মা’ নিনি উৎসব এবং মৃত মানুষদের ঘরে ফেরা!
এই পৃথিবীর বুকে এমন অনেক কিছুই ঘটে থাকে যা মানুষের চিরাচরিত জ্ঞানের বাইরে। যা মানুষের মনে বিস্ময় জাগায়। এমন কিছু যার উত্তর বিজ্ঞানও দিতে পারে না। এই পৃথিবীর যা কিছু মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলব্ধি করতে অক্ষম , তা থেকেই অনেক সময় জন্ম নেয় এক অজানা ভীতির। যুগ যুগ ধরে মানষের মনে, মৃত্যু-পরবর্তী কল্পিত জগৎকে ঘিরে আজও এক ভীতি সম্পূর্ণরূপে বিদ্যমান। তাই তো কখনো মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তির জন্য আবার কখনও তাদের চিরতরে নিজ জীবন থেকে বিতাড়িত করার জন্য গোটা পৃথিবীতে নানান আচার-অনুষ্ঠান পালিত হতে দেখা যায়। আজ ইন্দোনেশিয়ার এমন এক রীতির কথা শোনাবো যেখানে মানুষ, মৃত ব্যক্তিকে ভয় নয়, বরং তাদের নিজগৃহে ফিরিয়ে আনেন নির্দিষ্ট সময় অন্তর। আশা করি, রোমাঞ্চ প্রিয় মানুষদের এই আচার-রীতি বিশেষভাবে আকর্ষণ করবে।
দক্ষিণ ইন্দোনেশিয়ায় অবস্থিত সুলায়েসি (Sulawasi Island) নামে পর্বত ঘেরা এক ছোট্ট দ্বীপ। এই দ্বীপেই টানা টোরাজা (Tana Toraja) নামক এক স্থানে বসবাস করে টোরাজা উপজাতি । ইন্দোনেশিয়ার বসবাসকারী মোট টোরাজা উপজাতির অর্ধেকের বেশি মানুষ থাকেন পবর্তঘেরা এই অঞ্চলে। এই টোরাজা জাতির এক বিস্ময়কর অনুষ্ঠানের নাম মা’নিনি ফেস্টিভ্যাল (Ma'nene Festival)। মা’নিনি শব্দের অর্থ হল ‘ শবদেহ পরিষ্কার- পরিচর্যার উৎসব’ (Ceremony of cleaning corpses)। এই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষেরা মূলত খ্রিস্টান অথবা ইসলাম ধর্মাবলম্বী। কিন্তু এই ধর্মের ঊর্ধ্বে গিয়েও কিছু সংখ্যক মানুষ এখনও পূর্বপুরুষদের অনুসরণ করে এই মা’নিনি ফেস্টিভ্যাল পালন করে চলেছেন। টোরাজান মানুষেরা মনে করেন, মৃত্যুই জীবনের অন্তিমপর্ব নয় । বরং মৃত্যুতেই মানুষের এক নতুন পথ চলা শুরু করে আধ্যাত্মিক জীবনের পথে পা রাখে মানুষ।
এবার আসা যাক, এই উৎসবের একেবারের গোড়ার কথায়। বহু শতাব্দী পূর্বে, পং রুমশেক নামক এক পশু শিকারি পাহাড়ী এক গাছের তলায় এক পচা-গলা মানব দেহের সন্ধান পান। তিনি সেই দেহটাকে সযত্নে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেন এবং দেহটিকে কবর দেন। পরবর্তীকালে এই মানুষটির সৌভাগ্যপ্রাপ্তি ঘটে। এই ঘটনা থেকেই টোরাজান মানুষদের মনে হতে শুরু করে, হয়তো এভাবেই কোন শবদেহের পরিচর্যা করলে তাদের আর্শীবাদে সৌভাগ্য যোগ ঘটে। এই থেকেই ইন্দোনেশিয়ার টানা টোরাজান অঞ্চলে শুরু হয় মা’নিনি উত্সব। প্রতি তিনবছর অন্তর অগস্ট মাসে, শস্য কাটার পর এই উৎসব উদযাপন করা হয়ে থাকে। এই উৎসবে কবর খুঁড়ে বের করা হয় কফিন। তারপর, কফিনে থাকা মমিস্বরূপ দেহগুলিকে পরিচর্যা করা হয়ে থাকে। মনে করা হয়ে থাকে, ইন্দোনেশিয়ায় প্রতি তিনবছর পর ঘরে ফেরে মৃত