শুধু পেলের খেলা দেখবে বলে যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছিল দুই দেশ!

Pele Maradona: বয়স কুড়ির কোঠায় পৌঁছনোর আগেই ব্রাজ়িলের সরকার পেলেকে ‘জাতীয় সম্পদ’ বলে ঘোষণা করে!

পেলের গোল

১৯৬৯ সালের কথা বলছি। মারাকানা স্টেডিয়ামে স্যান্তুস (স্যান্তোস) খেলছিল ভাস্কো দা গামা ক্লাবের বিরুদ্ধে।

পেলে বিদ্যুৎচমকের মতো মাঠের একপ্রান্ত থেকে দৌড়ে এসে এমন আক্রমণ শানাল যে মনে হচ্ছিল ও বুঝি মাটিতে পা দিয়ে দৌড়য় না, হাওয়ায় ভেসে আসে। কিন্তু পেলে যেই বলটা গোলে ঠেলতে যাবে অমনি পিছন থেকে তাকে লেঙ্গি মেরে ফেলে দিল।

রেফারি যথারীতি বাঁশি বাজিয়ে পেনাল্টি দেয়। পেলে পেনাল্টিটা নিজে মারতে চাইছিল না। কিন্তু এক লাখ দর্শক তার নাম ধরে তুমুল চিৎকার করে পেলেকে শেষমেশ বাধ্য করল পেনাল্টিটা নিতে।

এর আগে পেলে মারাকানায় গণ্ডায় গণ্ডায় গোল করছে। তার মধ্যে ১৯৬১-তে ফ্লুমিনেন্সের বিরুদ্ধে সাতজন ডিফেন্ডার এবং সবশেষে গোলকিপারকেও কাটিয়ে করে আসা সেই বিস্ময়কর গোলও আছে। তবু এই পেনাল্টিটার সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা করা যায় না, জনতার কাছে এই পেনাল্টিটা ছিল খুবই পবিত্র একটা ব্যাপার। সুতরাং পৃথিবীর সবচেয়ে কোলাহলপ্রিয় দর্শকও এক লহমায় নীরব হয়ে গেল। তুমুল গর্জন এমনভাবে মুছে গেল যে মনে হচ্ছিল সবাই যেন ঈশ্বরের আদেশ মেনে চলছে। কেউ আর কথা বলছিল না, সবাই দমবন্ধ করে বসে রইল। মনে হচ্ছিল হঠাৎ করে স্টেডিয়ামটা জনশূন্য হয়ে গেছে, পেলে আর গোলকিপার আন্দ্রাদে ছাড়া মাঠে আর কোনও খেলোয়াড়ও নেই। তারা দু'জনেও পেনাল্টির আগে খানিক অপেক্ষা করল। পেনাল্টি স্পটে বলটাকে স্থির করে রেখে পেলে তার পাশে দাঁড়িয়েই রইল। আন্দ্রাদে বারো পা দূরে দুই পোস্টের মাঝখানে খানিক ঝুঁকে দাঁড়াল।

পেনাল্টি শটটা গোলকিপার আঙুলে ছুঁলেও ঠেকাতে পারল না। পেলে একেবারে ঠিকানা লিখেই মেরেছিল। এই হলো পেলের সহস্রতম গোল। পেশাদার ফুটবলের ইতিহাসে হাজারটা গোল আর কেউ করেনি।

তারপর মারাকানা ফের নিজের ছন্দে ফিরল। শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলায় কলরব মুখর হয়ে উঠল, রাতের অন্ধকারে উল্লাসের মশাল জ্বলতে থাকল।

আরও পড়ুন- প্রবল ঝগড়া থেকে কাছের বন্ধু, পেলে-মারাদোনার মধ্যে সম্পর্ক যেন ফুটবলের আস্ত একটি রূপকথা

