৪০টাকা থেকে ৭২০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এই ব্যক্তি, অসাধ্যসাধনের গল্প শুনুন

তাই কি কখনও সম্ভব? মাত্র ৪০ টাকা ১৫০০০ কোটি টাকায় কীভাবে রূপান্তরিত হতে পারে? এটা কি রূপকথার গল্প? তবে কি কোনো ম্যাজিশিয়ানের শ্রেষ্ঠ ম্যাজিক? মনে প্রশ্ন জাগছে তো? আসুন তবে একটা গল্প শোনানো যাক আপনাদের।

১৮৯৮ সালের ১৫ আগস্ট পাকিস্তানের ভাউন গ্রামের একটি অত্যন্ত গরিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করে এক ফুটফুটে পুত্র সন্তান। তার নাম রাখা হয় মোহন। কপালে লাগামহীন পরীক্ষা নিয়ে জন্মানো শিশুটি মাত্র ৬ মাস বয়সে পিতৃহারা হয়। যে শৈশব হাসতে হাসতে কাটার কথা, যে শৈশব খেলতে খেলতে কাটার কথা সেই শৈশবকালের প্রতিটা মুহূর্ত তার কাটে সংঘর্ষ করতে করতে। লড়াই খিদের সাথে, লড়াই টিকে থাকার জন্য।

নিজের গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে মোহন রওয়ালপিন্ডিতে আসেন উচ্চশিক্ষা লাভ করতে। উচ্চবিদ্যালয়ের গন্ডি পার করে মোহন একটা চাকরি খুঁজতে থাকে। বহু চেষ্টা, বহু দপ্তরে ঘুরে ঘুরে পায়ের চটি মলীন হয়ে যাওয়ার পরেও কপালে একটা চাকরি যখন কোনোভাবেই জুটলো না, তখন মোহন হাল ছেড়ে দিলো। সাথে ছাড়লো রওয়ালপিন্ডি। ১৯২২ সালে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে সে পৌঁছালো শিমলায়। কারণ সে শুনেছিল, শিমলাতে নাকি দেশ বিদেশ থেকে বহু পর্যটকের ভিড় হয়। মনে মনে ভেবেছিল ঠিক কোনও না কোনও একটা কাজ সে পেয়েই যাবে শিমলায়।

কিছুদিন ট্রেন থেকে পর্যটকদের লাগেজ বওয়ার কাজ করে মোহন। মাথায় আর কাঁধে করে পর্যটকদের ব্যাগ বইতে বইতে মোহনের দু'চোখ ঘুরতো ভালো কোনো কাজের সুযোগের। এভাবেই একদিন এক পর্যটকের ব্যাগ বইতে বইতে মোহন এসে পৌঁছায় শিমলার সিসিল হোটেলে। সালটা ১৯২২, মোহন একটা সামান্য চাকরি পায় সিসিল হোটেলে। মাইনে মাত্র ৪০ টাকা। কাজ? রোজ ভোর ৪টের সময় ডিউটিতে এসে হোটেলের গেস্টদের গরম জল পৌঁছে দেওয়া। 

হোটেলের বিদেশী দম্পতি মালিক লক্ষ্য করলেন মোহন রোজ ভোর ৪টের জাগায় ৩টের সময়ই হোটেলে চলে আসতো এবং নিজের কাজ শুরু করে দিত। খুব মনোনিবেশ করে সে নিজের কাজ করতো। কোনোদিন কোনোরকম অভিযোগ তার বিরুদ্ধে হতো না। কিছু বছর পর সিসিল হোটেলের ব্রিটিশ ম্যানেজার যখন ব্রিটেন যান ৬ মাসের জন্য, তখন পুরো হোটেলের দায়িত্ব দিয়ে যান মোহন কে। 

ভাগ্যের চাকা ঘোরা শুরু সেই দিন থেকেই। এই ৬ মাসে মোহন হোটেলের অকুপেন্সি দ্বিগুন করে দেন। ভালো সার্ভিসের জন্য হোটেলটির নাম ছড়িয়ে পড়ে শিমলার পর্যটকদের মুখে মুখে। এই পরিবর্তন লক্ষ্য করে হোটেলের মালিক যারপরনাই খুশি হয়ে মোহনের মাইনে বাড়িয়ে ৫০ টাকা করে দেন এবং মোহন কে থাকার জন্য একটি কোয়ার্টারও দেন। কিছু বছর পর এই ব্রিটিশ দম্পতি যখন ভারত ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে বিদেশে ফিরে যান, তখন নিজেদের প্রাণপ্রিয় সিসিল হোটেলটি মোহন কে ২৫,০০০ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়ে যান। 

