'ভূত'কে খুন করার অপরাধে আদালতে মামলা! ভারতের বিচিত্রতম শুনানির নেপথ্যে ছিল যে সত্য...

Murder of 'Ghost': রামবাহাদুর সবার আগে ছুটে যায়। ছুটতে ছুটতেই কোমর থেকে বার করে ফেলে কুকরি এবং হাওয়ায় ঘোরাতে থাকে সেটি।

ভারতের সংবিধানে যে মৌলিক কর্তব্যগুলির কথা উল্লেখ করা রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার কথা। ভারতের সংবিধানে লেখা রয়েছে, বৈজ্ঞানিক চিন্তন, মানবিকতা এবং কৌতূহলের প্রসার বাড়ানো প্রত্যেক ভারতীয়র কর্তব্য। তবুও ভারতে বিজ্ঞানের পথে চিন্তাভাবনা করা মানুষের অভাব রয়েছে। নেতা থেকে অভিনেতা, ব্যবসায়ী থেকে খেলোয়াড়- সব তাবড় বিখ্যাত মানুষদের অনেককেই বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার মানতে দেখা যায়। কুসংস্কারে অর্থাৎ 'কালাজাদু’, ভূত-প্রেত, টোটকা প্রভৃতিতে বিশ্বাস করেন অনেকেই। আজও সমাজের একটা বড় অংশের মানুষ কালো বিড়ালের সামনে দিয়ে যাওয়া, হাঁচি দেওয়া, গায়ে টিকটিকি পড়া প্রভৃতিকে অশুভ মনে করেন। অনেকে আবার যুক্তি দেন, যারা যা মানতে চাইছে তাদের মানতে দিলে অসুবিধা কোথায়? যে যার বিশ্বাস নিয়ে বাঁচলে সমাজের তো কোনও ক্ষতি হচ্ছে না, তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা যে কোথায়, কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাস যে কতটা মারাত্মক হতে পারে, তারই একটি উদাহরণ এই ঘটনা।

সাল ১৯৫৮। ওড়িশার বালেশ্বরের কাছে একটি ছোট্ট গ্রাম রসগোবিন্দপুর। রসগোবিন্দপুরে একটি ছোট অকেজো এয়ারপোর্ট ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি করা হলেও বর্তমানে আর কাজে লাগে না সেটি। খালি বিমানবন্দরে যাতে কোনও অসামাজিক কাজ কর্ম না হয়, সেইজন্য দু'জন দারোগা নিয়োগ করেছিল ওড়িশা সরকার। এই সময় কলকাতার ডাকসাইটে ব্যবসায়ী জগবন্ধু চট্টোপাধ্যায় আসেন রসগোবিন্দপুরে। তাঁর সঙ্গে আসেন তাঁর চাকর রামবাহাদুর থাপা। জগবন্ধু চট্টোপাধ্যায় ওই বিমানবন্দরটি কিনতে চাইছিলেন, কিন্তু কিছুতেই সুবিধা করতে পারছিলেন না। ফলত কয়েক মাস রসগোবিন্দপুরেই থেকে যেতে হয় তাঁকে। এয়ারপোর্টের দুই ধারে বসতি ছিল সাঁওতাল এবং মাঝি সম্প্রদায়ের মানুষদের। ২০ মে ১৯৫৮, রাতে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে ছিলেন জগবন্ধু এবং রামবাহাদুর। কিছুক্ষণ পর সেখানে আসেন চন্দ্র মাঝি নামের এক ব্যক্তি। দোকানে চা খেতে খেতে তিনি দোকানিকে বলেন, আজ তার বাড়ি ফেরা হবে না। হবে না কারণ, তার বাড়ি যেতে পড়ে সেই বিমানবন্দরটি। রাত্রিবেলা সেখানে ভূতের উপদ্রব আছে। সুতরাং আজকের রাতটা এখানেই কোথাও কাটিয়ে, পরদিন সকালে বাড়ি ফিরতে হবে।

আরও পড়ুন- গুয়াহাটির জঙ্গলে ভূতের নাচ! সরাইঘাটের যুদ্ধে যেভাবে মুঘলদের হারিয়েছিল অহমরা

রসগোবিন্দপুর বিমানবন্দর

ভূতের কথা শুনেই উৎসাহী জগবন্ধু বলে বসেন, তিনি ভূত দেখতে চান। চন্দ্র মাঝি তো কিছুতেই রাজি হবেন না। অবশেষে কিছু টাকার বিনিময়ে চন্দ্র মাঝিকে রাজি করানো গেল। ঠিক হলো রাত আরেকটু বাড়লে, জগবন্ধু চট্টোপাধ্যায়, রামবাহাদুর, চন্দ্র মাঝি এবং ওই চায়ের দোকানি কৃষ্ণচন্দ্র মিলে যাবেন এয়ারপোর্টে ভূত দেখতে। চারজন যখন বিমানবন্দরের থেকে ৩০০ মিটার দূরে ছিলেন, তখন একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পান জগবন্ধু। বিমানবন্দরের দিক থেকে একটি হলদে আলো দেখা যাচ্ছে, হাওয়া প্রচণ্ড বেগে বইছে। ফলত দূর থেকে দেখলে মনে হচ্ছে আলোগুলি নাচছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই আলোর মধ্যে কয়েকটি ছায়ামূর্তি দেখা যায়। চারজনেই ছুট লাগান সেই আলোর দিকে।