পেলে

তার নামে কয়েকশো গান আছে। মাত্র সতেরো বছরে সে শুধু বিশ্বকাপই জেতেনি, ফুটবলের রাজার উপাধিও পেয়েছে। তার বয়স কুড়ির কোঠায় পৌঁছনোর আগেই ব্রাজ়িলের সরকার তাকে ‘জাতীয় সম্পদ’ বলে ঘোষণা করেছে। এতটাই দুর্লভ সম্পদ যে তার রফতানি নিষিদ্ধ। সে ব্রাজ়িলের হয়ে তিন-তিনটে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানশিপ জিতেছে আর নিজের ক্লাব স্যান্তুসের (স্যান্তোস) হয়ে দু'বার। নিজের সহস্রতম গোলের পরও সে থামেনি। খেলোয়াড়জীবনে অন্তত আশিটা দেশে তেরোশোর বেশি ম্যাচ খেলেছে। একের পর এক ম্যাচ খেলার ধকল সয়ে গেছে। সর্বসাকুল্যে তেরোশোর কাছাকাছি গোলও করেছে। একবার তো কয়েকদিনের জন্য যুদ্ধও থামিয়ে দিয়েছিল! শুধু তার খেলা দেখবে বলে নাইজিরিয়া আর বিয়াফ্রা সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল।

আরে মশাই, তাকে খেলতে দেখার সৌভাগ্যের কাছে যুদ্ধবিরতি তো নেহাতই সাধারণ ব্যাপার, ও জিনিস রোজ-রোজ দেখা যায় না। আরও অনেক কিছুই করা যেত তাকে মাঠে দেখার জন্য। পেলে যখন বল পায়ে দ্রুত দৌড়ে বিপক্ষকে ছিন্নভিন্ন করে দিত, মনে হতো একতাল মাখনের মধ্যে দিয়ে একটা গরম ছুরি চালিয়ে দিল কেউ। তারপর সে যতক্ষণে থামত, প্রতিপক্ষ ততক্ষণে তার পায়ের নকশার ভুলভুলাইয়াতে রাস্তা হারিয়ে ফেলত। সে লাফিয়ে উঠলে মনে হতো যেন কোনও অদৃশ্য সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে যাচ্ছে। আর যখন ফ্রি-কিক নিত, তখন প্রতিপক্ষের যেসব খেলোয়াড় দেওয়াল গড়ে দাঁড়াত, তারাও পেলে শট নেওয়ার পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গোলের দিকে ঘুরে গিয়ে বলটার জালে জড়িয়ে যাওয়া দেখত। হোক না প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়, এমন অপরূপ দৃশ্য কি না দেখে থাকা যায়, বলুন? যারা ওসব দৃশ্য দেখেছে জন্মজন্মান্তরেও ভুলবে না।

শহর থেকে বহুদূরের এক গাঁয়ে তার জন্ম হয়েছিল। তা সত্ত্বেও সে ক্ষমতা আর সৌভাগ্যের সেই চুড়োয় পৌঁছেছিল যেখানে তার আগে কালো মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। মাঠের বাইরে সে কিন্তু কারও জন্য এক মিনিটও সময় ব্যয় করত না, তার ট্যাঁক থেকে একটা আধুলিও গলত না। কিন্তু আমরা যারা তাকে মাঠে নেমে বল পায়ে ছুটতে দেখেছি তারা তো সত্যিই আঁজলা ভরে চেটেপুটে আকণ্ঠ সৌন্দর্য পান করেছি; সেই মুহূর্তগুলো এতটাই দিব্য যে সাধ হয় অমরত্বে বিশ্বাস করি।

আরও পড়ুন- ছিল না ফুটবল কেনার সামর্থ্য, মোজা দিয়েই বল বানিয়ে মাঠে নেমে পড়তেন পেলে

১৯৭০-এর বিশ্বকাপ

প্রাহায় পাপেট-সিনেমার কিংবদন্তি ইজ়ি ত্রাঙ্কা মারা যাচ্ছেন; অসাধারণ এক জীবন অতিবাহিত করে লন্ডনে বারট্রান্ড রাসেলও মৃত্যুপথযাত্রী। কবি লিওনেল রুখামা মাত্রই কুড়ি বছর বয়সে মানাগুয়েতে স্বৈরচারী সোমোসার বাহিনীর সঙ্গে লড়তে গিয়ে খুন হয়ে যাচ্ছেন। পৃথিবীর মানুষের গলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গান; মাত্রাতিরিক্ত সাফল্যের ঘোরে বিটলস ভেঙে যাচ্ছে। আর নেশায় চুর হতে হতে গিটারের তারে জাদুর কেরামতি দেখানো জিমি হেনড্রিক্স এবং গায়ক জানিস জপলিনও সেই পথে চলে গেল, যে রাস্তা থেকে কেউ আর ফেরে না।