প্রিয়জনেরা। প্রিয়জনদের প্রিয় কোন খাবার কিংবা কোন প্রিয় বস্তু তাদের মৃতদেহের পাশে সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। তাদের নিজের পছন্দের জিনিসগুলি দিয়ে সাজানো হয়ে থাকে, তালিকায় বাদ পড়ে না মাদক দ্রব্যও। এই উৎসব টোরাজানদের জীবনে খুবই আনন্দের এবং ব্যয়সাপেক্ষও বটে। মৃত্যুর পরবর্তী এই উৎসব যাতে পরিবারের মানুষেরা নির্বিঘ্নে পালন করতে পারে তাই বহু মানুষ নিজের জীবদ্দশায় যথাসম্ভব অর্থসঞ্চয় করে যান। পর্বতে ঘেরা এই জায়গায় মানুষগুলি আর্থিকভাবে বিশেষ স্বচ্ছল নয়। জানলে অবাক লাগে, মৃত্যুর পর ঠিকভাবে যেন প্রিয় মানুষদের কবর দেওয়া হয় তাই পর্যাপ্ত অর্থ জোগাড় হওয়া পর্যন্ত মৃতদেহকে দীর্ঘদিন অবধি নিজগৃহেই রাখা হয়। মৃতদেহগুলির পচন ক্রিয়া হ্রাস ঘটানোর জন্য একাধিক স্তরে কাপড় জড়িয়ে রাখা হয়। এই অঞ্চলে কখনও পাহাড়ের গুহায় কিংবা কখনও পাহাড় কেটে কফিনগুলোকে রাখা হয়। কখনোবা কফিনগুলিকে পাহাড়ের গায়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তাঁরা মনে করেন , কফিনবন্দী দেহগুলি আসলে গভীর নিদ্রায় মগ্ন কিংবা কোন গুরুতর অসুস্থ । তাই এই দেহগুলিকে পাহারা দেওয়ার জন্য কাঠের নির্মিত এক পাহারাদার রাখা হয়। কাঠ দ্বারা নির্মিত এই পাহারাদারদের বলা হয় ‘তাও তাও’ ( Tao Tao) । টোরাজানরা জীবনের বেশিরভাগ সময় যেখানে অতিবাহিত করেন, সেখানেই তাদের কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মৃতব্যক্তিদের উৎসর্গ করে বলি দেওয়া হয় অসংখ্য ষাঁড় এবং মহিষ। তারা বিশ্বাস করেন এই উৎসর্ণগীকরণ মৃত ব্যক্তিদের শান্তি দেবে । এর সঙ্গেই উঠে আসে আরো এক নীতি, টোরাজানরা শুধু এই মহিষ কিংবা ষাড়দের বলিই দেন না বরং তারা নিজের বাড়িতে এই মৃত পশুর শিংগুলিকে সংগ্ৰহ করেন। তাঁদের বিশ্বাস যাঁর গৃহে যত শিং সঞ্চিত থাকবে তারা তত বেশি করে সৌভাগ্যের এবং পূণ্যের অধিকারী হবেন
বর্তমানে তিনবছর অন্তর উদযাপিত হওয়া মা’নিনি উৎসব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষদের আকর্ষণ কেড়েছে। বিভিন্ন দেশের মানুষ আজ তাই এই অনুষ্ঠান চাক্ষুস করার উদ্দেশ্যে সেখানে যেতে শুরু করেছেন। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা মানুষের ভিড়ে, টোরাজান জাতি সময়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে মানুষ আজ নিজেদের আচার–অনুষ্ঠান ঝেড়ে ফেলে আধুনিকতার পথে পা মিলিয়েছে, এই আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলি আজও পূর্বপুরুষের দেখানো পথেই হেঁটে চলেছেন দীর্ঘ একশো বছর ধরে অন্য। মানুষদের কাছে এই অনুষ্ঠান ভীতির উদ্রেক ঘটালেও টোরাজানদের কাছে অত্যন্ত আনন্দের এবং প্রিয়জনকে আরও একবার কাছে ফিরে পাওয়ার...
তথ্যসূত্র:-
elitereader.com
http://curlytales.com
roadsandkingdoms.com