রামবাহাদুর সবার আগে ছুটে যায়। ছুটতে ছুটতেই কোমর থেকে বার করে ফেলে কুকরি এবং হাওয়ায় ঘোরাতে থাকে সেটি। ভয়ের চোটে আশেপাশে কিছু না দেখেই এলোপাথাড়ি কুকরি চালাতে শুরু করে রামবাহাদুর। রামবাহাদুরের কুকরির ঠেলায় ঘায়েল হয়ে যান পিছনে ছুটে আসা কৃষ্ণচন্দ্রও। বাকিদের গলার আওয়াজে রামবাহাদুর থামলে দেখা যায় এয়ারপোর্টের ওই প্রান্ত থেকেও ছুটে আসছে মানুষ। কিছুক্ষণ পর সবটা পরিষ্কার হয়। যে হলদে আলো দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল সেটি আসলে ছিল মশালের আলো। রামবাহাদুর যাদের ভুত ভেবে কুকরি দিয়ে আঘাত করেছিল তারা আসলে নিকটবর্তী গ্রামের কয়েকজন মহিলা। তারা রাতের অন্ধকারে এসেছিল মহুয়ার ফুল তুলতে। রামবাহাদুরের কুকরির আঘাতে একজন মহিলা ওখানেই মারা যান এবং দু'জন মহিলা গুরুতর আহত হন। ভূত-ভূত বলে প্রচার করার ফলে, এক ভয়াবহ অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায়। একজন সুস্থ-সবল মহিলা বেঘোরে প্রাণ হারান।

আরও পড়ুন- বাচ্চারা কাঁপত সেই ‘ভূত’ দেখে! কলকাতায় এককালে চালু ছিল এইসব আজব খেলা

ভারতীয় আইনব্যবস্থার ক্ষেত্রেও এই ঘটনাটি একটি মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়। ওই ঘটনা ঘটার পর তৎক্ষণাৎ সেখানে পুলিশ আসে। খুন এবং খুন করার প্রচেষ্টার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় রামবাহাদুরকে। এরপর মামলা ওঠে আদালতে। কয়েক মাস শুনানি চলে এবং বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয় রামবাহাদুরকে। সাক্ষী এবং রামবাহাদুরের নিজের স্বীকারোক্তি সত্ত্বেও মুক্তি দেওয়া হয় তাকে। কেন? এটি বোঝার জন্য আইনের একটি নীতি সম্বন্ধে জানতে হবে। পৃথিবীর সব দেশের আইনেই একটি কথা বলা আছে, ‘Ignorerntia facti excusat, ignorantia juris non excusat’। এর অর্থ হল- তথ্য না জেনে কেউ কোনও ভুল করলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া যায়, কিন্তু আইন না জেনে কেউ অপরাধ করলে তার কোনও ক্ষমা নেই। একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। ধরুন, আপনি কোন দেশে গেছেন যেখানে ইঁদুরকে খুব পবিত্র বলে মানা হয়। কিন্তু আপনি না জেনেই একটি ইঁদুর মেরেছেন এবং আপনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আপনি যথারীতি আদালতে গিয়ে বললেন, “আমি জানতাম না ইঁদুর মারা বেআইনি”। এক্ষেত্রে আপনি আইন না জানার অপরাধ করেছেন। ফলত আপনার শাস্তি অনিবার্য। তবে আপনি যদি কোর্টে গিয়ে বলেন, “আমি জানতাম না যে ইঁদুরকে এই দেশে পবিত্র বলে মানা হয়। জানলে আমি কখনই মারতাম না,” এক্ষেত্রে আপনার শাস্তি মকুব হয়ে যেতে পারে। কারণ আপনি একটি অপরাধ করেছেন, পর্যাপ্ত পরিমাণে তথ্য না থাকার কারণে। ভারতে আইপিসির ৭৯ নম্বর ধারায় এর উল্লেখ আছে।

রামবাহাদুরের ক্ষেত্রেও এই একই জিনিস প্রযোজ্য হয়। রামবাহাদুর থাপা জানত না যে ওই আলোর মধ্যে কোনও মানুষ আছে। সে তো ভূত ভেবে কুকরি চালিয়েছিল, কোনও মানুষকে মারার জন্য তো কুকরি চালায়নি। এক্ষেত্রে যে অপরাধটি হয়েছে, তা ভুল তথ্যের কারণে হয়েছে। এই মামলার শুনানি চলাকালীন ছয় বছর পুরনো অর্থাৎ ১৯৫২-র একটি ঘটনার উল্লেখ টেনে আনা হয়। চিরঞ্জি এবং তার ছেলে জঙ্গলে গিয়েছিল পাতা কুড়ানোর জন্য। চিরঞ্জি পা পিছলে পড়ে যান এবং তার মাথায় চোট লাগে। মাথায় চোট লেগে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে তিনি তার ছেলেকে হত্যা করেন। আদালতে গিয়ে জানা যায়, পাথরে চোট লাগার কারণে মতিভ্রম হয়েছিল চিরঞ্জির। সে নিজের ছেলের জায়গায় বাঘ দেখে। তাই বাঘকে মেরে দেয় সে। কিন্তু আসলে বাঘ ভেবে নিজের ছেলেকেই মেরেছিল চিরঞ্জি। আদালত রায় জানায়, সঠিক তথ্য না থাকার কারণে চিরঞ্জি অপরাধ করে ফেলেছে। তাই সে ক্ষমার যোগ্য। এই একই যুক্তি খাটে রামবাহাদুরের ক্ষেত্রেও। তাই খুন করা সত্ত্বেও বেকসুর খালাস হয়ে যায় রামবাহাদুর।

More Articles