লুজ লং সেদিন মারা যাননি

সময়টা ছিল ১৯৩৬। বিশ্ব অলিম্পিক দরবারে আর সমস্ত দেশের মতো জার্মানিও অংশীদার এবং আয়োজক দেশও বটে। হিটলার শাসিত নাজি সভ্যতার ধারক ও বাহক জার্মানি তখন বর্ণ বৈষম্যের তুঙ্গে। কালো চামড়ার মানুষদের তখনও সাদা চামড়ার মানুষদের সাথে তুলনায় বসানো যায় না। ক্রীতদাস করে রাখা হয়। এহেন পরিস্থিতিতে অলিম্পিকের প্রতিটা দিন প্যাভিলিয়নের বিশেষ স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতেন স্বয়ং হিটলার। নিজের দেশের ক্রীড়া প্রতিযোগীদের তাঁর তীক্ষ্ণ নির্দেশ, যে কোনও বিভাগে প্রথম হতেই হবে। প্রথম হওয়া ছাড়া কোনও বিকল্প নেই বিশ্ব দরবারে নাজি সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার।

এই একই অলিম্পিকে সেবারের অংশীদার আমেরিকাও। পাখির চোখের মতো আমেরিকার সমস্ত ক্রীড়া প্রেমীদের চোখ নিজেদের দেশের হয়ে মাঠে নামা জেসি ওয়েন্সের দিকে। জেসি ওয়েন্স, কালো চামড়ার এক ২২ বছরের ক্রীতদাস পরিবারে বেড়ে ওঠা যুবক, যার ক্ষিপ্রতা, গতিবেগ, চেহারার গঠন এবং উপস্থিতি সবকিছুই তাকে আলাদা করে দেয় বাকি প্রতিযোগীদের থেকে। প্রতিযোগীতা শুরু হওয়ার পর থেকেই যে একটার পর একটা স্বর্ণ পদক ছিনিয়ে আনছে প্রতিটা ইভেন্ট থেকে। জার্মান শাসক এডোলফ হিটলার স্পষ্টত ভাবে যার উপস্থিতিতে বিরক্ত হয়ে বলেন, 'এদের পূর্বজ রা জঙ্গলে থাকতেন, এদের শারীরিক গঠন স্বাভাবিক মানুষদের থেকে অনেক উন্নত। এদের কে ভবিষ্যতে খেলায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়াই উচিত নয়'।

কিন্তু জার্মানির হয়ে জেসি ওয়েন্সকে টক্কর দেওয়ার মতো কি একেবারেই কেউ ছিলো না? ছিলো, লুজ লং। দীর্ঘকায়, সাদা চামড়া, নীল চোখের অধিকারী এই প্রতিযোগী ১৯৩৬ সালের ৪ঠা আগস্ট লংজাম্পের ট্রায়াল দিতে মাঠে নেমেই ভেঙে দিলেন পুরানো অলিম্পিকের রেকর্ড। স্টেডিয়াম থেকে উচ্ছাসে টগবগ করে ফুঁটে উঠলো জার্মান বাহিনী। সাব্বাশ, এই তো চাই, বাঘের বাচ্চা নাজি উচ্ছাসের বাংলা অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায়। এরপরেই এলেন আমেরিকান ওয়েন্স। যিনি ইতিমধ্যেই তিনটে বিভাগে স্বর্ণ পদকের বিজেতা। মাঠ জুড়ে নীরবতা। ওয়েন্স দৌড়াতে শুরু করলেন। তীর থেকে বেড়ানো ধনুকের মতো ছিটকে এসে লাফ দিলেন নির্দিষ্ট পজিশন থেকেই। বেজে উঠলো রেফারির বাঁশি, ডিস-কোয়ালিফায়েড। উচ্ছাসে ফেটে পড়লো জার্মান সমর্থকেরা। আবার দৌড়ালেন ওয়েন্স, আবার ডিস-কোয়ালিফায়েড। মাঠ জুড়ে হৈ-হৈ, জার্মান সমর্থকেরা ভেবেই নিয়েছেন, এই বিভাগের সোনা তাদের হাতের মুঠোয়। মাঠের মধ্যে হতাশায় মাথা নিচু করে বসে আছেন ওয়েন্স। আর একটা সুযোগ। টেনশনে, জার্মান সমর্থকদের উল্লাসের চাপে তিনি মনোযোগ ফেরাতে ব্যর্থ। ঠিক এই সময়ে ওয়েন্স অনুভব করলেন তার পিছনে এসে কেউ দাঁড়িয়েছেন। মুখ ঘুরিয়ে তিনি দেখলেন, লুজ লং। জার্মান প্রতিযোগী লুজ লং। প্রতিদ্বন্দ্বী লুজ লং। কিন্তু তার চিন্তা ভাবনা মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে লং বলে উঠলেন, 'এই প্রতিযোগিতা তুমি চোখ বন্ধ করে জিততে পারো। একটু পিছন থেকে ঝাঁফ দাও, সহজেই কোয়ালিফাই করবে তুমি। নিশ্চয়ই তোমার মনের মধ্যে ভয় কাজ করছে। তোমার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই বন্ধু। টেনশন কিসের?'

