মধুস্মৃতির ছোটবেলাগুলি চলে গেল নারায়ণ দেবনাথ সঙ্গে, নন্টে-ফন্টে-কেল্টুদের আজ চোখে জল

হাওড়ার শিবপুর রোডের উপরের ছোট্ট বাড়ি। সামনে গলিতে ১৯৬০-এর দশকের বিকেলবেলার হুটোপুটি। হাফপ্যান্ট বেলার বাচ্চারা দৌরাত্ম্যে মশগুল, এ তার পিছনে লাগছে, একজন অন্য জনের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে ময়দান ছেড়ে পালাচ্ছে। এই পালানোর মধ্যে যে স্নেহের গন্ধ, যে নিপাট কৈশোরের ঘ্রাণ তা কিছুকাল পরেই উঠে আসবে কাগজে। সাদার উপর কালো কালিতে তারা হয়ে উঠবে আমাদের কিশোরবেলার বন্ধু। কারও নাম হবে হাঁদা, অবধারিত ভাবে যার জ্বালানিতে তিষ্ঠোতে পারবে না ভোঁদার মতো বাচ্চারা। কারও নাম হবে কেল্টু, নন্টে আর ফন্টেরা মিলে যাকে নাস্তানাবুদ করে রাখবে! কেউ কেউ হয়ে উঠবে চওড়া ছাতির মধ্যবিত্ত সুপারহিরো বাঁটুল। তারপর এক শীতের সকালে গলির সেই চরিত্রদের সঙ্গে করে চলে যাবেন নারায়ণ দেবনাথ। পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে কমিকসের নেশায় বাংলার কিশোরদের যিনি বড়ো করেছেন আবার সময়ে অসময়ে বড়ো হতেই দেননি কখনও। ৯৭ বছর বয়সে সেই শিল্পী আস্ত একটা ছোটবেলার গন্ধ নিয়ে চলে গেলেন। সঙ্গে যাবে কে? সঙ্গে যাচ্ছে বাহাদুর বেড়াল, কোমর বেঁধেছে! সঙ্গে যাচ্ছেন সুপারিন্টেন্ড্যান্ট স্যার, পিসেমশাই। শয়তানি ফেলে চলে যাচ্ছে কেল্টুদাও। এই শীতে গোলাপি স্যান্ডো আর কালো হাফপ্যান্টে বাঁটুল শিবপুর পেরিয়ে, গঙ্গা পেরিয়ে, বইয়ের তাক পেরিয়ে, বাঙালির কমিকস্ প্রেম পেরিয়ে চলে যাচ্ছে।

মার্ভেল বা ডিসি’র ঝকমকে সুপারহিরোদের মতো বা মিকি, টম, জেরি, ডোনাল্ড ডাকদের সঙ্গে সেই ষাটের দশকের বাংলার ভাব জমাতে অসুবিধা হওয়ারই কথা। টিনটিনকে পর্যন্ত বাঙালি পাড়ায় এনে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচে বসিয়ে দিতে পারলেই শান্তি। বাঙালির নিজস্ব কিছু চরিত্র দরকার ছিল, জাতে বাঙালি, মেধায় বাঙালি, আবার ভেবলে যাওয়াতেও বাঙালি। বাবার সোনারূপোর দোকানে বসে পাড়ার বিচ্ছু বাচ্চাদের দেখতে দেখতে হাঁদা আর ভোঁদার গল্পের জন্ম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আর্ট কলেজে পড়াশোনা করছেন নারায়ণ দেবনাথ। শেষ বছরের পরীক্ষাটা আর দিলেন না। তার বদলে বেশ কয়েক বছর কাজ করলেন বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী সংস্থায়, তৈরি করলেন সিনেমার স্লাইড, লোগোর নকশা করলেন। তারপর ১৯৫০ সালে দেব সাহিত্য কুটিরের সঙ্গে আলাপ এক বন্ধুর মাধ্যমেই। শিল্পী প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বোলতা ছদ্মনামে বা ছদ্মছবিতেই বলা যায়, কিছু কমিকসের কাজ করছেন। এখানেই প্রথম ইলাস্ট্রেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন নারায়ণ দেবনাথ। ১৯৬২ সালে প্রথম জন্ম হাঁদা-ভোঁদার, শুকতারা পত্রিকায়। পেনসিল আর কালিতে দুই কিশোর হাঁদারাম গড়গড়ি আর ভোঁদা পাকড়াশি আর তাঁদের পিসেমশাই বেচারাম বক্সীর গল্প জনপ্রিয়তার তুঙ্গ স্পর্শ করে মাসিক শুকতারায় নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। বাঙালির প্রথম নিজস্ব কমিক চরিত্রের প্রথম গল্পের বিষয়টিই ছিল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ! একটা চরিত্রকে তৈরি করতে তন্ন তন্ন করে রেফারেন্স খুঁজেছেন শিল্পী। রেফারেন্স খুঁজতে খুঁজতে কলেজস্ট্রিটের রাস্তাতেই জন্ম নেয় নতুন চরিত্র।

