রাম মন্দিরের পরেই দিঘাতে মমতার জগন্নাথ ধাম! ১৪৩ কোটির মন্দিরে কী থাকছে?
Digha Jagannath Dham : মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের বিরুদ্ধে বিজেপির তৈরি করা 'হিন্দু-বিরোধী' ইমেজ খানখান করে মন পেতে চাইছেন রাজ্যের হিন্দুদেরও।
২০২৪ কি মন্দির বর্ষ? বছর ঢোকার মুখেই দেশের রাজনীতির বাঁকবদলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরটি উদ্বোধনের কথা। রাম মন্দিরের আঁচ শুধু অযোধ্যা নয়, সারা দেশকে ছুঁয়েছে বিভিন্নভাবে। এমনকী বিরোধী রাজ্যেও বিজেপির এই মন্দির রাজনীতির ছায়া পড়েছে। ২০২৪ সালে এই রাজ্যেও আরেকটি মন্দির উদ্বোধন হতে চলেছে। দুই মন্দিরকে খুব আলাদাভাবে কি দেখা যায় এই প্রেক্ষিতে? দিঘায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৈরি করছেন জগন্নাথ ধাম। পুরীর সৈকত থেকে সোজা দিঘার সৈকত!
সমুদ্রতীরে অবস্থিত, নিউ দিঘা রেল স্টেশনের সংলগ্ন এই বিশাল জগন্নাথ ধাম ২২ একর জমি জুড়ে তৈরি হচ্ছে। একটি মন্দির গড়তে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রায় ১৪৩ কোটি টাকা খরচ করছে৷ সব হিসেব ঠিক থাকলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাধের এই প্রকল্প, ২০২৪ সালের মার্চ মাসে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এপ্রিলে তা ভক্তদের জন্যও খুলে দেওয়া হবে। জানুয়ারিতে রাম, এপ্রিলে জগন্নাথ! দেশের রাজনীতিতে মূর্তিমান ঈশ্বরের অবদান বা চাহিদা, দুই-ই এই মুহূর্তে আকাশছোঁয়া।
আরও পড়ুন- মোদির রামমন্দির উদ্বোধনে কেন ব্রাত্য লালকৃষ্ণ আদবানিরা?
বিজেপি বারবার বলেছে, মমতা 'হিন্দু বিরোধী'। কেবলই সংখ্যালঘু তোষণের 'অভিযোগ' ওঠে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। তাই বিজেপির হিন্দুত্ববাদকে কি হিন্দুত্ববাদ দিয়েই উত্তর দিলেন মমতা? জগন্নাথ ধাম কি রাজ্যের হিন্দু ভোটারদের মন কাড়ার প্রকল্প নয়? বিজেপি এইখানে আরেক নতুন কথা তুলে ধরেছে। পুরো মন্দির প্রকল্পকেই ব বিজেপি বলছে 'প্রহসন'। বিজেপির দাবি, কোনও রাজ্য সরকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তৈরিতে সাধারণ মানুষের করের অর্থ ব্যবহার করতে পারে না। তৃণমূল বলছে, স্থানীয় মানুষদের কথাকে মান্যতা দিয়েছেন মাত্র তারা!
