এক বাঙালের কন্যার দু'চাকার দুনিয়াদারি মুক্তির পথ দেখাচ্ছে লক্ষ মেয়েকে

The most important kind of freedom is to be what you really are. You trade in your reality for a role. You trade in your sense for an act. You give up your ability to feel, and in exchange, put on a mask. There can't be any large-scale revolution until there's a personal revolution, on an individual level. It's got to happen inside first.

বিপ্লব কথাটা শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে ফরাসি বিপ্লবের কথা, রুশ বিপ্লবের রক্তস্নাত অধ্যায়। ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে এসব রণ রক্ত সফলতার কাব্য়। কিন্তু আমাদের চারপাশে, পৃথিবীর বিভিন্ন কোনায় প্রতিনিয়ত বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছেন অনেকে। জিম মরিসন উপরের উদ্ধৃতিতে তাদের কথাই বলতে চেয়েছেন। জিম মরিসনের ভাষায় "Personal Revolution", যা শহরের আকাশে তারাখসা দেখতে পাওয়ার মতোই বিরল। তাঁদের ছক ভাঙার, সমাজের অচলায়তনের বেড়ি ভাঙার গল্প আমাদের মুগ্ধ করে, অনুপ্রেরণা দেয়। এমনই একজনের গল্প বলব। তিনি একটি সাইকেলে চেপে নিঃশব্দে বিপ্লব ঘটাচ্ছেন প্রতিদিন।

১৭ বছর বয়স থেকেই ব্রিটেনের বাংলাদেশি মুসলিম পরিবারের মেয়ে সুহেনা ইসলামের ইচ্ছে ছিল আইনজীবী হওয়ার। সেই পেশাতেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তিনি। প্রচণ্ড নিষ্ঠা এবং উদ্যমের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময়েই সাইকেল-দর্শন। তাঁর ভাষায়, "এক মিনিট, আমি তো শুধু আইনজীবী নই, আমার পরিচয় তার চেয়ে বেশি কিছু হওয়া উচিত। সাইকেলই সেটা আমায় বুঝিয়েছে"

সুহেনার বয়স তখন ২০, লন্ডনের ভিক্টোরিয়া পার্কে তিনি সাইকেল চালানো শেখেন। ওই শেখার সময়ের পড়ে যাওয়া, তার পর আবার উঠে দাঁড়িয়ে ফের সাইকেলে বসে পড়া এবং তারপর উড়াল। বলাই বাহুল্য গোঁড়া ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা সাইকেল চালানোকে সুনজরে দেখে না। শরিয়তবিরোধী বলে দাগিয়ে দেওয়া হয় কারণ এই ধরনের কাজে শরীর প্রদর্শনের হওয়ার সম্ভাবনা থাকে যা কিনা শরিয়ত অনুযায়ী হারাম।। সুহানা বাহাসে যাননি। এমন কাজ করেছেন যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে। ব্রিটেনে সুহানাই প্রথম হিজাবি সাইক্লিস্ট। অর্থাৎ বৃত্তের মধ্যে থেকেই নিঃশব্দে বিপ্লবটা ঘটিয়ে ফেলেছেন তিনি।

আরও পড়ুন-ডায়েটকে না বলুন, খান মনের ডাকে সাড়া দিয়ে, তাতেই কিস্তিমাত বলছে গবেষণা

একজন রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারের সদস্যা হয়ে তাঁর পক্ষে মোটেই তাঁর নিজের মত করে জীবনের দিক নির্ণয় করা সহজ ছিল না। তাঁর ছয় বোনে খুব কম বয়সে বিয়ে করে নিজেদের সাংসারিক জীবনে  নিজেদের সমর্পণ করে দেন। সন্তানের জন্ম দেন। সুহেনার উপরেও পরিবারের ঠিক একই রকম চাপ ছিল, এবং তাঁর এই ব্যতিক্রমী জীবনযাত্রা এবং জীবনদর্শন তাঁর পরিবারের একেবারেই পছন্দ ছিল না। রক্তচক্ষুর সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে অবিরল। সুহেনা দমে যাননি। নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যান। জীবনে আসে সাইকেল এবং এক বৃহত্তর পরিবার যাদের তিনি আঁকড়ে ধরেন।

২০১৮ সালে তিনি দুবাইতে ছুটি কাটাতে যান, এবং খোঁজ পান আল-কুয়াদ্রা ট্র্যাকের। এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করেননি তিনি, একটি সাইকেল ভাড়া করে নেমে পড়েন ট্র্যাকে এবং একটানা ষাট কিলোমিটার চালান। শুহেনা বলেন, সেই ষাট কিলোমিটারের যাত্রা তাঁর জীবন পাল্টে দিয়েছিল। সুহানা চান সাইকেল চালিয়েই ব্রিটেন থেকে মক্কায় যেতে। সুহেনা চান, তাঁকে দেখে এগিয়ে আসুন বিভিন্ন দেশের মুসলিম নারীরা। পেশাদার সাইক্লিংয়ে যোগ দিন। সুস্থ থাকুন। 