১৯৬৫ সালে বাংলায় ঢুকে পড়ে আক্ষরিক ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতির সৎ মধ্যবিত্ত বাঙালি সুপারহিরো। ম্যান্ড্রেক, ব্যাটম্যান, সুপারম্যানদের অপার্থিব ক্ষমতার পাশে বিশাল চওড়া বুক, ততটাই সরু কোমর, গোলাপি স্যান্ডো গেঞ্জি আর কালো হাফপ্যান্টের সুপারহিরো বাঁটুল দি গ্রেট। বাঁটুল যে সময় বাংলায় আসে, ভারতের বিশেষ করে বাংলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অস্থির। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আবহে প্রকাশক সম্পাদকদের আর্জিতে নারায়ণ দেবনাথের বাঁটুল তখন ধ্বংস করছে যুদ্ধের ট্যাঙ্কার, যুদ্ধবিমান গুঁড়িয়ে দিচ্ছে নিমেষে। শত্রুপক্ষের কোনও গুলিই বাঁটুলের ছাতি ভেদ করতে পারে না। যে ছাতিতে আটকে রয়েছে একাধিক প্রজন্মের কৈশোর, একাধিক প্রজন্মের মূল্যবোধ, একাধিক প্রজন্মের মানুষ হয়ে ওঠার গল্প।

১৯৬৯-এ হাঁদা-ভোঁদার মতোই দুই চরিত্র নন্টে ফন্টের জন্ম। কিশোর ভারতী পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশ হতে হতেই নন্টেফন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাদের হস্টেল জীবন। হস্টেলে টিকে থাকার রাজনীতি, সুপারিন্টেন্ড্যান্ট স্যার আর ঠাকুরের সঙ্গে বোঝাপড়া। বাড়ির আরাম পেরিয়ে যারা হস্টেল বা মেসের ঘুপচিতে গিয়েছে বাঙলার সেই সমস্ত পড়ুয়াদের কাছে নন্টে-ফন্টের নস্টালজিয়া কোনও দিন বুড়ো হতেই পারে না। কমিকসের মূলে কি নীতিশীক্ষাই প্রবল নয়? কেল্টুদাদের শয়তানি, যে কেল্টু কখনও জেতে না,  হাঁদা বারে বারে ভোঁদাকে বিরক্ত করতে চেয়ে যে নিজেই অপদস্থ হয় এর মাঝে কি কিশোরবেলার ছানাপোনাদের কোনও মূল্যবোধের গল্প নেই? আছে কী না নিশ্চিতভাবে হয়তো জানতেন না নারায়ণ দেবনাথও। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি কেবল বাচ্চাদের দেখাতে চেয়েছিলাম জয় পেতে হলে তোমাকে ভোঁদার মতো ভালো এবং স্মার্ট হতে হবে। হাঁদা যে জিতেছে এমন গল্পও রয়েছে অনেক। কিন্তু কখনই তা ভোঁদার ক্ষতি করে নয়।”

আরও পড়ুন-সত্যজিতের ছবি থেকে হালের দেবদাস, প্রতিটি মুদ্রায় রয়ে গেলেন বিরজু মহারাজ

এই চরিত্রের পাশাপাশিই বাহাদুর বেড়াল, ডানপিটে খাঁদু আর তার কেমিক্যাল দাদু, সুটকি-মুটকি, পেটুক মাস্টার বটুকলালের মতো চরিত্রদের এনেছেন নারায়ণ দেবনাথ। কিশোর ভারতীতে গোয়েন্দা গল্প ব্ল্যাক ডায়মন্ড রহস্য এবং গোয়েন্দা ইন্দ্রজিৎ রায় প্রকাশ পায় ১৯৭০ সালে। জন্মশতবর্ষে রবিঠাকুরের ছোটোবেলা নিয়ে বিমল ঘোষের রবি ছবির ইলাস্ট্রেশনের কাজ করেছিলেন তিনি। স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে রাজার রাজার ইলাস্ট্রেশনের নেপথ্যেও এই শিল্পী। বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসের ইলাস্ট্রেশন ‘চিত্রে দুর্গেশনন্দিনী’ দিয়ে বাংলায় গ্রাফিক নভেলের কাজে এক অন্য ঘরানার জন্ম দিয়েছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। 

দীর্ঘকাল রোগভোগের পরে বাঙালি কমিকসের সম্রাটের সফর শেষ হল ১৮ জানুয়ারির সকালে। সম্প্রতি হাসপাতালেই নারায়ণ দেবনাথের হাতে তুলে দেওয়া হয় পদ্মশ্রী সম্মান। এর আগে ২০১৩ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার এবং বঙ্গ বিভূষণেও সম্মানিত হয়েছেন কমিকস শিল্পী। চেয়েছিলেন, তাঁর চলে যাওয়ার পরে আর যেন বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা নন্টে-ফন্টেদের গল্প অন্য কেউ না লেখেন, অন্য কোনও শিল্পী যেন এই চরিত্রদের আর না আঁকেন। নিজের তৈরি চরিত্রদের সঙ্গে করে, একটা আস্ত ছোটোবেলাকে নিয়ে চলে গেলেন নারায়ণ দেবনাথ, এই শীতে।

More Articles