'সাড়ে চুয়াত্তর'-এর দজ্জাল গিন্নির আড়ালে রয়ে গেলেন দুঃসাহসী মলিনা দেবী

ছবিতে জঙ্ঘা অবধি কাপড় টেনে অনাবৃত করে রেখছেন মলিনা। কাপড়টা কোনওরকমে বুকের ওপরে জড়িয়ে রাখা। তিনের দশকে এই সাহসিকতা অন্য কোনও নায়িকা দেখিয়েছিলেন বলে মনে পড়ছে না।

বাংলা ছবির একেবারে গোড়ার দিকে ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিল্ম কোম্পানি নামে একখানা প্রোডাকশন হাউজ গড়েছিলেন ধীরেন গঙ্গোপাধ্যায়, দেবকী বসুরা। সেসময় ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, যাঁকে ডিজি বলেই চিনত সবাই, তিনি একপ্রকার নির্দেশনা জগতের তারকাই বলা চলে। যে সময়কার কথা, তখনও প্রমথেশ বড়ুয়া সিনেমায় নামেননি। বরং গৌরীপুরের রাজকুমার হিসেবেই তাঁর খ্যাতি। সেই খ্যাতি ধুয়েমুছে সিনেমার জগতের রাজপুত্র হয়ে উঠতে অবশ্য তাঁর এক দশকও লাগবে না। প্রমথেশ শুনলেন, ডিজি, দেবকী বসুরা 'পঞ্চশর' নামে একটা সিনেমা বানাচ্ছেন। ১৯২৯ সাল। দমদমের একটি বাগানবাড়িতে শুটিং চলছে। তা প্রমথেশ এসেছেন শুটিং দেখতে। অনেক লোক, কলাকুশলীরা তো রয়েছেনই, সঙ্গে রয়েছে সুযোগপ্রার্থীরাও, যাদের আজকাল 'স্ট্রাগলার' বলা হয়। হঠাৎ প্রমথেশের সামনেই শানবাঁধানো রাস্তার ওপর দুম করে উল্টে গেল এক কিশোরী। শাড়িতে পা জড়িয়ে গিয়েছে। কিছু না ভেবেই প্রমথেশ হাত ধরে টেনে তুললেন মেয়েটিকে। ও বাবা! এ যে আবার চোখ কটমট করে। সেই দৃষ্টির সামনে গৌরীপুরের রাজকুমার অপ্রস্তুতের একশেষ। মেয়েটি ভেবেছে, অচেনা লোক সুযোগ বুঝে বুঝি গায়ে পড়তে এসেছে। শেষে সেই অগ্নিদৃষ্টির হাত থেকে রাজকুমারকে উদ্ধার করলেন ডিজি স্বয়ং। মেয়েটিকে ধমক দিয়ে বললেন, "কার দিকে অমন চোখ পাকিয়ে দেখছ? জানো উনি কে?" জানল মেয়েটি। অনুতাপে, লজ্জায় এবার তার ক্ষমা চাওয়ার পালা। আর ক্ষমা! প্রথমে অগ্নিদৃষ্টি, এখন প্রকাশ্যে জনসমক্ষে ক্ষমা, গাড়িতে উঠে কোনওরকমে পালিয়ে বাঁচলেন প্রমথেশ। সেদিন কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি, এই মেয়ে কয়েক দশক বাংলা সিনেমায় রাজত্ব করে যাবে। পাওয়ার কথাও নয়।