হারিকেন ঝড়ে পাকিস্তান দুমড়ে গেল, ওদিকে ভয়াবহ এক ভূমিকম্পে পেরুর আন্দিজ় এলাকা থেকে কমপক্ষে পনেরোটা শহর চিরকালের মতো কালের গর্ভে মিলিয়ে গেল। ওয়াশিংটনে কেউ আর ভিয়েতনাম যুদ্ধ চাইছিল না। পেন্টাগন সূত্রে, এমনকী ভিয়েতনাম যুদ্ধে যাওয়া যেসব জেনারেল সেখান থেকে পিঠটান দিয়ে কম্বোডিয়া দখল করে নিয়েছিল, তাদের হিসেবে অনুযায়ী দু'পক্ষের অন্তত দশ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। তবু আমেরিকা যুদ্ধটাকে টেনে হিঁচড়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এর আগে তিনবারের ব্যর্থ চেষ্টার পর আইয়েন্দে ফের সব শিশুর মুখে দুধ তুলে দেওয়া আর তামার খনির জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চিলের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হলেন। মিয়ামির সর্বজ্ঞ মাতব্বররা বলে বেড়াচ্ছিল খুব শিগগিরই নাকি ফিদেল কাস্ত্রোর পতন অনিবার্য। আর সেরেফ কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা শুধু! ইতিহাসে প্রথমবার ভ্যাটিকান জুড়ে হরতাল পালিত হলো। পবিত্র পিতার সেবকেরা যখন হাত তুলে নিয়ে কর্মবিরতিতে গেল, তখন মেহিকোতে দুনিয়ার ষোলোটি দেশের খেলোয়াড়রা পা চালিয়ে নবম বিশ্বকাপ খেলতে গেল।

ইওরোপের ন'টা দেশ, আমেরিকার পাঁচটা আর ইজ়রায়েল ও মরক্কো সেবার অংশগ্রহণ করেছিল। প্রথম ম্যাচেই রেফারি একজনকে হলুদ কার্ড দেখাল। এর আগে কেউ বিশ্বকাপে হলুদ কার্ড দেখেনি। দেখবে কী করে, হলুদ কার্ডের সাবধান বাণী এবং লাল কার্ডের বহিষ্কারের তর্জনী এই প্রথম ফিফা মেনে নিল যে! সেবারের মেহিকো বিশ্বকাপে কেবল এই দুই কার্ড দেখানোর নতুনত্বই ছিল না, প্রতি ম্যাচে দু'জন করে বদলি খেলোয়াড় খেলানোর নিয়মও সেবারই প্রথম এল। আগে, গোলকিপার জখম হলে তার বদলি পাওয়া যেত। ফলে দু' চারটে হিসেব করে মারা শটের ধাক্কায় জখম করে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় সংখ্যা কমিয়ে দেওয়াটা তখনকার দিনে খুব একটা নতুন ব্যাপার ছিল না।

’৭০-এর বিশ্বকাপের কিছু খণ্ডচিত্র : বেকেনবাওয়ার ভাঙা হাত ব্যান্ডেজ দিয়ে গলায় ঝুলিয়ে শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়ে গেল; আর কী করে ভুলি তোস্তাওয়ের [টোস্টাও] আন্তরিকতা, সদ্য চোখে অস্ত্রোপচার করিয়ে মাঠে নেমে প্রতিটি ম্যাচে দৃঢ়পদে খেলে গেল। সেই সঙ্গে ছিল নিজের শেষ বিশ্বকাপে পেলের দড়বাজিকরের মতো ফুটবল। ইতালির রক্ষণভাগের ফুটবলার তারচিজ়িও বোরনিচের উপর দায়িত্ব ছিল পেলেকে রুখে দেবার। সে একবার বলেছিল, "পেলে আর আমি একসঙ্গেই লাফিয়ে উঠতাম, কিন্তু যখন আমার পা ফের মাটিতে তখন ঘাড় উঁচিয়ে দেখতাম পেলে তখনও বাতাসে ভাসছে।"

