শিব নয়, পায়ের নীচে থাকে অসুর, সিংহ! চমকে দেবে ৩০০ বছরের পুরনো বাংলার এই কালীর রহস্য

Balurghat Kali Puja : দোল উৎসবের সময় হয় এই বিশেষ পুজো, অবাক করবে বাংলার তিনশ বছরের পুরনো এই কালীর রহস্য

কলকাতা নামের সঙ্গে কালী শব্দের যোগাযোগ আছে ঠিকই, তবে কালী নিয়ে এই বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিশ্বাস কেবল কলকাতাতেই সীমাবদ্ধ নয়। জেলায় জেলায় রয়েছে এমন অজস্র রহস্য। প্রাচীনত্ব এবং ইতিহাসের জোরে যেখানে আজও রীতি মেনে আরাধনা করা হয় দেবীর। কোথাও দেবী শাকাহারী, কোথাও আবার ঘুমোতে যাওয়ার সময় লাগে ওষুধ, নানান শিব অজানা রহস্য রয়েছে বাংলার এই কালীতত্ত্ব নিয়ে। ধরা যাক, কালী পুজো,, চোখ বন্ধ করলে দেবীর যে মূর্তিটা ভেসে ওঠে সেটা ঠিক কীরকম? রুদ্র মূর্তি, চার হাত। এক হাতে মুন্ড মালা, অন্য হাতগুলিতে অস্ত্র। দেবী স্বয়ং শিবের বুকের ওপর দন্ডায়মান, এবং জিভ কাটা। তবে আজ যে কালী কথা বলা হচ্ছে তিনি এই চিরাচরিত ধারণার থেকে এক্কেবারে আলাদা।

লম্বায় প্রায় সাড়ে দশ হাত এই কালীর পায়ের নীচে শিব নয়, রয়েছে অসুর এবং সিংহ। শুনে খানিকটা অবাক লাগলেও, বাংলার এই বিশেষ কালীর রূপ এইরকমই। এখানেই শেষ নয়, দেবী এখানে অষ্টভূজা। আরও অবাক করবে যে বিষয়টি তা হল, অমাবস্যা নয়, পূর্ণিমা তিথিতে পূজিতা হন দেবী। প্রতিবছর দোল পূর্ণিমার প্রতিপদ তিথিতে এই চঞ্চলা কালীর পুজো অনুষ্ঠিত হয়।

আরও পড়ুন - রীতিমতো শিকলে বেঁধে পুজো করা হতো দেবীকে, বাংলার এই কালীকে ঘিরে রয়েছে অজানা রহস্য

দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট, এখানেই রয়েছে এই তিনশ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য। তবে এই পুজোয় শুধু দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার নয়, বিহার, ঝাড়খণ্ড সহ ভিনরাজ্যের ভক্তরাও উপস্থিত হন। এই পুজোকে কেন্দ্র করেই বসে মেলা। আর এই মেলায় হল প্রাচীন এই ঐতিহ্যের আসল কেন্দ্রবিন্দু। ভক্ত আর ভক্তির জোর যে ঠিক কতটা তা অবশ্য নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনশ বছরের এই অভ্যাস জানান দেয়। প্রতি বছরের মতো এই বছরেও দোল পূর্ণিমা তিথিতে পুজো এবং মেলার জমাটি আয়োজন শুরু হয়েছে।

বালুরঘাট শহরের অদূরে ডাঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েতের হোসেনপুরের কাছে চকবাখর গ্রামেই প্রতিবছর পূজিতা হন এই চঞ্চলা কালী। দোল পূর্ণিমার ঠিক পরের দিন অর্থাৎ প্রতিপদ তিথিতে গভীর রাতে শুরু হয় এই বিশেষ পুজো। এক পায়ের নীচে অসুর, অন্য পায়ের নীচে সিংহ। বলা হয়, মহামায়া ও চামুণ্ডার এক মিলিত রূপ এই চঞ্চলা কালী মাতা। তাই এরকম দুই রূপের মিলন দেখা যায় দেবীর আত্মপ্রকাশে।