মলিনা দেবীর অভিনয়জীবন শুরু ছেলের পার্ট করে। আট বছর বয়স থেকে মিনার্ভায় যাতায়াত। প্রথমে 'কিন্নরী'-তে, পরে 'মিশরকুমারী'-তে ঘুমভাঙা চোখে হাত-পা ঘুরিয়ে নাচ করতেন। সখীদের দলের ভিড়ে আলাদা পরিচিতি কিছুই ছিল না। টাকাপয়সা যেটুকু আসত, সংসারের অতল কুয়োয় মিলিয়ে যেত মুহূর্তেই। 'মিশরকুমারী'-তে 'আবন' চরিত্র করে অহীন্দ্র চৌধুরী সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। সেইসব অভিনয় ড্রেসিংরুম থেকে উঁকি মেরে দেখতেন মলিনা। দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়তেন কোনও ড্রেসের বাক্সের ফাঁকেই। ডাক এলে বড়রা টেনে তুলত। মঞ্চের সঙ্গে সেই পরিচয়। এরপর গার্জেনদের সঙ্গে টাকাপয়সা নিয়ে কিছু একটা ঝামেলা হয় মিনার্ভার। তখন বাড়ির লোকে তাঁকে নিয়ে এলেন মনমোহন থিয়েটারে। এখানেই নানা বালক চরিত্র। কিন্তু শরীর বাড়ছে। বেশিদিন কাজ থাকল না। স্টার থিয়েটারে দু'-একটা নাচের কাজ মিলল। এসবের মধ্যে প্রথাগত পড়াশোনার আর সুযোগ পাননি। অভিনয়েরও সুযোগ জুটছে না। সেই সময়েই প্রমথেশ কাণ্ড। লজ্জায় লাল হয়ে রাজকুমারের প্রস্থান। কাজ জুটল না 'পঞ্চশর'-এও।

এর পরের বছরটি বাংলা সিনেমার জগতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বছর। প্যারীচরণ সরকারের নাতি বীরেন সরকার লন্ডন থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিগ্রি নিয়ে কলকাতায় ফিরেছিলেন বছরতিনেক আগেই। ডালহৌসি পাড়ায় তাঁর অফিস। একদিন বিকেলে অফিস সেরে গাড়ি করে এলগিন রোডে নিজের বাড়ির দিকে ফিরছেন। ম্যাডান সিনেমার সামনে একটা দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন ভদ্রলোক। কী? না নতুন একখান ছবি, হাউজফুল হয়ে গিয়েছে, তবু শদুয়েক লোক 'টিকিট চাই', 'টিকিট চাই' বলে হাঙ্গামা জুড়েছে। কর্তৃপক্ষ যখন ঘোষণা করল, যত খুশি চেঁচামেচি হোক, সন্ধের শোয়ের টিকিট আর দেওয়া সম্ভব নয়, তখন ভিড়ের একটা বড় অংশ রাত ন'টার শোয়ের লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। বীরেন্দ্রনাথ দেখলেন ভারি মজা। কেমন ছবি, কী না কী, না জেনেই দেখার জন্য এত পাগলামি? এই ব্যবসাটা ধরতে পারলে আর দেখতে হবে না। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একখানা বিলের টাকা আদায় করতেই ন'মাস, ছ'মাস সময় লাগে। ফলে বীরেন সরকার নামলেন ফিল্মের জগতে। তৈরি হলো 'নিউ থিয়েটার্স' স্টুডিও। সেইখানে দাপুটে প্রোডাকশন ম্যানেজার বহাল হলেন জলু বড়াল।

আরও পড়ুন: একটিমাত্র হাঁচির দৌলতে পাঁচশো টাকা পারিশ্রমিক কমে গিয়েছিল ছবি বিশ্বাসের

এই বীরেন সরকারই প্রথম শরৎচন্দ্রের 'শ্রীকান্ত' চলচ্চিত্রায়িত করেন। যদিও তখন 'নিউ থিয়েটার্স' হয়নি। তার প্রাক-পর্বে 'ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্রাফটস' প্রতিষ্ঠা করেছেন বীরেন্দ্রনাথ। ১৯৩০-এর ২০ ডিসেম্বর সেই ছবি 'চিত্রা' হলে মুক্তি পেল। রাধা ফিল্মসের দশ রিলের নির্বাক ছবি। তাই তখন অনেক। নায়ক গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা কান্তিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি ডাহা ফ্লপ। কিন্তু সেই প্রথম ছবির পর্দায় মুখ দেখালেন মলিনা। জলু বড়ালের সঙ্গে আলাপ সেই সেটেই। জলু বড়ালই তাঁর 'মলিনমালা' নাম বদলে 'মলিনা' করে দিলেন। এরপর ১৯৩১-এ ম্যাডান কোম্পানির 'দেবী চৌধুরাণী' আর ফিল্ম ক্রাফটসের 'চাষার মেয়ে'-তে অভিনয়। বিশেষ কিছু রোল ছিল না, তবে 'চাষার মেয়ে'-র দৌলতে বেশ একটা পরিচিতি তৈরি হয়ে গেল। দেখতে দেখতে ১৯৩১-এ নিউ থিয়েটার্স তৈরি হয়ে গেল। মাসমাইনের পাকা চাকরি তখন শিল্পীদের। মলিনাও বাদ গেলেন না। প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর নির্দেশনায় রবীন্দ্রনাথের 'চিরকুমার সভা', 'নির্মলা'-র চরিত্রে মলিনা। এই প্রথম সবাক ছবিতে অভিনয়।

