'দিদি মারা গেছেন, চিঠি দিয়ে গেলাম'

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। নিজেকে নানাভাবে খণ্ড-বিখণ্ড করেছেন। খণ্ডগুলোকে করেছেন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। এইসব সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বীর মাঝে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতেও চাইছি তাঁকে— তাঁর লেখাকে, এমনকী, তাঁর চিঠিপত্রকেও।


বার-দুই হয়তো দেখেছি। নাচতে। ঘুরে-ঘুরে। হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হলেও, তাঁকে। ডানহাতের দু'-আঙুলে ধরা থাকত রুমালের একটা কোনা। সেটা উড়ত। কখনও ঝুঁকে অন্য কোনাটা মাটিতে ঠেকিয়ে দিলে উত্তেজনার চূড়ান্ত!

সেসময় তিনি পরিত্যক্ত এক তরুণীর ভূমিকায়। গলায় ক্ষুব্ধ প্রেমের গান। কেউ একজন তাঁকে ঠকিয়ে কেটে পড়েছে। সেই কথাটাই ইনিয়েবিনিয়ে সুর বসিয়ে অবসন্ন গলায় বলার চেষ্টা। হতে পারে বাঁকুড়ার কোনও ঝুমুর গানের আসর সেটা, হতে পারে প্যারির কোনও সস্তা বার। গানটা ছিল ছোট্ট। পুরোটাই পাস্ট টেন্সে। চার কি পাঁচ পঙক্তির। তবু, কথাগুলো আর মনে নেই। শুধু একটা লাইন ভুলতে পারিনি— সে যে মুসলমান ছিল!

লাইনটা গাওয়ামাত্র শ্রোতা-দর্শকদের সমবেত উল্লাস— আ… আ… হা-হা… ধ্বনি।

আরও পড়ুন: দুঃখসাধনের নীলিমা, তাঁর চিঠিটা পৌঁছে দেওয়া হলো না…

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। আমাদের সন্দীপনদা।

ইতস্তত তাঁর চিঠিপত্র ছাপা হয়েছে বেশ কিছু। কিন্তু দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাটিয়েও লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের তেমন কোনও চিঠি আমি পাইনি। যেগুলো পেয়েছি, সেগুলোকে বলা উচিত টেলিগ্রাম। আয়তনে এবং কিছুটা চরিত্রেও। কে না জানে, চিঠির চেয়ে টেলিগ্রামের গুরুত্ব অনেক বেশি।

যেমন—

MOTHER ILL. COME SOON.

চারটেমাত্র শব্দ। কিন্তু একেকটা শব্দের বিস্তার কতখানি, এরকম টেলিগ্রাম যাঁর হাতে এসেছে বা আসবে, তিনিই জানেন। তেমনই একটি ছিল—

একরাম দিদি আজ মারা গেছেন। চিঠি দিয়ে গেলাম।
স. চ.
৩১/৩

একরামের পর কমা নেই, যা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে অভাবনীয়। সালেরও উল্লেখ নেই। লেখার জন্য, হাত বা টেবিল মোছার এবং নানাবিধ কাজের জন্য, খবর-কাগজ অফিসে অতি-দরকারি যে-প্যাড, সেই প্যাড থেকে পাতা ছিঁড়ে লেখা।

কর্পোরেশন থেকে অবসর নেওয়ার পর ১৯৯৩ সালে দ্বিতীয়বার তিনি যোগ দেন 'আজকাল'-এ। আগের মতোই চিঠিপত্র সম্পাদনার কাজে, যে-বিভাগটির নাম ‘প্রিয় সম্পাদক’। তার আগে ছিলেন 'আজকাল'-এর জন্মলগ্ন থেকে। বাংলা খবরের কাগজের চিঠিপত্র, বলতে গেলে, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সোনার কাঠির ছোঁয়াতেই প্রাণ পায়। তাঁর প্রথম পর্বের সময় এমনও পাঠক দেখেছি, কাগজ হাতে নিয়ে পাতা উলটে সোজা চারের পাতায়। প্রিয় সম্পাদক বিভাগটি ছিল সংবাদপত্রটির সমান্তরাল একটা ব্যাপার।

একবার হলো কী, কেন্দ্রে তখন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি মন্ত্রী। ফলে গাড়িতে জাতীয় পতাকা। কিন্তু সেটা-যে উলটো করে লাগানো, কে আর দেখছে! যা কেউ দেখতে পায় না, তা-ই দেখে কাগজের রিপোর্টার আর ফোটোগ্রাফার— অন্তত তখনও দেখত। ছবি চলে এল অফিসে। খবরও হল। কিন্তু সন্দীপনদা মনে মনে তাতে সন্তুষ্ট নন। পেয়েও গেলেন একাধিক চিঠি। ছবি-সহ চিঠিপত্র বিভাগে ছাপা হল। শিরোনাম— ‘তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি’।

দ্বিতীয় দফায় তাঁর একজন সহকারীর দরকার হলো। নিয়মিত আসবেন না। সেই ফাঁকগুলো পূরণ করার জন্যে, অর্থাৎ প্রক্সি দেওয়ার জন্যে, আনা হলো আমাকে।

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের প্রক্সি দেওয়া? সেবার খড়গপুরে একটা স্টেডিয়াম হওয়ার কথা। সম্ভবত রেলের। হচ্ছিলও। কিন্তু কী কারণে যেন থমকে গেছে কয়েক বছর। চিঠি এল। হেডিং হলো— খড়গপুরে স্টেডিয়াম কি মায়ের ভোগে?

