ইদের আগে রক্তে রাঙা আফগানিস্তান, নির্বিচারে গণহত্যায় দায় কার?

গত ১৯ এপ্রিল কাবুলের এক স্কুলের বাইরে বিস্ফোরণের ফলে মৃত্যু হয়েছিল ৬ জনের। বিস্ফোরণের দায় স্বীকার করেনি কেউই, তবু তালিবান নেতৃত্বের অভিযোগের আঙুল উঠেছিল ইসলামিক স্টেট খোরাসানের (আইএস-কে) জঙ্গিদের দিকে। রাষ্ট্রপুঞ্জের পক্ষ থেকে ঘটনাটিকে নিন্দাও জানানো হয়। এর ঠিক আটচল্লিশ ঘণ্টার মাথায় উত্তর আফগানিস্তানে ফের ঘটল বিস্ফোরণের ঘটনা। রামজান উপলক্ষে উত্তর আফগানিস্তানের একটি শিয়া মসজিদে প্রার্থনা চলছিল। ঠিক সেই সময় বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে মসজিদ প্রাঙ্গন। তালিবান সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, বিস্ফোরণের ফলে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৫ জনের। আহতদের সংখ্যা  ৫০ ছাড়িয়েছে। এবারের বিস্ফোরণেও কোনও জঙ্গি সংগঠন দায় স্বীকার করেনি। তবু, তালিবানরা ইসলামিক স্টেট খোরাসান কেই দোষারোপ করছে। আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ বিস্তর নাটকীয়তার সাক্ষী থেকেছে গত কয়েক মাস। আশরাফ গনির পতন ঘটিয়ে শাসনক্ষমতা কায়েম করেছে তালিবানরা। শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমনটা বলা না গেলেও বলা যায় বন্দুকের নলের সামনে নীরব জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন তামাম আফগানিস্তানবাসী। এরই মাঝে কেন আবার এই বিস্ফোরণ, মৃত্যু?

গত বছর প্রায় এক দশক আগেকার স্মৃতি উস্কে দিয়ে ফের আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে তালিবানরা। আর তারপর থেকেই  একের পর এক বিস্ফোরণে জর্জরিত হয়ে উঠেছে দেশ। তাদের অধিকাংশেরই দায় নিয়েছে ইসলামিক স্টেট খোরাসান। কিন্তু প্রশ্ন হল, তালিবান এবং আইএস, দুই সংগঠনের লক্ষই যদি ইসলামিক রাষ্ট্রব্যবস্থা স্থাপন করা হয়, তাহলে কেন প্রতিনিয়ত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে তারা? কেনই বা আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ কে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে? এর সম্ভাব্য উত্তর খুঁজতে গেলে চোখ রাখতে হবে ইতিহাসের দিকে।

আজ থেকে প্রায় ছ'বছর আগে আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইসলামিক স্টেট খোরাসান’ বা আইএস-কে। সংগঠনটির সরাসরি যোগাযোগ ছিল আইএস বা ‘ইসলামিক স্টেটে’র  সঙ্গে। ইতিপূর্বে পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের তালিবান গোষ্ঠী থেকে মতাদর্শগত বিরোধের ফলে  যে সকল কর্মীরা বেরিয়ে এসেছিলেন, তাঁরাই উদ্যোগ নিয়ে আইএস-কে তৈরি করেন। একসময় আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলিকে এক কথায় বলা হত ‘খোরাসান’। সেই কারণেই সংগঠনটির নামের পরে ‘খোরাসান’ শব্দটি যুক্ত করা হয়।

২০১৫ সালে সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়। সেই ভিডিওতে সংগঠনের নেতা হাফিজ সইদ খান জানান, এরপর থেকে তারাই নিয়ন্ত্রণ করবেন আফগানিস্তানের শাসনব্যবস্থা। যদিও, এ বক্তব্যের বাস্তব ভিত্তি বিশেষ ছিল না, কারণ সে সময়ে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি ছিলেন আশরাফ গনি। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, এর কাছাকাছি সময়ে আবু বকর আল বাগদাদির নেতৃত্বে সিরিয়ার ক্ষমতা দখল করেছিল ইসলামিক স্টেট। এ ঘটনা সারা পৃথিবীর ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির মনোবল বৃদ্ধি ঘটায়। হাফিজের বক্তব্য সম্ভবত সেই উচ্ছ্বাসেরই বহিঃপ্রকাশ।

