শহুরে জীবন চাকরি ছেড়ে ফিরে গিয়েছেন প্রকৃতির কাছে, অনুপ্রেরণা হতে পারেন এই ইঞ্জিনিয়র

জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, 'দূরে কাছে কেবলি নগর, ঘর ভাঙে/ গ্রাম পতনের শব্দ হয়।' একুশ শতকে দাঁড়িয়ে কেবলই গ্রাম এসে মিলিত হয় শহরে। নগরজীবনের স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগের আশায় কত মানুষ নগরে আসেন। কিন্তু স্রোতের বিপরীতে ও তো কেউ কেউ হাঁটে। অপুরা ফিরে যায় নিশ্চিন্তিপুর। নগরজীবনের বিলাস ছেড়ে  ফিরে হাজির হন প্রকৃতির কাছে। আমাদের গল্প আজ এমন একজন মানুষকে নিয়েই। ৫৯ বছরের নরেন্দ্র পিতালে পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। পুনের মত শহরে জীবনযাপনের বিরাট এক সংস্থান ছেড়ে তিনি ফিরে গিয়েছেন শিলিম্ব নামে একটি ছোট গ্রামে। কোনও আধুনিক ধাঁচের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরবাড়ি নয়, জীবনযাপনের জন্য নরেন্দ্র বানিয়েছেন মাটির ঘর। প্রকৃতির সঙ্গে এই সহাবস্থান কেবল জীবনধারণের খরচকে কমায়নি, দিয়েছে অগাধ শান্তি, যে শান্তির খোঁজ নগরজীবনে জনমভর খুঁজলেও পাওয়া মুশকিল।

নরেন্দ্রর নিজের কথায়, “আমার এই সিদ্ধান্ত রাতারাতি তৈরি হয়নি। আমি অনেক ভেবেছি। শৈশব থেকেই গ্রাম জীবনের শান্তি আমাকে টানে। এই বিষয়ে বিস্তর জেনেই আমি পাকাপাকিভাবে গ্রামে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

নরেন্দ্রর পেশা ছিল মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। চাকরির পাশাপাশি কনসালটেন্ট হিসেবে ও তিনি কাজ করতেন। কিন্তু কোনও কাজেই সেই প্রাণের আরাম, মনের শান্তি ছিল না। নরেন্দ্রকে টানত গ্রাম্য জীবন, কৃষি কাজ এবং প্রকৃতি।

এই প্রসঙ্গে নরেন্দ্র বলছেন, “ গ্রামীণ প্রকৃতি এবং পরিবেশ নিয়ে আমি এতটাই উৎসাহিত ছিলাম যে আমার কাজের মধ্যে সময় বের করেই আমি এর ওপর একটি স্পেশালাইসড কোর্স করি। এই সব কিছুর মধ্যে দিয়েই আমি বুঝতে পারি আমরা শহরে যেভাবে বেঁচে আছি তা প্রকৃতির জন্য খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়। প্রকৃতির প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই আমি সিদ্ধান্ত নিই শহর ছাড়ার। আমি এমন জায়গায় থাকতে চেয়েছিলাম যা প্রকৃতির খুব কাছাকাছি হবে”

২০০৪ সালে ইকোলজির উপর করা এই কোর্স নরেন্দ্রর জীবনভাবনাকে বদলে দেয়। অল্পবয়স থেকেই ট্রেকিং ভালবাসতেন তিনি। প্রকৃতির শান্ত সমাহিত রুপ নরেন্দ্র আবার নতুন করে বুঝেছিলেন ট্রেকিং করার সময়। তারপর থেকেই অল্প অল্প করে বদলাতে শুরু করে নরেন্দ্রর জীবন। সপ্তাহের শেষে বা ছুটির দিনগুলোতে চলে যেতেন কাছাকাছি গ্রামে। প্রকৃতির মধ্যে থেকে গ্রামজীবনকে দেখার সেই শুরু।