অনেক আপত্তির পরও পাতায় লাগলই এবং সন্দীপনদা সেদিন এলেন না। সম্পাদক চিঠিটা তুলে দিতে বললেন। একটু পরই সন্দীপনদার ফোন— তোমার মাথায় অদৃশ্য একটা টিকি আছে, বুঝলে!


আসলে বল নিয়ে যখন ড্রিবল করতে করতে মারাদোনারা মাঝমাঠ থেকে এগোয়, সামনে শুধু দেখতে পায় স্বর্গদ্বার, অর্থাৎ গোলপোস্ট। চারপাশের ছোট-ছোট সাদা রুমালের ওড়াওড়ি তারা দেখতে পায় না— যেগুলোতে নৈতিকতার নকশা আঁকা। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন তেমনই এগিয়ে খেলার লোক। এগিয়ে খেলার লেখক তো বটেই।

ফাইল ঘেঁটে দেখছি, সব ক'-টা চিঠিই 'আজকাল'-এর প্রিয় সম্পাদক বিভাগ সম্পর্কিত। ফলে, চিঠি হলেও সেগুলোকে ঠিক চিঠি বলা যায় না। কিন্তু যখন ফোনে কথা হতো, শুরুটা হত যদিও চিঠি-সংক্রান্ত কথা দিয়েই; তারপর সে-কথা এঁকেবেঁকে চলে যেত কোথায়, তাঁর কোন উপন্যাসের বা গল্পের বহুপঠিত পৃষ্ঠায়— যেখানে যৌনতা আর মৃত্যু হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাচ্ছে।

আজ শুধু কথা বলতে এত দূরে চলে এসে, হেনা, দ্যাখো, এ কোথায় আর কত কাছাকাছি আমরা এসে পড়েছি। এর তুলনায়, জন্মদিনে তুমি যা দিয়েছিলে, তোমার যৌবন, যৌবনই তো দিয়েছিলে, তা আমাদের কতটুকু কাছে এনেছিল হেনা, আমাকে তোমার বাইরেই ঠেলে দিয়েছিল। লুতাতন্তু ছিঁড়ে বৃদ্ধ যৌবনের গা থেকে, সবুজ ডালপালা, কই, বেরুল না তো। সেদিন থেকে তাই, আমি সর্বান্তঃকরণে চেয়েছি : তুমি মরো।


সেই কবেকার লেখা— ‘এখন আমার কোনো অসুখ নেই’; উনিশশো আটাত্তর-টাটাত্তর হবে সম্ভবত।

Sandipan Chattopadhyayসন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

এমন একটা গুজব চালু ছিল একসময় যে, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের কথাবার্তার একটা সংকলন-গ্রন্থ করতেই হবে, যার নাম হবে— ‘সন্দীপন কথামৃত’। তাঁর কাছে আমরা সবাই চাইতাম মজার মজার কথা, যা এক ধরনের নতুন। তাই তাঁর সর্বার্থে নতুন লেখাগুলি আমাদের পড়া আর হয়ে ওঠেনি।

তাঁর আলগা পা ফেলে হাঁটায় অনেকে মনে করতেন, লোকটা কি সত্যিই সিরিয়াস? দায়িত্ববান? তাঁদের জন্য একটা চিঠির অংশ, কেজো হলেও। কোনও এক শনিবার, ৫ অগাস্টে লেখা।

...ব্যালান্স করেই তো ছাপতে হবে। কিন্তু ...এর সমর্থনে চিঠি কই? ভাল চিঠি এলেই ছাপা হবে।... আসল ব্যাপার হল ইস্যুটা এবং তার ওপর বিতর্ক।... ইস্যুটি অত্যন্ত সেনসিটিভ বলেই, আমি চিঠি চেয়েছি।

সে-সময় বিবেকানন্দ-বিষয়ে একটা বিতর্ক বেশ ঘনিয়ে উঠেছিল 'আজকাল'-এ। চিঠিও আসছিল প্রচুর। সেসব চিঠির অধিকাংশই ছিল বিবেকানন্দ-বিরোধী। আমরা চাইতাম, বিতর্কটা চলুক— কিন্তু সুস্থভাবে।

আর, লেখক সন্দীপনের দায়িত্ববোধ? সেসব ছড়িয়ে আছে তাঁর রচনারাশিতে। আমি বরং ব্যক্তি সন্দীপনের কথা বলি— মূলত হাসাহাসি হতো যে-দিকটা নিয়ে।

রোগা। লম্বাটে। মুখে-চোখে বিষণ্ণ আলো। কাউকে অপমান করতেন এই প্রত্যাশায় যে, সে-ই অপমান করুক তাঁকে। এহেন সন্দীপনদা কখনও একা, কখনও বৌদি-সহ, আমার পারিবারিক সমস্যার সমাধানে একাধিক জায়গায় গিয়েছেন। আমাকে নিয়েই।

একবারের কথা বলি। হাটখোলার দত্তবাড়ির সঙ্গে রিনাবৌদির রক্তের সম্পর্ক। সেই বাড়ির এক মহিলা, তখন তিনি গড়িয়াহাটের ফ্ল্যাটে, সম্পর্কে বৌদির বোন, বহু বছর অস্ট্রেলিয়ার নামী হৃদরোগ-বিশেষজ্ঞ। ওঁরা নিয়ে গেছেন আমাকে। তিনি যদি আমার ছেলের চিকিৎসায় কোনও কাজে লাগতে পারেন।

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। নিজেকে নানাভাবে খণ্ড-বিখণ্ড করেছেন। খণ্ডগুলোকে করেছেন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। এইসব সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বীর মাঝে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতেও চাইছি তাঁকে— তাঁর লেখাকে, এমনকী, তাঁর চিঠিপত্রকেও।

More Articles