লন্ডনে তিনি একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দুবাই থেকে ফিরেই তাদের থেকে একটি সাইকেল পান, এবং সাইকেল টু ওয়ার্ক প্রকল্পের মাধ্যমে বাকি সব সরঞ্জাম কেনেন। তারপর তিনি সাইকেল নিয়ে পাড়ি দেন ইংল্যান্ডের ব্রাইটন শহরের উদ্দেশ্যে। এক মাসের মধ্যেই পা ভাঙে তাঁর, কিন্তু তিনি একেবারেই দমে যাননি। পা ঠিক হতেই আবার নেমে পড়েন রাস্তায়, ইংল্যান্ডের রাস্তা আবার দেখে হার না মানা সুহেনার অশ্বমেধের ঘোড়াকে। সাইকেল নিয়ে ফ্রান্সেও গিয়েছেন সুহানা।

নিজের বাবাকে হারানো এবং তারপরের মানসিক বিপর্যয়ের সময়ে তাঁকে যদি কোনও কিছু সাহায্য করে থাকে তা হল তাঁর সাইকেল। সুহেনা বলছেন, "সাইকেল আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আমার একাকীত্বের জীবনে আমার সাথে থেকেছে শুধু আমার এই বাহন। ইংল্যান্ডের কান্ট্রি সাইডের রাস্তায় যখন সাইকেল চালাই, তখন আমার সব কষ্ট আমি ভুলে যাই। সত্যি বলতে, সাইক্লিংয়ের দৌলতে অনেক বন্ধুও আমি পেয়েছি যারা আমারই মত এই দু চাকার যন্ত্রটাকে আঁকড়ে ধরেছেন।" শুনতে হয়তো সহজ, কিন্তু একজন গোঁড়া মুসলিম পরিবারের মেয়ের পক্ষে এই কাজ এভারেস্ট জয়ের সমান কঠিন। সুহেনা তা করে দেখিয়েছেন।

এই অতিমারী সুহেনার জীবনে এক বড় পরিবর্তন আনে। এমন এক ঘটনা, যা সুহেনার জীবন পাল্টে দেয়, এবং জায়গা করে দেয় বিশ্বমঞ্চে।

সাইক্লিস্টদের পোশাক বানানোর বিখ্যাত এক ব্র্যান্ড রাফা তাদের ইন্সটাগ্রামের #choosecycling ক্যাম্পেনের জন্যে সুহেনাকে আমন্ত্রণ জানায়। সেই শুরু, আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি ওনাকে। রাফার Women's 100 প্রতিযোগিতার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বানানো হয় তাঁকে। রাফা শুধুমাত্র সুহেনার জন্যে বিশেষ একটি হিজাব প্রস্তুত করে। যখন সেই পোশাকে সবার সামনে আসেন সুহেনা, সারা বিশ্ব চমকে যায়। সুহেনা জানতেন, তাঁর এই সম্মান বাংলাদেশের মুসলমান তরুণীদের খুবই সাহস দেবে, অনুপ্রেরণা যোগাবে। যে নারী পাহাড় প্রমাণ বাধা টপকে, নিজের রক্ষণশীল পরিবারের সঙ্গে লড়াই করে ওই জায়গায় পৌঁছেছেন, তাঁকে দেখে সবার অনুপ্রাণিত হওয়াই স্বাভাবিক।

আজ সুহেনা বিখ্যাত আমেরিকান সাইকেল প্রস্তুত কারোক ক্যাননডেল বাইকের বিজ্ঞাপনের প্রধান মুখ। তাছাড়াও ওকলে নামের একটি কোম্পানির সঙ্গে সমাজসেবার কাজ করছেন। সেই সঙ্গে কম বয়সি মেয়ে অ্যাথলিট খোঁজার কাজ করছেন। লড়াই করার সাহস, উদ্যম, পরিশ্রম আর অসম্ভব জেদ না থাকলে কোনও রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ের পক্ষে সম্ভবই হতোনা ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে হোর্ডিং এ নিজের মুখ দেখা বা হাজার হাজার মেয়েদের রোলমডেল হওয়া। সমাজের সব নিয়মকানুনের বেড়ি ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি, এবং আজ যেনো দুটো ডানা মেলে এক পাখি উড়ছে।

নিজের দেশের টেলিভিশনেও আমন্ত্রণ পেয়েছেন তিনি। সবাইকে বুঝিয়েছেন সাইকেল একটা শহর, একটা সমাজের জন্যে কতটা প্রয়োজনীয়। মেয়েদের তিনি নিজে হাতে সাইকেল চালানো শেখান এখনও।

সুহেনার জীবন এবং তিনি যা করে দেখিয়েছেন তা বিপ্লবের থেকে কিছু কম কি?  চলুন না, এই বিষধোঁয়ার শহরে সাইকেলটাকে ফের পথে নামিয়ে আমরা বিপ্লবেই অংশগ্রহণ করি। বৃত্তের ভিতরে থেকেই বোমা ফাটানো সম্ভব সুহেনা দেখিয়ে দিয়েছেন।

More Articles