আরও পড়ুন-তালিবান আতঙ্কেও আফগানিস্তানে পালিত হচ্ছে এই উৎসব

খাতায় কলমে ক্ষমতায় না থাকলেও আফগানিস্তানের বেশ কিছু অঞ্চলে জনজীবন নিয়ন্ত্রণ করত আইএস-কে। স্ট্যান্ডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড কোপরেশন’ তাদের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে নৈরাজ্য উস্কে দেওয়ার অভিযোগ এনেছিল। তাদের বক্তব্য ছিল আইএস-কের সদস্যরা আফগানিস্তানের আদিবাসী নেতাদের নির্বিচারে হত্যা করে। এ ছাড়াও, হাফিজ সইদ খানের তৈরি করে দেওয়া নিয়মাবলী কেউ মানতে অস্বীকার করলে তাকে প্রকাশ্যে হত্যা করে আইএস-কের সদস্যরা, এমনটাই ছিল তাদের অভিযোগ। অর্থাৎ, ২০১৬ নাগাদ সিরিয়ার রাকা শহরের যে চিত্র আমরা পাই, তার সঙ্গে আইএস-কে শাসিত আফগানিস্তানের বেশ কিছু মিল পাওয়া যায়।

২০১৯ সালে মৃত্যু হয় আইএসের  তথাকথিত খালিফা আবু বকর আল বাগদাদির। ততদিনে আইএস গোষ্ঠী এবং মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্রের দৌলতে সিরিয়া কার্যত ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে ইসলামিক স্টেট। এমতাবস্থায় বাগদাদির মৃত্যু  আইএস এবং আইএস-কের মনোবল ভেঙে দেয়। এ সময় থেকেই আফগানিস্তানে ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে তালিবানরা। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করাবার মতো শক্তি তখনও তাদের ছিল না। তা ছাড়া, পূর্বের অভিজ্ঞতার ফলে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষেও তাদের নিয়ে সন্ত্রস্ত ছিলেন। কিন্তু নানান প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তালিবানরা ধীরে ধীরে নিজেদের সংগঠন বৃদ্ধি করতে লাগল।

এর ঠিক দু বছরের মাথায় আশরাফ গনিকে ক্ষমতাচ্যুত করে কাবুলের দখল নিল তালিবানরা। আফগানিস্তানে ফিরে এল এক দশক আগেকার দুঃস্বপ্নের স্মৃতি। আইএস-কের সদস্যরা তালিবানদের ক্ষমতা দখলের উল্লাসের শরিক তো হলই না, উল্টে সেখানে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলতে লাগল।

এখানেই সম্ভবত এসে পড়ে তালিবান এবং আইএস-কের মতাদর্শগত বিরোধের প্রসঙ্গ। বিশেষজ্ঞদের মতে, আইএস-কে সারা পৃথিবীকে পরিণত করতে চায় ইসলামিক রাষ্ট্রে। তারা মনে করে খালিফা থাকবেন একজন, তিনিই হবেন সর্বশ্রেষ্ঠ, তার আওতায় থাকবে গোটা পৃথিবী। পক্ষান্তরে, তালিবানরা কেবলমাত্র বহির্শাসনমুক্ত আফগানিস্তানের দাবিকে সামনে রেখেই নিজেদের কার্যকলাপ চালায়। গোটা পৃথিবীকে ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করাবার কোনোরকম অভিপ্রায় তাদের নেই। সেই কারণেই আইএস-কের কাছ থেকে তারা ‘সঙ্কীর্ণতাবাদী’ আখ্যা পেয়েছে। অর্থাৎ ইসলামিক স্টেটের প্রাচীন রীতি মেনে যারা ‘ইসলামিক আন্তর্জাতিকে’র পক্ষে থাকবে না, তারাই হয়ে উঠবে আইএস-কের শত্রু।

আফগানিস্তান এবং আইএস-কের মতাদর্শগত বিরোধের ফল ভুগতে হচ্ছে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষকে। পবিত্র ঈদের আর বেশিদিন বাকি নেই। তবু আফগানিস্তান অশান্ত। এতদিন পর্যন্ত তাঁদের উপর অত্যাচার চালিয়েছে মার্কিন সৈন্যরা, আর আজ তাঁরা পদপিষ্ট হচ্ছেন একদল মৌলবাদীর দ্বারা। এই কি ছিল আফগানিস্তানের ভবিতব্য? প্রশ্ন থেকেই যায়।

More Articles