নরেন্দ্রর এক বন্ধুর প্রায় ২০ একর জমি ছিল লোনাভেলার কাছে অবস্থিত ছোট গ্রাম শিলিম্বে। দেরি করেননি তিনি। বন্ধুর জমিতে গড়ে তুললেন এক কৃষি- পর্যটন কেন্দ্র। নরেন্দ্রের মতে, “ আমি ছোটবেলা থেকেই শুনছি বড়রা বলতেন কৃষি কাজই হতে পারে সব থেকে ভালো পেশা। তারপর অন্য কোনও কাজ। কিন্তু বাস্তবে দেখি সবাই এর উল্টোটাই করে।এসব দেখেই আমি বন্ধুর জমিতে ইকোটুরিস্ট সেন্টার তৈরির সিদ্ধান্ত নিই এবং নিজের জন্য গ্রামের ভিতর একটা ছোট বাড়ি বানাই। আমি চেয়েছিলাম মানুষ প্রকৃতির মধ্যে এসে কিছুটা সময় কাটিয়ে যাক”

তিনমাসের মধ্যে বাড়িটি তৈরি হয়। ৫০০ স্কোয়ার ফিটের এই বাড়িতে আছে একটি শোবার ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম এবং একটি ছোট বারান্দা। এই বাড়ি বানাতে খরচ পড়েছিল প্রায় দু'লাখ টাকা।

কেমন সেই বাড়িটি?

বাড়িটি পুরোটাই মাটি এবং স্থানীয় সূত্রে পাওয়া কিছু আগে ব্যবহৃত জিনিস দিয়ে তৈরি। বাড়িটিতে প্রায় সবই পুরনো জিনিস ব্যবহার করা হয়েছে।দরজা জানলা এবং মেঝের টাইলস সবই পুরোনো। মাটির দেওয়ালকে মজবুত রাখতে স্থানীয় কাঠের আবরণ ব্যবহার করা হয়েছে।

এই বাড়ির সবচেয়ে মজার জিনিস হল গোটা বাড়ি তৈরিতে মোটে এক বস্তা সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। বাথরুম তৈরির সময়ই কেবল সিমেন্টের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে।

বাড়ির মেঝে পুরোটাই মাটির। তিনমাস অন্তর মেঝে ভালো রাখতে ঘুঁটে লেপা হয়। দেওয়ালে মাটির আবরণ থাকায় বাড়িটি খুব গরমের সময়েও ঠাণ্ডা থাকে। এছাড়াও এই বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা আছে। নরেন্দ্র এই বাড়িতে ১০০ ওয়াটের সোলার প্যানেল বসিয়েছেন যা এখানকার দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের যোগান দেয়।

চারমাস হল নরেন্দ্র কনসালটেন্সির কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। নরেন্দ্র জানালেন, “এই কাজ করার সময় আমাকে প্রায় রোজই পুনে যেতে হত। এই কারণে রান্নাঘর লাগোয়া বাগানের পিছনে সময় দিতে পারতাম না। কাজটা ছেড়ে দেওয়ার পর আমি সবসময় এখানেই থাকি এবং আমার বাগানের পরিচর্যা করি”

এখানেই থামতে চান না নরেন্দ্র। তাঁর লক্ষ্য আরও বড়। তাঁর কথায়, “ বহু মানুষই  এই বিষয়টা নিয়ে ভাবছে কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছে না। সুরক্ষা এবং স্থায়িত্বই তাদের মূল ভাবনা। কিন্তু আমার মনে হয় সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে মানুষের ভাবনাকে। কারC সেটা দ্রুত বদলাচ্ছে। এই ভাবনাই হয়তো একদিন আমাদের সাথে প্রকৃতির আরও নিবিড় মেলবন্ধন ঘটাবে। যে মানুষ এইভাবে থাকতে চায় আমি তাদের পাশে আছি”।

More Articles