প্রশ্নটা এখানেই যে মৃত যুবকের মা-কে  প্রার্থী করা হয়েছে, তাঁকে সাধারণ রাজনৈতিক নিয়ম অনুযায়ী প্রচারে নিয়ে আসা যায়, কিন্তু তাঁর সন্তান হারানোর যন্ত্রণা কেন বামপন্থীরা ভোট রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করছেন? 

তাহলে কি বামপন্থী রাজনীতিকরা নিজেদের যে একটা আলাদা ধরনের রাজনৈতিক ঘরানার  কথা বলে থাকেন ,সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাঁরা অনেকটা সরে এসেছেন? তাহলে কি এখন আর দশটা বাজার চলতি রাজনীতিকদের মতই নানা ধরনের আবেগ কে ব্যবহার করে ,ভোট বৈতরণী পার হওয়া তাদের একমাত্র রাজনৈতিক কাজ বলে মনে করতে শুরু করেছেন?  নাকি নির্বাচনী সংগ্রামে জিতে  আসবার জন্য রাজনৈতিক কার্যক্রমের  ভেতর দিয়ে উঠে আসা মানুষজন এখন প্রায় বামপন্থী শিবিরে নেই?

তাই এইভাবে যেটা বামপন্থীদের পক্ষে অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল, সেটাকে একটা ব্যতিক্রমী বলে দেখানোর চেষ্টা তাঁদের ভেতরে এত তীব্রভাবে উঠে আসছে?  ভোটসর্বস্ব  বামপন্থা কতখানি বামপন্থী আন্দোলনের শক্তি জোগাবে, সেটা আগামী দিনে বলবে। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতির মধ্যে দিয়ে না গিয়ে, কেবলমাত্র ভোটে জেতাকেই যদি রাজনীতির একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে ধরা হয়, তাহলে কি করে বামপন্থীরা আর ব্যতিক্রমী রাজনীতিক হিসেবে আগামী দিনে দিশা জোগাবেন?

More Articles