কথিত আছে, আজ থেকে তিনশ বিচরাগে এই এলাকায় প্রথম পুঁজি শুরু হয়। শুরুটা অবশ্য হয়েছিল কিছু অলৌকিক নিদর্শনের হাত ধরেই। তখন মাহিনগর এলাকার মহি রাজা এই পুজোর প্রচলন করেন। মাহিনগর থেকে সুরঙ্গ পথে চকবাখরে এসেছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর এই পুজো দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। পরবর্তীতে এই এলাকার বাসিন্দা স্বপ্নাদেশ পেয়ে আবার পুজোর সূচনা করেন। এই পুজোর আর্থিক সহযোগিতা করত স্থানীয় জমিদার সুধীর চৌধুরী।

প্রথমে এখানে পাকা মন্দির ছিল না, মাটির মন্দিরেই শুরু হয় পুজো। পরে অবশ্য টিনের চাল দেওয়া পাকা মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হয় এখনও চলছে সেই কাজ। সারা বছরের নিত্য পুজো করেন একজন নির্দিষ্ট পুরোহিত। এছাড়াও বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে একাধিক পূজারীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।এখানে চঞ্চলা কালী মন্দিরের পাশেই রয়েছে শ্মশান কালী ও মাশান কালীর মন্দির।

আরও পড়ুন - বিশ্বাসে মিলায় চাকরি? মন্দার বাজারেও নাকি ষোলো আনা মানতেই চাকরি দেয় এই ‘সার্ভিস কালী’!

মা চঞ্চলার পুজোর পরের দিন ওই দুই মন্দিরেও তন্ত্র মতে পুজো করা হয়। এই মন্দিরের সামনেই রয়েছে প্রাচীন এক নাটমন্দির। এখানে পুজোর পরে দুদিন রাতভর মঙ্গলচন্ডীর গান শোনানো হয়। এছাড়াও এই মন্দিরের পাশেই রয়েছে একটু বিশেষ পুকুর। এই পুকুর্যে নিয়েও রিয়েছে রহস্যময় অতীত। শোনা যায়, একসময় নাকি পুজোর কাজের জন্য থালা-বাসন ভেসে উঠত এই পুকুরে। বর্তমানে এই পুকুরের জল দিয়েই কালীর পুজো করা হয়। পুজোর পাঁচ দিন আগে ঘট বসে মন্দিরে। এখানে আজও প্রচলিত রয়েছে বলির প্রথা। পাঁঠা এবং পায়রার মাথায় চুল বলি হয় প্রতি বছর। বলির জন্য কাঠের কাতরা এই পুকুরেই বছরভর ডোবানো থাকে। পুজোর দিন বিকেলে তা তুলে এনে বলির কাজ করা হয়।

পুজো ঘিরে এই অঞ্চলে টানা তিন দিন ধরে চলে মেলা। মেলায় অন্যান্য পরিচিত পসরার সঙ্গে থাকে এক বিশেষ আকর্ষণ। একটি বড় কাঠের পাটাতনে পুঁতে রাখা পেরেক ও খর্গের উপর ভক্তরা শিব কালী সেজে নাচ করেন। বিভিন্ন লোকবাদ্য যেমন ঢাক, ঢোল, কাঁসর ব্যবহৃত হয়। লোকনৃত্যের অঙ্গ মুখা নাচ ও অস্ত্র নিয়ে খেলার রীতি রয়েছে এখানে। যা লোকসংস্কৃতির একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক। প্রায় ২৫ জন ভক্ত একযোগে এই নাচ ও খেলা দেখান। সব মিলিয়ে এই পুজো বাংলার এক প্রাচীন ঐতিহ্যের উদাহরণ যে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

More Articles