গুড়ের নাম নলেন কেন! আজকের বাঙালি কি কদর বুঝবে এই গুড়ের

বাঙালির শীতকাল মানেই নলেন গুড়ের রসগোল্লা, পায়েস, সন্দেশ, পিঠে। সবেতেই চাই নলেন গুড়।এই গুড়ের জন্যই সারা বছর মুখিয়ে থাকে বাঙালি।
কিন্তু নলেন গুড়ের নাম নলেন গুড় কিভাবে হল?কেনই বা রাখা হল ভেবেছেন কখনও কি!নলেন গুড় আসলে খেজুর গুড়। যা খেজুরের রস থেকে তৈরি হয়। বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসের গোড়ার দিক থেকে এই গুড় পাওয়া যায় বলে একে অনেকে নতুন গুড়ও বলেন। তবে নলেন শব্দটি কোথা থেকে এসেছে, তা নিয়ে রয়েছে নানা মত। অনেকেই বলেন, নতুন শব্দটি কালক্রমে ক্ষয়ে হয়েছে নলেন। আবার কেউ বলেন, খেজুর গাছের গায়ে নল কেটে এই গুড় সংগ্রহ করা হয় বলে একে নলেন গুড় বলা হয়। আরও একদলের মতে,দক্ষিণ ভারতে নরকু বলে একটি শব্দ প্রচলিত আছে। যার আক্ষরিক অর্থ হল কাটা বা ছেদন করা। তাই এই নাম।

শীতকালে আজও নলেন গুড়ের মহিমায় একটুও ভাঁটা পড়েনি। নভেম্বরের মাঝামাঝি অথবা শেষের দিক থেকেই খেজুর গাছ কাটা শুরু করে দেন শিউলিরা। খেঁজুরের রস যারা সংগ্রহ করেন তাদের শিউলি বলে। একটা খেজুর গাছ তিনবার কাটার পর তাতে নলি লাগিয়ে রসের জন্য হাঁড়ি বা ভাঁড় পাতা হয়। একটা খেজুর গাছ থেকে দিনে দু’বার রস মেলে। ভোরের রসকে জিরেন এবং বিকালের রসকে ওলা বলে। বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসের গোড়ার দিক থেকে এই গুড় পাওয়া যায় বলে একে অনেকে একে নতুন গুড় বলেন। পৌষ মাসে পুরোদমে রস মেলার পর মাঘ থেকে রস কমতে শুরু করে। ওই সময়ে রসের ঘনত্ব বাড়ে। তবে গাছকাটার পর প্রথম দিকের রসে গুড় ভাল হয়। এখন অবশ্য টিউবেও পাওয়া যায় এই গুড়। শীত আসলে এই গুড়ের অপেক্ষায় থাকেনা এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সাধারণত শীতের বিকেলের পর বিভিন্ন খেজুর গাছের গা চেঁছে ফেলে ফুটো করে রাখা হয়৷ তারপর ফাঁকা হাঁড়িগুলো ঝুলিয়ে দিয়ে আসা হয়। কুয়াশা-ঢাকা শীতের সকালে টাটকা এক গ্লাস খেজুরের রস কাঁচা ও জ্বাল দিয়ে খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি এ রস দিয়ে তৈরি গুড় ও পাটালিরও তুলনা নেই।

আরও পড়ুন-ভারতীয়দের শরীরে তিলে তিলে বাসা বাঁধছে মারণ রোগ ক্লাইমেট অ্যাংজাইটি! কে দায় নেবে

তবে বেশ কয়েক বছর ধরেই সেই স্বাদ ও গন্ধ পাওয়া যাচ্ছেনা গুড়ের। সেভাবে খেজুর রস পাওয়াও যাচ্ছে না। শিউলিরা জানাচ্ছেন, তার প্রধান কারণ ক্ষণস্থায়ী শীত।বছর দশক আগেও একটা গাছ থেকে এক হাঁড়ি করে খেজুরের রস পাওয়া যেত। কিন্তু এখন সারাদিন থাকলেও সেভাবে আর রস মিলছে না। অন্যদিকে নতুন প্রজন্মের কেউই এই কঠিন কাজে আসতে চাইছে না। তাই খেজুর গুড় কম উত্‍পাদন হচ্ছে। ফলে খাঁটি খেঁজুর গুড়ে মিশছে অন্য গুড়।স্বাদ হারাচ্ছে বাঙালির প্রিয় নলেন গুড়। শিউলিদের একটা অংশ আবার অন্যের জমিতে ভাগের চাষ করে জীবন চালান। এই সময়টায় জোগাড়ে দিয়ে কাজ চালাতে হয়। ফলে লভ্যাংশ ভাগ হয়ে যায়, হাতে কিছুই পড়ে থাকে না। বাজারে প্রত্যাশিত দাম পাওয়া যায় না বলেও হাল ছেড়ে দেন কেউ কেউ। তবু হাতেগোনা কয়েকজন শিউলি আজও সকালে রস তুলতে যায় পূর্বপুরুষের সংস্কৃতিটাকে সম্মান করেই। আর ভালো গুড়ের স্বাদটুকু ধরে রাখতে আমাদেরও কদর করতে জানতে হবে।

More Articles