নেই দুর্গাপুজোর কোনও সম্পর্ক, মহালয়াতেই কেন তবে পিতৃতর্পণের ঢল

Mahalaya Tarpan: সনাতন ধর্মে কোনও শুভ কাজ করতে গেলে বা বিবাহ করতে গেলে প্রয়াত পূর্বজদের এবং সমগ্র জীব-জগতের জন্য তর্পণ করতে হয়। তর্পণ মানে খুশি করা।

হাতে তিল, কূশ নিয়ে ভিজে কাপড়ে নাভিমাত্র জলে দাঁড়িয়ে পিতৃপুরুষকে তর্পণ করছেন উত্তরসূরিরা। মহালয়ার সকালে ঘাটগুলিতে এই ছবি বিরল নয়। আশ্বিন মাস। বাতাসে শরতের গন্ধ। আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘেদের চলাচল। পুজো এসে গেল। এই আবহে আরেক রীতির নাম মহালয়া, যার সঙ্গে জড়িয়ে পিতৃতর্পণ। এদিন সকালে ঘাটগুলিতে কান পাতলেই শোনা যায়- বিষ্ণু স্মরণ। সময়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে অনেকেই সময় পান না সারা বছর পূর্বপুরুষকে স্মরণ করার। এমনকী সংক্ষিপ্ত হয়ে এসেছে মৃত পূর্বপুরুষদের বাৎসরিক শ্রাদ্ধের প্রক্রিয়া। এই অবস্থায় মহালয়ার এই বিশেষ দিন অনেকেই তাঁদের কাজ ফেলতে গঙ্গার ঘাটগুলিতে ভিড় করেন। জল দেন পিতৃপুরুষদের।

স্নানাঙ্গ তর্পণ স্নানান্তেই করতে হয়। স্নানান্তে পূর্বমুখে নদীতে নাভিমাত্র জলে দাঁড়িয়ে, যজ্ঞোপবীত বাম স্কন্ধে রেখে তিলক ধারণ করতে হয়। তর্পণ শুরুতে আচমন ও বিষ্ণু স্মরণ। করজোড়ে উচ্চারিত হয়,

“ওঁ তদ্ বিষ্ণোঃ পরমং পদং, সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ।

দিবীব চক্ষুরা ততম্।। ওঁ বিষ্ণুঃ, ওঁ বিষ্ণুঃ।”

এই মন্ত্র বিষ্ণুকে স্মরণ করে উচ্চারিত হয়। আচমন পূর্বক তিনবার নমো বিষ্ণুঃ বলে করজোড়ে আবার-

“নমঃ অপিত্রোবা, সর্ববাবস্থাং গতোহপিবা।

যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষং, স বাহ্যাভ্যন্তরঃ শুচিঃ।”

এই মন্ত্রে বিষ্ণু স্মরণ।

তর্পণ শব্দের ব্যুৎপত্তি

তর্পণ বৈদিক অনুশীলনের একটি শব্দ যা ঐশ্বরিক সত্তার প্রতি কোনও কিছু নিবেদন করাকে বোঝায়। তর্পণ শব্দটার উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত ‘তৃপ্’ (অর্থাৎ সন্তুষ্ট করা) থেকে। হিন্দুধর্মে দেবতা, ঋষি ও মৃত পূর্বপুরুষদের (পিতৃকুল ও মাতৃকুল) উদ্দেশ্যে জল নিবেদন করে তাঁদের সন্তুষ্ট করার পদ্ধতিকে তর্পণ বলা হয়। বংশের যে সকল‌ পিতৃপুরুষ পরলোক গমন করেছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক স-তিল জল (তিল মেশানো জল) দান করে সাধারণত পুত্রসন্তানেরা পিতৃতর্পণ করে থাকেন। এভাবে তর্পণ করাকে আবার তিল তর্পণও বলে।

আরও পড়ুন-আজও মহালয়ার ভোর মানেই রেডিও! আকাশবাণী থেকে এফএম, অব্যাহত নস্টালজিয়া

তর্পণ কী?