চার পূর্বতন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান, ব্রাজ়িল, ইতালি, জার্মানি আর উরুগুয়ে উঠল সেবারের সেমিফাইনালে। জার্মানি শেষ পর্যন্ত তৃতীয় স্থান পেল, উরুগুয়ে চতুর্থ। ফাইনালে ব্রাজ়িল ইতালিকে চমকে দিয়ে ৪-১ গোলে জিতল। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম লিখল, "এমন সুষমাময়ী ফুটবল অবিলম্বে বাতিল করা উচিত।" আজও ব্রাজ়িল ভক্তরা সেই ম্যাচের শেষ গোলের কথা বলতে গিয়ে আবেগে নিজেদের অজান্তেই দাঁড়িয়ে ওঠে! বলটা ব্রাজ়িলের অর্ধের সবটা পেরিয়ে এসেছিল, এগারোজন খেলোয়াড়ই একবার না একবার পায়ে বল ঠেকিয়েছিল। সব শেষে অবতীর্ণ হয় পেলে, সে বলের দিকে ঘুরেও তাকায়নি, বরং টর্নেডোর গতিতে এগিয়ে আসা কার্লোস আলবের্তোকে রুপোর থালায় করে সাজিয়ে দেয়, যাতে সে ছোরাটা আমূল বিঁধে দিতে পারে ইতালির হৃৎপিণ্ডে।

‘টর্পেডো’ নামে বিখ্যাত জার্মানির মুলার দশ গোল করে তালিকার শীর্ষে ছিল। তারপরেই সাতটা গোল করেছিল ব্রাজ়িলের জারজ়িনো।

তিনবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজ়িল চিরকালের মতো জুলে রিমে কাপের মালিক হয়ে গেল। অবিশ্যি ১৯৮৩ সালে সেই কাপ চুরি হয়ে যায় এবং কাপটা গলিয়ে পাওয়া প্রায় দু' কিলো খাঁটি সোনা ডাকাতদলের সর্দাররা বিক্রি করে দেয়। ভাগ্যিস ব্রাজ়িলের ফুটবল ফেডারেশনের আলমারিতে জুলে রিমে কাপের একখানা নকল রাখা ছিল।

আরও পড়ুন- পোলিওতে কাবু, দুই পা অসমান, বাঁকা মেরুদণ্ড নিয়েই ফুটবলের শ্রেষ্ঠ শিল্পী হয়েছিলেন গ্যারিঞ্চা

জারজ়িনোর গোল

সত্তরের বিশ্বকাপে ব্রাজ়িল খেলছিল ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে।

পাউলো সিজ়ারের কাছ থেকে বল পেয়ে তোস্তাও যতটা সম্ভব সামনের দিকে দৌড়ে গেল, কিন্তু সাহেবদের গোটা দলটাই নিজেদের পেনাল্টি বক্সের মধ্যে সেঁধিয়ে বসেছিল। মনে হয় ওদের মহারানিও সেদিন পেনাল্টি বক্সেই বাস করছিল। তোস্তাও একজনকে ধোঁকা দিল, তারপর আরেকজনকে, তারপর আরও একজনকে। শেষে বলটা পেলেকে পাস করল। ওদিকে পেলেকে ঘিরে রেখেছে তিনজন তাগড়া ইংরেজ। পেলের দমবন্ধ হয়ে আসছিল ওদের দাপটে। সে তখন এমন ভাব করল যে বলটা বুঝি গোলের দিকে মারবে, কিন্তু তা না করে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে গোটা শরীরটাকে ধনুকের মতো বাঁকিয়ে সে জারজ়িনোর পায়ে বল ঠেলে দিল। জারজ়িনো ততক্ষণে প্রবল গতিতে দৌড়ে এসেছে। হিউ দে জেনেইরোর ভয়ঙ্কর বস্তির বালিভরা মাঠে খেলে-খেলে জারজ়িনো শিখে নিয়েছিল কীভাবে দু' পাশের প্রতিপক্ষকে ঝেড়ে ফেলতে হয়। সে এল কালো বুলেটের মতো, উলটো দিক থেকে আসা এক ইংরেজকে টপকে গেল। তার পা থেকে ছিটকে বেরিয়ে বলটা সাদা বুলেটের মতো গিয়ে গোলকিপার ব্যাঙ্কসকে দাঁড় করিয়ে রেখে গোলে ঢুকে গেল।