লুজ লং সেদিন মারা যাননি

চিত্রঋণ : Google

উঠে দাঁড়ালেন ওয়েন্স। ফিরে এলেন স্টার্টিং পয়েন্টে। চোখ বন্ধ করে লংয়ের কথা গুলো মনে করলেন, 'এই প্রতিযোগিতা তুমি চোখ বন্ধ করে জিততে পারো...', দৌড়ালেন। লংজাম্পে ওয়েন্স সেবার স্বর্ণ পদক নিয়ে মোট চারটি বিভাগে স্বর্ণ পদক জয়ী হলেন। লং পেলেন লংজাম্প বিভাগে একটি রুপো। নিজের জয় করা চারটে স্বর্ণপদক নিয়ে কিছু বলতে গিয়ে বললেন, 'এই অলিম্পিকে আমার জয় করা চারটে স্বর্ণ পদকের থেকেও মূল্যবান হলো লুজ লংয়ের বন্ধুত্ব।'

এরপরের সময়কাল ১৯৪৩। বিশ্বযুদ্ধের আবহকালে লুজ লং দেশের হয়ে বাকি সবল পুরুষদের মতোই লড়াই করতে জোরপূর্বক পাঠানো হয়েছে রণক্ষেত্রে। লং কোনও সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিলেন না, না ছিলো দেশের হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করার কোনও প্রশিক্ষণ। জুলাই মাসের এক শান্ত বিকালে যখন তার ব্যাটালিয়ন অল্প অল্প করে এগোচ্ছে উত্তর আফ্রিকার মাটি ধরে, ঠিক তখনই তাদের চার পাশ থেকে ঘিরে নেয় আমেরিকান সেনা বাহিনী। মৃত্যু আসন্ন জেনে লং ভয়ভীত হলেন না, বরং তিনি একটা সাদা কাগজ আর পেন নিয়ে চিঠি লিখতে বসলেন প্রিয় আমেরিকান বন্ধু জেসি ওয়েন্সকে,

 

'জেসি, হয়তো এটাই আমার তোমাকে লেখা শেষ চিঠি। এই মুহূর্তে আমেরিকান সেনা বাহিনী দ্বারা পরিবেষ্টিত আমি এবং আমার সঙ্গীরা। মৃত্যু যে কোনও মুহূর্তে কাছে টেনে নেবে আমায়। আমি তা নিয়ে চিন্তিত নই বিশেষ, বরং এই মুহূর্তে আমার মন উড়ে যাচ্ছে আমার স্ত্রীর কাছে, আমার সদ্যজাত সন্তানের কাছে। সে আমাকে এখনও ঠিকভাবে চেনে না, বাবা বলেও ডাকেনি। জেসি, আর যদি কখনও দেখা না হয়, আমি চাই তুমি যুদ্ধ শেষ হলে জার্মানি এসো, আমার স্ত্রী এর সাথে দেখা করে, আমার সন্তানকে জানিও তোমার আর আমার বন্ধুত্বের ব্যাপারে। ওকে বিশ্বাস করিও মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক দেশ, কাঁটাতার, গায়ের রং, ধর্মের ঊর্ধ্বে।

ইতি,

তোমার ভাই, লুজ।'

 

লুজ লং সেদিন মারা যাননি

চিত্রঋণ : Google

লুজ লং সেদিন মারা যাননি। মারাত্মক চোট আর আঘাত নিয়ে তিনি ভর্তি হন হাসপাতালে। এরপর ১৯৮০ সালের ৩১শে মার্চ তিনি লাং ক্যান্সারে ভুগে মারা যান। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জেসি আসেন জার্মানি। নিজের বন্ধুর লেখা চিঠির প্রতিটা শব্দ তিনি পালন করেন।

নাজি সভ্যতার উদ্দেশ্যে, জেসি একটা চিঠিতে লিখেছিলেন, 'তোমরা আমার সমস্ত স্বর্ণপদক পুড়িয়ে দিতে পারো, জ্বালিয়ে দিতে পারো সব শংসাপত্র। কিন্তু আমার আর লুজ লংয়ের যে ২৪ ক্যারাটের বন্ধুত্ব, তা কীভাবে ধ্বংস করবে বলতে পারো?'

ক্রীড়া জগতের দুটো মানুষ, জেসি ওয়েন্স আর লুজ লংয়ের এই যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক, তা গোটা বিশ্বের কাছে সম্প্রীতির বার্তা হয়ে খোদিত থেকে গেছে। আসলে, যে মায়াবন দু'জন মানুষ মিলে নিজেদের সম্পর্কে রচনা করতে পারেন, তার থেকে বেশি শাশ্বত আর কীই বা হতে পারে।

 

তথ্য সূত্র : https://www.independent.co.uk/sport/olympics/jess-owens-anniversary-luz-long-rio-2016-olympics-berlin-1936-nazi-games-7166831.html

More Articles