ভারতকোষ অনুযায়ী, “জলের দ্বারা কৃত পিতৃপুরুষ ও দেবতাদের তৃপ্তিবিধায়ক অনুষ্ঠান”। এর অপর নাম পিতৃযজ্ঞ। এই অনুষ্ঠানে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব প্রমুখ দেবতা, সনক-সনন্দ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, সপ্তর্ষি, চতুর্দশ যম ও দ্বাদশ পূর্বপুরুষ (পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, মাতামহ, প্রমাতামহ, বৃদ্ধপ্রমাতামহ, মাতা, পিতামহী, প্রপিতামহী, মাতামহী, প্রমাতামহী ও বৃদ্ধপ্রমাতামহী) এবং ত্রিভুবনের উদ্দেশ্যে জল দেওয়া হয়। পিতৃপক্ষের সময় তিলতর্পণ অনুষ্ঠিত হয়; অর্থাৎ তিল-মেশানো জলে তর্পণ হয়। তর্পণ, শাস্ত্রমতে, নিত্যকর্তব্য। তবে আজকের সময়ে রোজ বাপ-ঠাকুরদাদের স্মরণ করা সম্ভব হয় না বলে, লোকে পিতৃপক্ষে এবং বিশেষ করে, সর্বপিতৃ অমাবস্যায় (যে দিনটিকে আমরা ‘মহালয়া’ বলে থাকি) তিলতর্পণ করেই পিতৃকৃত্য সেরে থাকে।

পিতৃতর্পণের সঙ্গে দুর্গাপুজোর সরাসরি যোগ নেই। দুর্গাপুজোর কল্পারম্ভ মহালয়ায় হয় না। মহালয়ার ঠিক আগের নবমীতে হয় কৃষ্ণানবম্যাদি কল্পারম্ভ এবং মহালয়ার পরদিন হয় প্রতিপদ্যাদি কল্পারম্ভ। মহালয়ার এই দিনটি দুর্গাপুজোর শুরু বলেই মনে করা হয়ে আসছে অনেক বছর ধরে। কিন্তু সনাতন ধর্মানুযায়ী, এই ধারণার কোনও ভিত্তি নেই। সম্ভবত আকাশবাণী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ-বাণীকুমারের গীতি-আলেখ্যটি এই দিনে চালানোর ফলেই এমন ধারণার সূত্রপাত। কিন্তু মনে রাখা দরকার, আকাশবাণীর অনুষ্ঠানটির নাম কিন্তু ‘মহালয়া’ নয়— ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। অনুষ্ঠানটি এখন মহালয়ার দিন সম্প্রচারিত হলেও শুরুতে তা সম্প্রচারিত হতো ষষ্ঠীর ভোরে।

মহালয়ার দিনটি নির্ধারিত শুধু পিতৃতর্পণের জন্যই। পিতৃকৃত্যের ক্ষেত্রে এই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। এই দিন তিথিনিয়মের বাইরে সকল পূর্বপুরুষের শ্রাদ্ধ করা যায়। যাঁদের সাংবাৎসরিক শ্রাদ্ধ সামর্থ্যে কুলায় না, তাঁরা সর্বপিতৃ অমাবস্যা পালন করেন। আবার প্রতিপদের দিন দৌহিত্র মাতামহের তর্পণ করেন। পিণ্ডদান, গীতাপাঠ, চণ্ডীপাঠ, দানধ্যান– সবই হয় এদিন।

ত্রেতা যুগে মহালয়া

ত্রেতা যুগে রামচন্দ্র অকালে দেবীর আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের জন্য। কিন্তু মূল দূর্গাপুজো হল বসন্তে, সেটাকে বলা হয় বাসন্তী পুজো। শ্রীরামচন্দ্র অকালে-অসময়ে পুজো করেছিলেন বলে এই শরতকালেরর পুজোকে দেবীর অকাল-বোধন বলা হয়। সনাতন ধর্মে কোনও শুভ কাজ করতে গেলে বা বিবাহ করতে গেলে প্রয়াত পূর্বজদের এবং সমগ্র জীব-জগতের জন্য তর্পণ করতে হয়। তর্পণ মানে খুশি করা। রাম লঙ্কা বিজয়ের আগে মহালয়া তিথিতে এমনটাই করেছিলেন। সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্মাদের মর্ত্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, এই সকল প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয় তাকেই বলা হয় মহালয় এবং এই মহালয় থেকেই মহালয়া। পিতৃপক্ষেরও শেষ দিন এটি।

পুরাণ অনুযায়ী মহালয়া

পুরাণ অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পিতৃলোকে বাস করেন। এই লোক স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। পিতৃলোকের শাসক মৃত্যুদেবতা যম। তিনিই সদ্যমৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং পরমাত্মায় লীন হন এবং এই প্রক্রিয়ায় তিনি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের উর্ধ্বে উঠে যান। এই কারণে, কেবলমাত্র জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে; এবং এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষ সূচিত হয়। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই সময় পূর্বপুরুষগণ পিতৃলোক পরিত্যাগ করে তাঁদের উত্তরপুরুষদের গৃহে অবস্থান করেন। এর পর সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে প্রবেশ করলে, তাঁরা পুনরায় পিতৃলোকে ফিরে যান। পিতৃগণের অবস্থানের প্রথম পক্ষে হিন্দুদের পিতৃপুরুষগণের উদ্দেশ্যে তর্পণাদি সম্পন্ন করতে হয়।

