ভয়াবহ মিসাইল রাশিয়ার হাতে! ইউক্রেনের পর পুতিনের টার্গেট কে?

পুতিনের বক্তব্য পরিষ্কার, জার্কনের মাধ্যমে এইসব ‘নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়া শক্তিকেন্দ্র’-গুলোকে আক্রমণ করা যাবে কয়েক মিনিটের মধ্যে। সেই ক্ষমতা রাশিয়ার রয়েছে।

এ-বছর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সাক্ষী থেকেছে সমস্ত বিশ্ব। যুদ্ধের ক্ষত এখনও শুকোয়নি। পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়ে প্রমাদ গুনেছে গোটা দেশ। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে হয়ে গিয়েছে নগ্ন প্রতিরোধ, হয়েছে আরও নানা স্তরের প্রতিবাদ। রাশিয়ান সেনাদের বিরুদ্ধে একের পর এক গণধর্ষণের অভিযোগ তুলেছে ইউক্রেন। তুলেছে শিশু ধর্ষণের অভিযোগও। ধারাবাহিক এইজাতীয় ঘটনায় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জও খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। কিন্তু তাও থামছে না অস্ত্রের ঝংকার। ইতোপূর্বে জানা গিয়েছিল, আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম পারমাণবিক অস্ত্রশক্তি গড়ে তুলেছে রাশিয়া। গত শনিবার রাশিয়ান নৌসেনারা জার্কন নামে একটি হাইপারসোনিক মিসাইলের নিরীক্ষণ সম্পূর্ণ করল। এই নিরীক্ষণকে দূরপাল্লার আক্রমণের ক্ষেত্রে সামরিক শক্তির প্রদর্শন বলেই মনে করছেন সকলে।

এ-বছর জার্কন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কম হয়নি। এই পরীক্ষা সেই ধারাবাহিকতারই অংশ। এ-বিষয়ে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানিয়েছে, ব্যারেন্টস সাগরে এই মিসাইল লঞ্চ করা হয়েছিল। মিসাইলটি ৫৪০ নটিক্যাল মাইল, অর্থাৎ ১০০০ কিলোমিটার দূরের একটি লক্ষ‍্যবস্তুকে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছে। ইউক্রেনের ওপর ঘটে চলা একের পর এক আক্রমণের মাঝে সামরিক শক্তি বাড়াতে বদ্ধপরিকর রাশিয়া। এই জার্কন মিসাইল সম্বন্ধে জেনে নেওয়া যাক।

হাইপারসোনিক মিসাইল কী?
হাইপারসোনিক মিসাইলের ব্যবহার সম্বন্ধে পুতিন বলেছেন, রাশিয়ার অস্ত্রের ভাঁড়ারে আরেকটি নতুন অপরাজেয় অস্ত্র যোগ দিল। হাইপারসোনিক মিসাইল ম্যাক ফাইভ বা তার থেকেও বেশি গতিতে ছোটে। শব্দের বেগের থেকে পাঁচগুণ বেশি গতিবেগকে বলা হয় ম্যাক ফাইভ। এর আগেও মস্কোতে 'কিনঝল' নামে একটি হাইপারসোনিক মিসাইল লঞ্চ করেছিল রাশিয়া। এইজাতীয় মিসাইল ওড়ে মাটির কাছাকাছি, খুব ওপরে ওঠার প্রয়োজন পড়ে না, গতিবেগের কারণে অতিক্রম করতে পারে দীর্ঘ দূরত্ব খুব কম সময়ে, একে যেমন খুশি তেমন চালনা করা যায়, শেষ মুহূর্তে বদলে দেওয়া যায় অভিমুখ– এইসব নানা কারণে আমেরিকার মিসাইল প্রতিরক্ষা স্যাটেলাইট এবং র‍্যাডারের পক্ষে এই মিসাইল ঠিকঠাক নির্ণয় করতে পারা দুঃসাধ্য প্রায়। তবে এই নিঃশব্দে ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োগের ক্ষমতা খুব মারাত্মক। যে-কোনও দেশকে এর মাধ্যমে যখনতখন আক্রমণ করতে পারে রাশিয়া। ফলে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। মার্চ মাসে এই ধরনের হাইপারসোনিক মিসাইল প্রথম ব্যবহার করে রাশিয়া। সেসময় মস্কো থেকে এ-সম্বন্ধে বিবৃতি দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন: ভয়াবহ মারণাস্ত্র রাশিয়ার হাতে, ফিরে আসছে ঠান্ডা যুদ্ধের স্মৃতি?

এই বিষয়ে মস্কোর হায়ার স্কুল অব ইকোনমিক্স-এর সেন্টার ফর কম্প্রিহেন্সিভ ইউরোপিয়ান অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের প্রধান এবং মিলিটারি অ্যানালিস্ট বৈশিলী কাশিন বলেছেন, “যুদ্ধক্ষেত্রে হাইপারসোনিক অস্ত্রের ব্যবহার ইতিহাসে এই প্রথমবার।" ক্রুজ মিসাইলের তুলনায় হাইপারসোনিক মিসাইল মাটির নিচের গুদামঘর, আশ্রয় ইত্যাদি ধ্বংস করতে পারে বেশি। “এর প্রচণ্ড গতিবেগের কারণেই এর লক্ষ্যভেদ এবং ধ্বংসাত্মক ক্ষমটা অনেক অনেক বেশি," জানিয়েছেন তিনি। এর থেকে ধীরগতির ক্রুজ মিসাইল বেশির ভাগ সময়েই সাবসোনিক হয়। সেই মিসাইলকে যেমন ইচ্ছে চালনা করা যায়, ঠিক তেমনই সুবিধে হাইপারসোনিক মিসাইলে। ফলে এর গতিবিধির ওপর লক্ষ রাখা এবং এর আক্রমণ ঠেকানো অত্যন্ত দুঃসাধ্য।

