খরগোশের অভিব্য়ক্তি নকল করে দেখাতেন শাঁওলী মিত্র

আমার স্ত্রী রঞ্জনা 'পঞ্চম বৈদিকে' ছিলেন, সেই সূত্রে শাঁওলীদির সঙ্গে আমার আলাপ। আমি তখন 'রূপদক্ষ' নামে একটা ছোট্ট দলে কাজ করি। তারপর শাঁওলীদির সঙ্গে আলাপের সুবাদেই যুক্ত হয়েছিলাম 'পঞ্চম বৈদিকে'-এ। শাঁওলীদি যাকে পছন্দ করতেন তার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা বাড়তে সময় খুব বেশি লাগত না। ঘটনাচক্রে আমিও সেই ভাগ্যবানদের একজন হয়েছিলাম। গোড়ার দিকে আমার দায়িত্ব ছিল সময় সুযোগ মতো দলের কিছু ছোটখাট কাজ করে দেওয়া। এ ছাড়াও অভিনয়ের দিন থাকত আরও কিছু কাজ। থিয়েটারে যে ধরনের কাজ থাকে সেগুলিই করতাম ভালোবেসে। তখন 'নাথবতী অনাথবৎ' আর 'কথা অমৃত সমান'-এর রিহার্সাল চলছে পুরোদমে। তার পাশাপাশি মহলাকক্ষে চলছে কণ্ঠস্বরের ব্যবহার এবং আবৃত্তির তালিম। সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়ে শাঁওলীদির সঙ্গে আমার যোগাযোগ ক্রমেই বাড়ছিল। 

এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ ঘাড়ে একটা গুরুদায়িত্ব এসে পড়ল। যেদিন 'পঞ্চম বৈদিকে'র অভিনয় থাকবে সেদিন শম্ভু মিত্র (আমরা জ্যেঠু বলতাম) যদি অভিনয় দেখতে চান, তাহলে আমাকে ওঁকে বাড়ি থেকে প্রেক্ষাগৃহে নিয়ে যেতে হবে। জ্যেঠুর চোখে তখন হাই পাওয়ার। বয়সও হয়েছে বেশ ভালোই। যাই হোক, সেই সুযোগ পেয়ে তো হতে চাঁদ পেলাম। বাড়ি থেকে প্রেক্ষাগৃহে যেতে যেতে ট্যাক্সিতে নানান রকম কথাবার্তা হত তাঁর সঙ্গে। সে যে কী ঐশ্বরিক অভিজ্ঞতা, তা আমার পক্ষে ভাষায় বর্ণনা করা খুবই কঠিন। 

অবশেষে এসে পড়ল সেই বহু আকাঙ্খিত দিন। বিশেষ দরকারে ডাক পড়ল মহলাকক্ষে। গিয়ে জানলাম 'পঞ্চম বৈদিক' একটা পূর্ণাঙ্গ নাটক পরিচালনার কথা ভাবছে এবং আমাকে সেখানে বেশ বড় একটা চরিত্রের জন্য ভাবা হয়েছে। নাটকটার নাম 'বিতত বিতংশ', আমার চরিত্রের নাম নরেন। সেই সময় দেখেছিলাম, কী অপরিসীম পরিশ্রম উনি করতেন এক একটা চরিত্রকে সম্পূর্ণ অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিতে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ডিটেলস এবং সূক্ষাতিসূক্ষ চলন, অভিব্যক্তি এমনভাবে দেখাতেন যে সে অভিজ্ঞতা যাদের ঘটেনি তাদের বলে বোঝানো খুবই মুশকিল। নাটকটা যখন মঞ্চস্থ হলো তখন দারুন সাড়া ফেলে দিয়েছিল।  

এ প্রসঙ্গে বলতে লোভ হচ্ছে। আমি যে চরিত্রটায় অভিনয় করতাম, সেটা ছিল একটা বহুজাতিক সংস্থার একজিকিউটিভের। প্রোজেক্টের কাজে মগড়াডিহি নামক একটা গ্রামে সে এসেছে। অত্যন্ত ধূর্ত  এবং সবসময় তৎপর সেই লোক। শাঁওলীদি একদিন ডেকে বললেন, 'খরগোশ সামনে থেকে দেখেছিস কোনোদিন? সবসময় কেমন এলার্ট থাকে দেখেছিস? যে মুহূর্তে বিপদ আসবে সেই মুহূর্তে পালাবে। ওই বিহেভিওরটা অ্যাডাপ্ট কর।' তারপর আমায় একটা খরগোশের অভিনয় করে দেখালেন, ম্যানারিজমটা বোঝানোর জন্য। আমার মনে হল সত্যিই যেন একটা খরগোশ মানুষের পোশাকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কী নিখুঁত সেই ভঙ্গিমা! প্রত্যেকটা মুভমেন্ট, ডেলভারি হাতে ধরে শেখাতেন। গলার ব্যবহার আমার ওখানেই প্রথম শেখা, তারপর কিছুটা জ্যেঠুর কাছে, কিছুটা বিজয়লক্ষীদির কাছে। উনিও সে সময় ছিলেন 'পঞ্চম বৈদিকে'। হারমোনিয়াম বাজিয়ে এক অক্টেভ থেকে আরেক অক্টেভে গলা কীভাবে নিয়ে যেতে হয়, সেটা শাঁওলীদি দেখিয়ে দিতেন যত্ন করে।

ক্রমে দলের গণ্ডী পেরিয়ে ব্যক্তিগত স্তরে যোগাযোগ বাড়তে লাগল। মহলার অবকাশে আমাদের সঙ্গে খেলার ছলে ওই বয়সেও এমন সমস্ত শারীরিক কসরৎ করতেন যে খানিকটা ঈর্ষাই হত।  এমন প্রাণোচ্ছল একজন মানুষ এবং কী অসম্ভব ভালো তাঁর সেন্স অফ হিউমর। প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করার দৌলতে নানান জায়গায় ট্যুর করে বেড়াতে হত আমাকে। এয়ারপোর্ট পৌঁছে নিয়ম করে শাঁওলীদিকে ফোন করতাম, আর করলেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে উত্তর আসত, 'এ কোথাকার গেছো দাদা রে?' ওঁর সঙ্গে কাটানো প্রত্যেকটা মুহূর্তে এখন বড্ড বেশি করে মনে পড়ে। শাঁওলীদি চলে গিছেন প্রকৃতির নিয়মে। কিন্তু তবু, উনি নেই, এটা আমরা যারা ওঁকে সামনে থেকে দেখেছি তাদের কাছে যেন একটা অবাস্তব খবর।

More Articles