স্থানীয় সাধারণ মানুষের একাংশ মন্দির উদ্বোধনের অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। মন্দির মানেই পাশাপাশি আরও নানা কর্ম সংস্থান। মন্দির মানেই প্রচুর পরিমাণে পর্যটক এবং ভক্তদের আগমন। মানেই ব্যবসা। হোমস্টে, হোটেল এবং দোকানের রমরমা, বৈদ্যুতিক রিকশার ভিড়।
জগন্নাথ ধাম তৈরি করছে পশ্চিমবঙ্গ হাউজিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (ডব্লিউবিএইচআইডিসিও)। মন্দিরের নকশা এবং স্থাপত্যের দিকটি দেখছে কলকাতার সেলিয়েন্ট ডিজাইন স্টুডিও। এই ডিজাইন স্টুডিওই সিটি সেন্টার পাটনা, কলকাতার বিলাসবহুল তাজ তাল কুটির, বুটিক হোটেল রাজকুটির, মাদারের মোমের জাদুঘর, মিলন মেলা কনভেনশন সেন্টার এবং বাংলা মিষ্টি হাবের নকশাও করেছে।
জগন্নাথ ধামের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল ২০১৯ সালে, কোভিড আসার ঠিক আগে। কোভিডের ফলে তিন বছর পর নির্মাণকাজ শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি ওড়িশা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ এবং রাজস্থান থেকে ১,০০০-এরও বেশি নির্মাণ শ্রমিক মন্দির গড়ার কাজ করছেন দিনরাত। শ্রমিকদের মধ্যেই রয়েছেন আগ্রার লিয়াকত আলি। ৭২ বছর বয়স তাঁর। খোদাইয়ে দক্ষ শিল্পী। তাঁর অধীনে, ১৫-২০ জন কর্মীর দল রাজস্থানের বিশেষ বংশী পাহাড়পুর বেলেপাথর দিয়ে তৈরি দেওয়ালে নকশা খোদাই করছে। উল্লেখ্য, এই একই পাথর অযোধ্যার রাম মন্দির নির্মাণেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
পাথরের উপর কোনও নকশা বা ছবি খোদাই করতে ১০-১৫ দিন সময় লাগে। ওড়িশার শিল্পীরা ৮ ফুট বেলেপাথরের খণ্ড খোদাই করে একটি সিংহ তৈরি করেছে। মন্দিরের মূল প্রবেশদ্বারে বসানো হবে এই সিংহ৷ মন্দির চত্বরে এবং এর চারপাশে দু'টি বাঘ এবং ৬৯টি সিংহ বসানো হবে। পুরীর মন্দিরের দু'টি দরজায় বাঘ এবং সিংহ রয়েছে। শ্রমিকদের আরেকটি দল মন্দিরের গর্ভগৃহের উপর কাজ করছেন। সেখানে ২১৪ ফুট উচ্চতার একটি টাওয়ার হবে।
আরও পড়ুন- দিঘা-মন্দারমণি ফেল! এই ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’-ই এখন বাংলার সেরা উইকেন্ড ট্যুরিস্ট স্পট
এতটা উচ্চতায় কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকরা সমস্যায় পড়ছেন। অনেকেই চূড়ায় উঠে কাজ করতে রাজিও হচ্ছেন না। নতুন নতুন কর্মীর খোঁজ তাই লেগেই আছে নিয়ত। যাতে অনেক উঁচু থেকে নীচে তাকিয়ে সমস্যা না হয় তাই টাওয়ারটিকে সবুজ কাপড়ে ঢাকা হয়েছে। ভিয়েতনাম থেকে আনা মার্বেল দিয়ে মন্দিরের মেঝে তৈরি করা হবে।
মন্দির প্রাঙ্গণে দু'টি প্রবেশপথ থাকবে, একটি সাধারণ ভক্তদের জন্য এবং অন্যটি ভিআইপিদের জন্য। বাগানে ঘেরা মন্দিরটিতে আলাদা করে স্টোররুম, ভোগ খাওয়ার জায়গা এবং পার্কিংয়ের সুবিধাও থাকবে। যে জায়গায় মন্দিরটি হচ্ছে, সেখানে ছিল বালিয়াড়ি। গাছের ছাউনি ছিল। হামেশাই বাংলা সিনেমার শ্যুটিং হতো সেখানে। সেখানে বাংলার অন্যতম বড় মন্দির তৈরি হবে ২০২৪ সালের মতো গুরুত্বপূর্ণ বছরে।
বিজেপির বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী বলছেন, দেশের সংবিধান সরকারকে কোনও ধর্মীয় কাঠামো নির্মাণের অধিকার দেয় না। রামমন্দির কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বা ইউপি সরকার তৈরি করছে না। শ্রী রাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্ট এই রাম মন্দির তৈরি করছে। কিন্তু সকলেই জানেন, ট্রাস্টের নেপথ্যে বড় মদত রয়েছে কাদের। ঠিক তেমনই বিচক্ষণ মাত্রই বুঝতে পারছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন ২০২৪ সালেই দিঘাতে এত বড় মন্দির তৈরি করতে চলেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের বিরুদ্ধে বিজেপির তৈরি করা 'হিন্দু-বিরোধী' ইমেজ খানখান করে মন পেতে চাইছেন রাজ্যের হিন্দুদেরও। ফলে ধর্মের রাজনীতি প্রসঙ্গে বিজেপি আর তৃণমূল যে একই কৌশলের খেলোয়াড় তা বলতে দ্বিধা নেই।