জার্কনের ক্ষমতা কী কী?
রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন দাবি করেছেন, জার্কনের গতিবেগ শব্দের গতিবেগের প্রায় ন'গুণ। এবং এটি ১০০০ কিমি উড়াল দিয়ে লক্ষ‍্যভেদ করতে সক্ষম। রাশিয়ার সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে জার্কন যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, সে-সম্বন্ধে পুতিন নিশ্চিত। জার্কন মূলত জলপথে এবং স্থলপথের শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য ক্রুজার, ফ্রিজেট এবং ডুবোজাহাজে ব্যবহার করা হবে। রাশিয়ার বিপুল হাইপারসোনিক মিসাইলের ভাঁড়ারে এটি নতুন সংযোজন। রাশিয়ার আধিকারিকরা জানিয়েছেন, বর্তমানের কোনও মিসাইল-প্রতিরোধক ব্যবস্থার দ্বারাই এই মিসাইলকে আটকানো সম্ভব নয়। এ-পর্যন্ত পশ্চিমি দেশগুলোকে ইউক্রেনের ব্যাপারে নাক গলাতে বারণ করে এসেছেন পুতিন। দিয়েছেন হুমকিও। এবারেও পুতিনের বক্তব্য পরিষ্কার, জার্কনের মাধ্যমে এইসব ‘নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়া শক্তিকেন্দ্র’-গুলোকে আক্রমণ করা যাবে কয়েক মিনিটের মধ্যে। সেই ক্ষমতা রাশিয়ার রয়েছে।

হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে এত গুরুত্ব কেন দিচ্ছে রাশিয়া?
হাইপারসোনিক মিসাইল নিয়ে রাশিয়ার এই বাড়বাড়ন্তকে মূলত আমেরিকার নৌ-সামরিক প্রযুক্তির চূড়ান্ত অগ্রগতির জবাব হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। আমেরিকার নৌবাহিনীর ১২টি পারমাণবিক শক্তিচালিত যুদ্ধবিমানবাহী জাহাজ সবসময় তৈরি রাখে আক্রমণের জন্য। সেখানে রাশিয়া একটিমাত্র জাহাজ ব্যবহার করে। ইউরো-এশিয়ান টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেটি খারাপ হলে একটি গাধাবোটের সাহায্য নেয় তারা। তবে আমেরিকার আধুনিক থেকে আধুনিকতম যুদ্ধবিমানবাহী জাহাজও জার্কনের দ্বারা খুব সহজেই আক্রান্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১০০ মাইল দূর থেকেও যদি কেউ বুঝতে পারেন, জার্কন হামলা হতে চলেছে, উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তাঁরা মাত্র মিনিটখানেক সময় পাবেন। হাইপারসোনিক মিসাইলকে যেমন স্ক্র্যামজেটের ওপর নির্ভর হয়, এই মিসাইল তেমন না। এটি ক্রুজ মিসাইল এবং ব‍্যালিস্টিক মিসাইলের মিশ্রন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই অস্ত্রের মাধ্যমে আমেরিকার সামরিক শক্তিকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে রাশিয়া।

ইতিপূর্বেও আমরা দেখেছি, রাশিয়ার কাছে কী বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র মজুত রয়েছে। ফেডারেশন অফ আমেরিকান সায়েন্টিস্টস-এর তথ্য অনুসারে বর্তমানে রাশিয়ার কাছে রয়েছে (আনুমানিক) ৫৯৭৭টি পারমাণবিক অস্ত্র। তবে এর মধ্যে ১৫০০টি অস্ত্র বেশ পুরনো, ব্যবহারের অযোগ্য। সেগুলোর জোড় খুলে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে রাশিয়া বেশ কিছুদিন। বাকি ৪৫০০টির মধ্যে ১১৮৫টি আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র, ৮০০টি ডুবোজাহাজের ক্ষেপণাস্ত্র, ৫৮০টি আকাশপথে চালিত ক্ষেপণাস্ত্র– যা দিয়ে বহু দূর পর্যন্ত হামলা চালানো যেতে পারে। এইসব অস্ত্র মূলত পারমাণবিক যুদ্ধে ব্যবহারের অস্ত্র। বাকি আকারে ছোট, তাদের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাও কম। যুদ্ধক্ষেত্রে বা জলযুদ্ধে ব্যবহারের জন্য।

যদিও এই সমস্ত অস্ত্রই রাশিয়া ব্যবহারের জন্য তৈরি রেখেছে, এমনটা নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর মধ্যে আনুমানিক ১৫০০টি রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা হয়েছে বিভিন্ন মিসাইল বেস, বম্বার বেস এবং ডুবোজাহাজে। এ-পর্যন্ত সরকারি হিসেবে ৭১৫টি পারমাণবিক অস্ত্র নিরীক্ষণ করেছে রাশিয়া। এই অবস্থায় বাড়তি এই অপরাজেয় হাইপারসোনিক মিসাইল জার্কনের আমদানি নিয়ে রীতিমতো চিন্তিত বিশ্ব।

 

More Articles