মোহন এক্সট্রা কাজ করে, বউয়ের গয়না বিক্রি করে কিছু সময়ের মধ্যেই ব্রিটিশ দম্পতি কে পুরো টাকাটা দিয়ে দেন। ব্যাস এরপর শুরু হয় ভারতের হোটেল জগতের এক স্বর্ণালী অধ্যায়। ১৪ আগস্ট ১৯৩৪ সালে শিমলার সিসিল হোটেলের মালিকানা বদলে যায়। নতুন মালিক মোহন, সিসিল হোটেলের নতুন নাম রাখেন 'The Oberoi Cecil'

ওবেরয় গ্রান্ড || ছবি সৌজন্যে : www.oberoihotels.com

হ্যাঁ, এতক্ষন ধরে কথা যার গল্প শুনছিলেন, তার পুরো নাম মোহন সিং ওবেরয়। ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম হোটেল গ্রুপ ওবেরয়ের প্রাণ প্রতিষ্ঠাতা তিনি। বর্তমান দিনে যে হোটেল গ্রুপ শুধু ভারতেই নয়, তার সাথে শ্রীলঙ্কা, মিশর, অস্ট্রেলিয়া, নেপাল সমেত বিভিন্ন দেশে নিজেদের হোটেল চেন বিস্তারিত করেছে। যার নেট ভ্যালু ৭২০০ কোটি টাকা। যার এক বছরের টার্ন ওভার ১৫০০ কোটি টাকা। যার ৩৫টার বেশি হোটেলে কাজ করে লক্ষাধিক মানুষ, সেই মোহন সিং ওবেরয় জানতেন ৪০ টাকা কে ৭২০০ কোটি করে তোলার মন্ত্র। 

মন্ত্র আরেকটু চেষ্টার, মন্ত্র পূর্ণ মনোসংযোগ দিয়ে কাজ করার, মন্ত্র শূন্যকে শুরুতে না বসিয়ে শেষে বসানোর, মন্ত্র যেখানে সবাই থেমে যায় সেখান থেকে আরও ১০০ কদম এগিয়ে যাওয়ার, মন্ত্র রোজ নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার, মন্ত্র স্বপ্ন দেখার। 

মোহন সিং ওবেরয় ২০০২ সালের ৩রা মে দেহত্যাগ করেন। আর একটা ছোট্ট গ্রামের গরীব ঘরের ছেলে, যেতে যেতে পৃথিবীকে শিখিয়ে গেলেন, সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো আমাদের হাতে না থাকলেও, সোনার বিছানায় শুয়ে মৃত্যু বরণ করাটা কিন্তু পুরোপুরি আমাদের ইচ্ছাশক্তির ওপর...

মোহন সিং ওবেরয় নিজের জীবদ্দশায় পেয়েছিলেন বিভিন্ন সম্মানীয় পুরস্কার। ১৯৪৩ সালে ব্রিটেন সরকার দ্বারা রায় বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত হন তিনি। আমেরিকান সোসাইটি অব ট্রাভেল এজেন্টস এর দ্বারা 'হল অব ফেম' এ তার নাম তোলা হয়। ১৯৭৮ সালে তাকে পুরস্কৃত করা হয়, 'ম্যান অব দ্য ওয়ার্ল্ড' পুরস্কারে। IHA (International Hotel Association) দ্বারা এই পুরস্কার খুব কম মানুষই পেয়েছেন এখনও অবধি। ২০০০ সালে তিনি পান মিলেনিয়াম এওয়ার্ড। এবং মৃত্যুর ঠিক এক বছর আগে, ২০০১ সালে তাকে পদ্ম ভূষণ সম্মানে সম্মানিত করা হয় ভারত সরকার দ্বারা। 

তথ্যসূত্র: 

  • https://en.m.wikipedia.org/wiki/Mohan_Singh_Oberoi
  • https://www.indiatimes.com/amp/trending/human-interest/success-story-of-mohan-singh-oberoi-544510.html
  • https://www.yosuccess.com/success-stories/mohan-singh-oberoi/

More Articles