নির্বাক থেকে সবাক হয়ে ওঠা ছবির জগতে একটা বিপ্লবাত্মক ঘটনা। জাতীয়তাবাদের জায়গায় জোর পড়ে অস্মিতায়। সর্বভারতীয় তথা আন্তর্জাতিক বাজারের ছবি ছোট ছোট আঞ্চলিক ভাষার ঘেরাটোপে ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়। ডবল ভার্সন করে, একই সঙ্গে হিন্দি এবং বাংলা সংলাপে ছবি করেও এই ফাটল আটকানো সম্ভব ছিল না। ছবি এবং দর্শকের মাঝে কথা এসে পড়ায় যেসব অ্যাংলো পার্সি মেয়েরা লাস্যে-হাস্যে-রূপে স্ক্রিন আলো করে থাকত, তাদের অনেককেই সরে যেতে হলো ক্রমে অন্ধকারের দিকে। পুরনো অনেক শিল্পীই আর অভিনয়ে তাল রাখতে পারলেন না। ফলে সামনের সারিতে, বিশেষত মহিলা চরিত্রের এক বিশাল শূন্যতা তৈরি হলো। যার ফলে সেই স্থান ভরাট করতে দ্রুত এগিয়ে আসার সুযোগ পেলেন কানন দেবী, চন্দ্রাবতী, লীলা দেশাই, সুপ্রভা মুখোপাধ্যায়, মলিনা দেবীরা। গোটা তিনের দশক এঁরা দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে গিয়েছেন।

১৯৩৩ নাগাদ নিউ থিয়েটার্স থেকে বেরোল দেবকী বসুর 'দুলারি বিবি'। সাইগলের বিপরীতে তৃতীয় পক্ষের অসচ্চরিত্রা স্ত্রী-এর ভূমিকায় মলিনা দেবী। সেই সাহসী চরিত্র পরবর্তীতে বাংলার অভিনেত্রীদের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ হয়ে গিয়েছিল। সুজয় ঘোষের 'উত্তমকুমার ও স্বর্ণযুগ' বইটাতে রয়েছে সেই মলিনা অভিনীত চরিত্রটির ছবি। ছবিতে জঙ্ঘা অবধি কাপড় টেনে অনাবৃত করে রেখছেন মলিনা। কাপড়টা কোনওরকমে বুকের উপরে জড়িয়ে রাখা। তিনের দশকে এই সাহসিকতা অন্য কোনও নায়িকা দেখিয়েছিলেন বলে মনে পড়ছে না।