মহাভারত অনুযায়ী মহালয়া

ব্যাসদেব রচিত মহাভারতে কর্ণ সম্বন্ধীয় যে কাহিনি পাওয়া যায়, সেখানে বলা হয়েছে কর্ণ দান ধ্যান করলেও তা ছিল স্বর্ণ, রত্ন, মণিমাণিক্য। পিতৃপুরুষের পরিচয় না জানার জন্য পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে কখনো জল বা খাদ্য দান করেননি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মৃত্যুর পর স্বর্গে গেলে সেখানে তাঁকে খাদ্য হিসেবে দেওয়া হয় শুধুই সোনা-রত্ন। জীবিত অবস্থায় যা দান করেছেন তারই একটি অংশ। কর্ণকে দেবরাজ ইন্দ্র জানান যে পিতৃপুরুষকে কখনও জল দেননি তাই মৃত্যুর পরে কর্ণ জল পানে অক্ষম। এই ভুলের জন্য এক পক্ষকালে মর্ত্যে ফিরে গিয়ে পিতৃপুরুষকে জল ও অন্ন দিয়ে পাপস্খলন করেন কর্ণ। সেই এক পক্ষ কালকেই পিতৃপক্ষ বলা হয়। শাস্ত্রমতে এই এক পক্ষ কাল ধরেই পিতৃপুরুষকে অন্নজল দেওয়া যায়।

আরও পড়ুন- শুভ মহালয়া বলা কি ভুল? দিনটির তাৎপর্য জানলে চমকে যাবেন

তর্পণের রেওয়াজ বা পদ্ধতি

হিন্দুশাস্ত্রে নানারকম তর্পণের কথা বলা হয়েছে, যেমন, দেব তর্পণ, গুরু তর্পণ, মনুষ্য তর্পণ, ঋষি তর্পণ, দিব্যপিতৃ তর্পণ, যম তর্পণ, ভীষ্ম তর্পণ, পিতৃ তর্পণ, মাতৃ তর্পণ, অগ্নিদগ্ধাদি তর্পণ, রাম তর্পণ ও লক্ষণ তর্পণ। পিতৃপক্ষের শেষ লগ্নে তর্পণ করা হয় এই মন্ত্রের সঙ্গে-

“পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্ম্মঃ পিতা হি পরমন্তপঃ। পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়তে সর্ব্ব দেবতাঃ।”

গঙ্গাজল না হলে পরিষ্কার জল, কালো তিল এবং কূশ। ‘প্রাদেশ’ মাপের ছ’টি কূশ প্রথমে জলে ভিজিয়ে রেখে সেটা নরম হলে একত্রে তিনটি কূশ নিয়ে অনামিকা আঙুলে আংটির মতো ধারণ করে তর্পণ করতে হয়। কূশ ও তিল যদি না পাওয়া যায়, তবে শুধু জলেই তর্পণ করা যায়। ভিজে কাপড়ে জলে দাঁড়িয়ে কিংবা শুকনো কাপড় পরে এক পা জলে ও এক পা স্থলে রেখে পূর্ব দিকে মুখ করে তর্পণ করতে হয়। প্রথমে দু’বার আচমন, এরপরে বাঁ কাঁধে যজ্ঞপবীত (পৈতে) রেখে দেবতর্পণ করার রীতি। সবশেষে পিতৃপ্রণাম করে বলতে হয়- ওঁ পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্মঃ পিতা হি পরমন্তপঃ। পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়তে সর্ব্ব দেবতাঃ।

শাস্ত্রবিশেষজ্ঞরা জানান যে পিতৃপক্ষের অবসানে, অমাবস্যার অন্ধকার পেরিয়ে আমরা আলোকজ্জ্বল দেবীপক্ষকে আবাহন করি, তাই সেই মহালগ্ন আমাদের জীবনে ‘মহালয়া’। তর্পণের শেষে তাই সূর্যপ্রণাম করে অসুরবিনাশিনী দেবীকে আহ্বান করে বলা হয়- “সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে/ শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরি নারায়নী নমস্তুতে।"

More Articles