সেদিনের এই শেষ গোলটাই উৎসবের আবহ তৈরি করে দেয়। ব্রাজ়িলের খেলোয়াড়রা সাহেবদের কেল্লা দেখভালের দায়িত্বে থাকা সাতজন সেনাপতিকে মাটিতে পেড়ে ফেলেছিল। আসলে দখিনা উষ্ণ বাতাসে ইংরেজদের দুর্গের লোহালক্কড় একেবারে গলে গিয়েছিল।

পরব

ব্রাজ়িলে এমন অসংখ্য গ্রাম-শহর আছে যার ত্রিসীমানায় কোনও গির্জা নেই, কিন্তু লাখখানেক ফুটবল মাঠ আছে। রোববারগুলোয় সেদেশে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের কাজের চাপ বাড়ে। সাধারণ রোববারে মানুষ ফুটবলের পরব পালন করতে গিয়ে উত্তেজনায় মরে। আবার যে রোববার খেলা থাকে না, সেদিন একঘেয়েমির বিরক্তিতে মরে।

১৯৬৬-র বিশ্বকাপে ব্রাজ়িল মুখ থুবড়ে পড়ার পর, চতুর্দিক থেকে আত্মহত্যা আর স্নায়ুবৈকল্যের খবর আসছিল, বিষাদে নিশানগুলো অর্ধনমিত ছিল, মানুষ বাড়ির দরজায় কালো রিবন লাগিয়ে রেখেছিল। রাস্তায় মিছিল করে দেশের ফুটবল শৌর্যের শবানুগমন করে অসংখ্য মানুষ। তারা নাচতে নাচতে গোরস্থানে গিয়ে ব্রাজ়িলের ফুটবল পরাক্রমকে কফিনে ভরে কবর দিয়ে আসে। এর ঠিক চার বছর পরে ব্রাজ়িল যখন তৃতীয়বারের জন্য বিশ্বকাপ জিতল তখন নেলসন হোদ্রিগিস লিখেছিল, রাস্তার নেড়ি ধরে বেড়ানো যাদের কাজ, তাদের ভয়ে মুখ লুকিয়ে থাকার লোক ব্রাজ়িলিয়রা নয়, তারা বেজির চামড়ার পোশাক পরে মাথায় কাঁটার মুকুট পরা রাজা। ফুটবলের অধীশ্বর।

