সন্ধ্যার পর যেন নিকষ কালো রাত্রি– বাপ্পি লাহিড়িও চললেন, রইল পড়ে অতলান্ত কীর্তি...

কপালের একপাশে রক্ত। মায়ের ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতি। চোখে জল। বুকে অবরুদ্ধ বেদনার উথাল-পাথাল লহমায় তরঙ্গের পর তরঙ্গ তোলে হাতের ইলেকট্রিক গিটারে। সেই বিখ্যাত সাজ। সাদা কস্টিউমের ওপর একটা স্টোল। মিঠুন এগিয়ে যাচ্ছেন জনতার দিকে। “ইয়াআআদ আ রহা হ্যায় তেরা প্যায়ার”। এই গানে বাপ্পি লাহিড়ি ছাড়া আর কারোর গলা কল্পনা করাও মুশকিল। লক্ষ লক্ষ ভারতীয়র মনে এই ছবি গেঁথে গিয়েছিল তিরের মতো। এলপ্রিস প্রেসলির নাচ ও পোশাকের স্টাইলে ডিস্কোর ভারতীয় উপস্থাপন। সেই শুরু। বিসর্জনের উল্লাস থেকে বাঙালির নিভৃত ড্রয়িং রুমের কোণায় কোণায় একসময় এইসব গান বাজত। আজও পাড়ার মোড়ে, গলির পানবিড়ির দোকানে, সেলুনে, চায়ের দোকানে শোনা যায় অবিস্মরণীয় ডিস্কো ড্যান্সারের গানগুলি। ‘জিমি জিমি জিমি’, কোই ইয়াহাঁ আহা নাচে নাচে আউয়া আউয়া”, “জরা মুঢ়কে” একের পর এক হিট। এই ধরনের গান তখন শুধু বাংলা কেন, বেশিরভাগ ভারতীয়র কাছেই ছিল নতুন, অজানা। অথচ শ্রোতার কাছে অচেনা সেই সুর, লয়, কথায় একের পর এক হিট দেওয়া মামুলি ব্যাপার নয়।

বাপ্পি লাহিড়ি। ভারতীয় প্লে-ব্যাক সঙ্গীতের জগতের অন্যতম সুরকার হিসেবে খ্যাত এই ব্যক্তিত্বের জন্ম ১৯৫২ সালের ২৭ নভেম্বর। বাবা-মায়ের রাখা নাম অলোকেশ লাহিড়ী। বাবা অপরেশ এবং মা বাঁশরী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং শ্যামাসঙ্গীত গাইতেন। বাংলা গানের জগতে পরিচিত ছিল তাঁদের দুজনেরই। ফলত একরকম বলা যায় সুরের জগতেই জন্ম বাপ্পির। স্বনামধন্য কিশোর কুমার বাপ্পি লাহিড়ির মামা। তিন বছর বয়েস থেকেই তবলা শিখতে শুরু করেন। এরপর ১৯৭৫-এ হিন্দি ছবি ‘জখমি’ দিয়ে পথ চলা শুরু। সত্তর আশি ও নব্বই–প্রায় তিন দশক ধরে হিন্দি গানের জগতে রাজত্ব করেছেন তিনি।

বাপ্পি লাহিড়ি বললেই সবার প্রথমে মাথায় আসে ‘ডিস্কো ড্যান্সার’, ‘হিম্মতওয়ালা’, ‘শরাবি’, ‘অ্যাডভেঞ্চারস্‌ অব টারজান’, ‘ড্যান্স ড্যান্স’, ‘কম্যান্ডো’, ‘আজ কি শাহেনশাস্‌’, ‘সত্যমেব জয়তে’, ‘থানেদার’, নাম্বারি আদমি’, ‘শোলা অউর সবনম’--প্রভৃতি অসংখ্য মাস্টারপিস। ‘জখমি’-তে আমির খানের বাবা তাহির হুসেইনের সঙ্গে যে তেইশ বছরের যুবক কাজ শুরু করেছিল নিজের প্রতিভায় তাঁর অর্জনে এসেছে একের পর এক হিট গান। যদিও ডিস্কো গানে তাঁর জনপ্রিয়তা এতটাই বেশি যে পাশাপাশি যে তিনি ‘চলতে চলতে মেরে য়ে গীতে’র মতো মেলোডিয়াস গানও বেঁধেছেন, খেয়াল রাখেন না অনেকেই। অথচ সে সব গানও ‘ভদ্রলোকে’দের অন্দরমহলের গুনগুনে পর্যন্ত জায়গা করে রেখেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সুরকারের নাম অজানা থেকে যায় যদিও।