পরবর্তীতে একটু টাইপকাস্ট হয়ে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু অভিনয় করে গিয়েছেন চুটিয়ে। তখন নিউ-থিয়েটার্সের বাঁধা সংগীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিক এবং রাইচাঁদ বড়াল। রাইচাঁদ জলু বড়াল মানে বিষেণচাঁদ বড়ালের ছোট ভাই। রাইচাঁদের কাছেই গান শিখলেন মলিনা। ইতিমধ্যে ডাকসাইটে জলু বড়াল প্রেমে পড়েছেন মলিনার। বিষেণচাঁদ তখন বিবাহিত। সে অবস্থাতেই মলিনার সঙ্গে ফের বিয়ের পিঁড়িতে। এদিকে মলিনা ক্রমশ নিজেকে তৈরি করছেন। ললিতমোহন গোস্বামীর কাছে নাচ শিখেছেন, খেমচাঁদ প্রকাশের কাছে তালিম নিয়েছেন। অমর মল্লিকের কাছে অভিনয় শিখেছেন দিনের পর দিন। মুনসি আনগর হোসেনের কাছে রীতিমতো উর্দু এবং হিন্দি শিখেছিলেন ডবল ভার্সন ছবির জন্য। এই তুমুল পরিশ্রমের ফলও পেয়েছেন হাতেনাতে। 'এক্সকিউজ মি স্যার', 'মাস্তুতো ভাই' সেরে 'মহুয়া' হয়ে পৌঁছে গিয়েছেন 'অবশেষে', নায়ক সেই অপ্রস্তুত রাজকুমার প্রমথেশ বড়ুয়া। ১৯৩৬-এ বড়ুয়া সাহেবের পরিচলনায় 'গৃহদাহ' হচ্ছে। মৃণালের মতো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে মলিনা দেবীকে নিচ্ছেন তিনি। উত্তমযুগের 'সাড়ে চুয়াত্তর' থেকে 'ফুলু ঠাকুরমা', 'ফুলেশ্বরী'— কখনও দজ্জাল শাশুড়ি, কখনও স্নেহ-বিগলিত বউদি বা মায়ের চরিত্র। কয়েক দশক ধরে এইসব রোলেই তাঁকে দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল বাঙালি দর্শক। নাচ দিয়ে যাঁর অভিনয়জীবন শুরু, দেবকী বসুর ছবিতে সেই সাহসী চরিত্রাভিনেতাকে বাঙালি মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ নিজের মতো কেটেছেঁটে সাইজ করে নিয়েছিল। তিনি যে কী মাপের অভিনেত্রী ছিলেন, জানা যায় যখন দেখি শিশির ভাদুড়ী নিজে শ্রীরঙ্গমে তাঁকে অভিনয় করার অমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তরুণ মজুমদারের মতো নির্দেশক মুক্তকণ্ঠে তাঁর অভিনয় ক্ষমতার প্রশংসা করে গিয়েছেন। আর জানিয়েছেন, সেটের সবার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি রান্না করে নিয়ে আসতেন রোজ। মলিনা দেবী এবং অনুভা গুপ্ত—দু'জনেই এই কাণ্ড করতেন। কানন দেবীর সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন 'মহিলা শিল্পী মহল'। সেখানে শুধু মহিলারাই অভিনয় করতেন, পুরুষের চরিত্রে প্রায়ই অনুভা এবং মলিনাকে দেখা যেত। শোয়ের যাবতীয় আয় তুলে দেওয়া হতো দুঃস্থ মহিলাদের হাতে। মহিলা শিল্পীমহলের নাটক হলেই পাহাড়ী সান্যাল এবং হেমন্ত ছিলেন বাঁধা দর্শক। "হল হাউজফুল হোক, আমি সিঁড়িতে বসে দেখব"— বলতেন পাহাড়ী সান্যাল। আর হেমন্ত উইংসের পিছনে।

গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে 'এম জি এন্টারপ্রাইজ' গড়েছিলেন। নাটকের দল। 'রাণী রাসমণি' ও 'ঠাকুর রামকৃষ্ণ'— দু'টি নাটকই চূড়ান্ত হিট করেছিল। পরের দুই দশকে অন্তত বিশ হাজার শো করেছেন। গিরিশ সংসদ 'নাট্যাধিরাজ্ঞী' উপাধি দিয়েছে, '৭৬-এ পেয়েছেন সংগীত নাটক অ্যাকাডেমি সম্মান। গনেশ মুখোপাধ্যায়ের 'নদনদী'-ই শেষ নাটক। তারপর আর শরীরে নিত না। ১৯৭৭ সালের ১৩ অগাস্ট মারা গিয়েছিলেন মলিনা দেবী। রঙ্গমঞ্চের পিছনে, ড্রেস বক্সের ফাঁকে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে যে বছর আটেকের মেয়েটি যাত্রা শুরু করেছিল, প্রমথেশ বড়ুয়া পর্যন্ত যাঁর তীক্ষ্ণ নজরের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলেন, চার-চারটে দশক ছায়াছবির জগতে রাজত্ব করে গেলেন তিনি। আজ মলিনা দেবী নেই, কিন্তু রয়ে গিয়েছে তাঁর অবিস্মরণীয় ভূরি ভূরি কাজ, যা অতিক্রম করে বাংলা সিনেমার আলোচনা হয় না। নায়িকাদের সাহসী চরিত্রে অভিনয়ের আলোচনা হয় না। হয় না রিয়েলিস্টিক স্টাইলে অভিনয়ের আলোচনাও। অভিনয় জগতের সঙ্গে নিজের যাবতীয় অস্তিত্ব মিশিয়ে দিয়ে গিয়েছেন মলিনা দেবী, হয়েছেন চিরকালীন।

More Articles