’৭০-এর বিশ্বকাপে ব্রাজ়িল যে ফুটবলটা খেলল, তা সত্যিই ভালো ফুটবলের জন্য সেদেশের মানুষের আনন্দময় আকুলতা আর সৌন্দর্যতৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম ছিল। গোটা দুনিয়ার ফুটবল তখন রক্ষণশীলতার মধ্যমেধায় ভুগছিল। কাতেনাচো (ক্যাটানেসিও) নাম দিয়ে গোটা দলটাই নীচের দিকে নেমে দাঁড়াত আর নিয়মরক্ষার খাতিরে একজন বা দু'জন সামনে খেলত। ঝুঁকিই বলুন আর সৃজনশীলতাই বলুন, দু'য়েরই মুখের ওপর সশব্দে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ব্রাজ়িল কিন্তু এসব মাঝারিয়ানার বাইরে গিয়ে চমৎকার ফুটবল খেলেছিল। ওদের দলটা আক্রমণের উপরেই দাঁড়িয়েছিল, চার-চারজন স্ট্রাইকার! জারজ়িনো, তোস্তাও, পেলে, রিভেলিনো। কখনও কখনও আবার আক্রমণের ঝাঁঝ আরেকটু বাড়াতে সামনে পাঁচজন, এমনকী ছ'জনও খেলত। সেসময় জ়েসুঁ আর কার্লোস আলবের্তো রক্ষণ ছেড়ে উপরে উঠে আসত। এই স্টিমরোলারের সামনে ’৭০-এর ফাইনালে ইতালির কাতেনাচো ঝুরঝুর করে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু কী আশ্চর্য দেখুন, এর সিকি শতাব্দী পরে এরকম আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলাকে আত্মঘাতের শামিল বলে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপেও ব্রাজ়িল আর ইতালি ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল। সেবার কিন্তু একশো কুড়ি মিনিটে কোনও দলই গোল করতে না পারায় পেনাল্টিতে ফলাফল তৈরি করতে হয়। ভাগ্যিস পেনাল্টিতে ওরা গোল করেছিল, নইলে গোলপোস্টের জালটা একটু স্পর্শের প্রতীক্ষায় চিরপিপাসিত থেকে যেত।

আরও পড়ুন- ফুটবলার না হোর্ডিং! জুতোর ফিতে বাঁধার নামে আসলে ব্র্যান্ড দেখাতেই চান খেলোয়াড়রা?

ফুটবল আর স্বৈরশাসক

১৯৭০-এর বিশ্বকাপ জেতার পর বিজয়োৎসবের দিন ব্রাজ়িলের স্বৈরশাসক জেনারেল মেজিচি খেলোয়াড়দের হাতে নগদ টাকা তুলে দিল, ফটোগ্রাফারদের সামনে হাসিহাসি মুখ করে হাতে ট্রফি নিয়ে দাঁড়াল, আবার ছবি তোলার জন্য বলে হেডও মারল। ধীরে ধীরে ব্রাজ়িল ফুটবল দলের জন্য বানানো ‘ব্রাজ়িল এগিয়ে চলো’ হয়ে দাঁড়াল সরকারি সুর। উড়ন্ত ভঙ্গিতে পেলের একটা ছবি ব্যবহার করে টিভিতে যে বিজ্ঞাপনটা আসত, তাতেও বলা হতো, ‘অপ্রতিরোধ্য ব্রাজ়িল’। মনে করে দেখুন, ১৯৭৮-এ আরহেন্তিনা যখন বিশ্বকাপ জেতে তখন মারিও কেম্পেসের ছবিতে ‘ঝড়ের মতো অপ্রতিরোধ্য’ স্লোগান লাগিয়ে জেনারেল হোর্খে বিদেলাও একই উদ্দেশ্যে একই রকম প্রচার চালিয়েছিল।

ফুটবলের সঙ্গে পিতৃভূমির সম্মান সঙ্গে জড়িয়ে, তাই ক্ষমতার সঙ্গে ফুটবল ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। আর এইসব অলপ্পেয়ে মিলিটারি প্রধানরা হামেশাই বলত, ‘আমিই পিতৃভূমি’।

এরই মাঝে চিলের ভাগ্যবিধাতা জেনারেল পিনোশে সেদেশের জনপ্রিয়তম ফুটবল ক্লাব কোলো-কোলোর সভাপতি হিসেবে নিজেই নিজেকে নির্বাচিত করল। আবার বলিভিয়া দখল করে উঠে জেনারেল গার্সিয়া মেসা হাজারও ফুটবলপ্রেমী বলিভিয়াবাসীর হৃদয়ের উত্তাপে গড়া উইলস্তারমান ক্লাবের স্বঘোষিত সভাপতি হয়ে বসে।

ভুললে চলবে না আমাদের মহাদেশে ফুটবলই জনগণেশ, তাই ফুটবলই ক্ষমতার উৎস। আমরা চিরকাল শুনে এসেছি সব স্বৈরাচারীর মুখে এক রা : ‘আমি তোমাদেরই লোক’।