তাঁর অধুনা কয়েকটি কাজের মধ্যে ‘ডার্টি পিকচারে’র ‘উ লা লা’, ‘গুন্ডে’র ‘তুনে মারি এন্ট্রিয়াঁ’, ‘বদ্রিনাথ কি দুলহনিয়া’র ‘টাম্মা টাম্মা’, ‘শুভ্‌ মঙ্গল জাদা সাওধানে’র ‘আরে প্যায়ার কর লে’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ‘বাগি ৩’ ছবির জন্য ‘ভাঙ্কাস’ গানটি শেষ কাজ ‘বাপ্পিদা’র। পুরনো ক্লাসিক গানগুলিকে নবকলেবর দেওয়ার প্রসঙ্গে ২০২০ সালে হিন্দুস্থান টাইমস্‌কে বলেছিলেন, জনতার রুচিই শেষ কথা। পাবলিক যা চাইবে, তিনি তাই দিতে প্রস্তুত।

গানের জগতে বাইরেও নিজস্ব এক ইমেজ তৈরি হয়েছিল তাঁর। স্বয়ং হয়ে উঠেছিলেন স্টাইল স্টেটমেন্ট। বিশেষ ধরনের পোষাকে নিজেকে সজ্জিত করতেন সর্বদাই। সোনা পছন্দ করতেন খুব। সোনার গয়না নিয়ে চর্চা করতেও অসম্ভব ভালোবাসতেন। সেই স্টাইলই আইকনিক ইমেজ নির্মাণ করেছিল বাপ্পি লাহিড়ির। শেষের দিকে রাজনীতিতে আসার চেষ্টাও করছিলেন। ২০১৪ সালে শ্রীরামপুর লোকসভায় বিজেপির হয়ে ভোটে দাঁড়ান। কিন্তু তৃণমূলের কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পরাজিত হতে হয় তাঁকে।

কিছুদিন ধরেই নানারকম অসুস্থতায় ভুগছিলেন বাপ্পি। গত বছরই কোভিড আক্রান্ত হয়ে মুম্বইয়ের ব্রিচ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। এ সময় কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল কণ্ঠ হারিয়েছেন শিল্পী। এ বিষয়ে বাপ্পা লাহিড়ী জানান, “ফুসফুসে সংক্রমন বেড়েছে বলেছে কথা বলতে বারণ করা হয়েছে বাবাকে”। বাদবাকি সমস্ত গুজব। এ বিষয়ে একটু সুস্থ হয়ে বাপ্পি লাহিড়ীও একটি সাক্ষাৎকারে হিন্দুস্থান টাইমস্‌কে জানান, “এত এত মিথ্যে খবর প্রচারিত হতে দেখে আমি খুব বিরক্ত। অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ, অসংবেদনশীল চর্চা এইসব।” মাসখানেকের ওপর হাসপাতালে রেখে গত সোমবারই ছাড়া হয় তাঁকে। তবে মঙ্গলবার থেকেই আবার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে আবার ঘরে ডাকতে হয় ডাক্তার। তাঁর পরামর্শে সঙ্গে সঙ্গে বাপ্পি লাহিড়ীকে ঐ হাসপাতালেই ভর্তি করা হয়। নানারকমের রোগ ছিলই। ডঃ দীপক নমযোশী, হাস্পাতালের ডিরেক্টর, পিটিআই-কে জানান, মধ্যরাতে ‘অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপিনা’য় মৃত্যু হয় তাঁর।

গত রবিবারে লতার চলে যাওয়া থেকে শুরু। ‘আলভিদা’র দেশে একে একে চলে গেলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, বাপ্পি লাহিড়িও। সঙ্গীতের জগতের একটা প্রজন্ম যেন শূন্য হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। পাঁচ দশকের ওপর বিনোদনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে পরিতৃপ্ত করেছেন বাপ্পি। বিভিন্ন শ্রেণীর শ্রোতার চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা তাঁর ছিল। এবং এই রেঞ্জ পর্যালোচনা করলে বিস্মিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। মিঠুনের লিপে সেই দৃপ্ত ঘোষণা—’আই অ্যাম আ ডিস্কো ড্যান্সার’, মনে রাখা দরকার তার আগের বছরই ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ মুক্তি পেয়েছে। ‘এই তো জীবন’ থেকে ‘আমি একজন শান্তশিষ্ঠ’ উত্তমের লিপে একের পর চমকপ্রদ সব গান। কমেডির মুডের সঙ্গে তাল রেখে অত সুষ্ঠুভাবে সঙ্গীত পরিচালনা মুখের কথা নয়। কাজেই শুধু মাত্র ‘ভারতীয় সঙ্গীতে প্রথম ডিস্কো নিয়ে আসেন’ — এ পরিচয় দিয়ে তাঁকে না মাপাই ভালো। হ্যাঁ, যাবতীয় এই জাতীয় হাস্যকর নিক্তির দিকে তাকিয়েই যেন বাপ্পি লাহিড়ির সুরে উত্তমের লিপে কিশোর গাইছেন, “শুধু তুমি নয় অবলাকান্ত, অনেকেরই বলার সময় খেয়াল থাকে না।”

More Articles