চোখের পলকে গোল

গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে আরহেন্তিনার ইন্দেপেন্দিয়েন্তে ক্লাবের এদোয়ার্দো আন্দ্রেস মাগলিওনির নাম আছে সবচেয়ে কম সময়ে সব থেকে বেশি গোল করার জন্য।

১৯৭৩-এ লা প্লাতার হিমনাসিয়া ওয়াই এসগ্রিমার সঙ্গে ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধের একেবারে শুরুতেই মাগলিওনি এসগ্রিমার গোলকিপার গুরুসিয়াগাকে এক মিনিট পঞ্চাশ সেকেন্ডের মধ্যে তিন-তিনবার বোকা বানিয়ে গোল করেছিল।

মারাদোনার গোল

১৯৭৩-এর কথাই বলছি। বুয়েনস আইরেসে আরহেন্তিনোস জুনিয়র্সের বাচ্চারা খেলছিল রিভার প্লেটের ছোটদের সঙ্গে।

আরহেন্তিনোসের দশ নম্বর জার্সি নিজের দলের গোলকিপারের কাছ থেকে বল পেয়ে রিভারের সেন্টার ফরোয়ার্ডকে কাটিয়ে প্রায় উড়তে লাগল। বিপক্ষের খেলোয়াড়রা একের পর এক এসে তার রাস্তা আটকানোর চেষ্টা করল। সে প্রথমজনের লেজের দিক দিয়ে বলটা কাটিয়ে নিল, দ্বিতীয়জনের দু'পায়ের ফাঁক দিয়ে বল গলিয়ে দিল, আর তৃতীয়জনকে একটা বিষাক্ত ব্যাকহিলে মুরগি করল। ততক্ষণে রিভারের রক্ষণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, গোলকিপার মাটিতে শুয়ে, ছেলেটা একটুও না থেমে হেঁটে হেঁটে গিয়ে বলটা জালে জড়িয়ে দিল। মাঠে তখন দাঁড়িয়ে আছে রিভারের হতোদ্যম, কাঁধ ঝুলে পড়া সাতজন খেলোয়াড়। অন্য চারজন হাঁ করে দেখছিল কী সব কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে মাঠে।

ছাঁচি পেঁয়াজের মতো খুদে বাচ্চাগুলোর দল সেবোলিতাস ক্রমাগত একশোটা ম্যাচ জিতে সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ওদের একজন, সবাই যাকে ‘বিষ’ নামে ডাকত, পরিষ্কার বলে দেয়, "আমরা সেরেফ মজার জন্য খেলি। আমরা কোনওদিন পয়সার জন্য খেলব না। খেলার মধ্যে টাকাপয়সা এসে গেলেই সবাই নিজেকে খুন করে তারকা হতে চায়। আর তখনই হিংসুটে হয়ে পড়ে, অন্যের ভালো দেখতে পারে না।"

‘বিষ’ যখন এইসব কথা বলছিল তখন সে একহাতে তার দলে সবার প্রিয়, সবচেয়ে বেঁটেখাটো কিন্তু ভীষণ হাসিখুশি একটা ছেলের গলা জড়িয়েছিল, দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা। দিয়েগোর তখন বারো বছর বয়স, আর খানিকক্ষণ আগেই সে ওই অবিশ্বাস্য গোলটা করেছে।

মারাদোনার অভ্যেস ছিল আক্রমণে যাবার সময় জিভটাকে বাইরে বের করে দৌড়নোর। সে জীবনে যত গোল করেছে সব সময়েই তার জিভ মুখের বাইরে ছিল। দিয়েগো রাতে ঘুমোত পাশ বালিশের বদলে ফুটবল জড়িয়ে ধরে, আর দিনের বেলায় বল পায়ে অবিশ্বাস্য সব কাণ্ড ঘটাত। সে একটা গরিব পাড়ায় তস্য গরিব বাড়ির সন্তান। তার স্বপ্ন ছিল কারখানার মেকানিক হওয়া।

More Articles