সামান্য স্টার্টআপ থেকে কোটিপতি, জেনে নিন NYKAA কোম্পানির কর্ণধার ফাল্গুনী নায়ারের সাফল্যের কাহিনী

একবিংশ শতকে দাড়িয়ে আজকের দিনেও মেয়েদের নিয়ে কথা বলা কিংবা তাদের কাজের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার দিন আজকেও শেষ হলনা। অনেকেই এখনো ঠিক করে দিতে চান মেয়েরা ঠিক কতটা কাজ করতে পারবে কিংবা কোন কোন পেশায় মেয়েদের 'মানাবে'! ঘরে হোক কিংবা বাইরে মেয়েদের অনেক জায়গাতেই অনেক বাধানিষেধ ঘিরে ধরে। আজকের সমাজেও মেয়েদের অধিকারের ওপরে হস্তক্ষেপ করার মানুষের অভাব হয়না। কিন্তু সেখানে দাড়িয়েই যদি কোনো মেয়ে এই ঘেরাটোপের বেরা ভেঙে দিয়ে নিজের পছন্দের কাজ করে পুরুষদের টেক্কা দিতে পারে সেখানেই এই লড়াইয়ে এক একটা করে মাইলস্টোন যোগ হতে থাকে। আর এই মাইলস্টোন শুধুমাত্র যে সেই মেয়েটির অগ্রগতির মানক হয় সেটাই না, এই একটি মেয়ের অগ্রগতি আগামী দিনে অনেক মেয়ের পথ চলার রাস্তাটাকে প্রশস্ত করে দেয়।

আজকে এমনই একজন ছক ভাঙ্গা মহিলার অগ্রগতির কাহিনীই প্রধান আলোচ্য। সেই মহিলার নাম ফাল্গুনী নায়ার। একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের কর্মী থেকে জীবন শুরু করে তিনি আজকে হয়ে উঠেছেন ভারতের সবথেকে ধনী মহিলা ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম। আইআইএম আহমেদাবাদ থেকে এমবিএ ডিগ্রী অর্জন করে ফাল্গুনী নিজের জীবন শুরু করেছিলেন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের একজন উচু পদের কর্মী হিসাবে। কিন্তু, ২০১২ সালে তিনি ভাবলেন নিজের একটা আলাদা কোম্পানি তিনি তৈরি করবেন। কিন্তু সেই সময়ে একটা ছাপোষা গুজরাটি পরিবারে একজন মেয়ের নিজের উদ্যোগে ব্যবসা গড়ে তোলাটাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখা হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েই কার্যত ৫০ বছর বয়সে নিজের নতুন ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিলেন ফাল্গুনী। তবে সামনে ছিল প্রচুর সমস্যা। সমাজের রক্তচক্ষু থেকে শুরু করে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লড়াই, সবকিছুই ছিল তার সামনে। কিন্তু সেসবকে সঙ্গে নিয়েই নিজের সমস্ত ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ফাল্গুনী শুরু করে দিলেন নিজের নতুন ব্যবসা।

তার ব্র্যান্ড এর নাম তিনি গ্রহণ করলেন সংস্কৃত শব্দ নায়িকা থেকে। সংস্কৃত শব্দ নায়িকা - র অর্থ হলো শ্রেষ্ঠ নারী, রূপে, গুনে যিনি অনন্যা। ভারতীয় নারীদের রূপে গুনে অনন্যা করে তুলতেই তার এই নতুন ব্র্যান্ড করলো আত্মপ্রকাশ। ভারতীয় নারীদের সাজিয়ে তুলতে ফাল্গুনী নায়ার শুরু করে দিলেন তার নতুন স্টার্টআপ, যা আজকে হয়ে উঠেছে ভারতের মহিলা পরিচালিত ব্যবসার জগতে একটি ধ্রুবতারার মতোই। ভারতীয় নারীদের পাশ্চাত্যের কসমেটিকস এবং লিপস্টিকের শেডের সাথে পরিচিত করাতে ভারতে লঞ্চ হলো ভারতের হয়তো সবথেকে প্রথম কসমেটিকসের শপিং ওয়েবসাইট, নায়কা (NYKAA) যার ব্যাপারে জানেন না এমন হেন কোনো মানুষ আজকে নেই।

তবে এই জার্নি যে খুব একটা সহজ ছিল তা কিন্তু একেবারেই না। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, ভারতে কি আর কসমেটিকস পাওয়া যায়না? তাহলে আবার একটা নতুন কোম্পানি খোলার কি দরকার? ভারতে অবশ্যই প্রসাধনী পাওয়া যেত এবং তাদের ভ্যারাইটিও যথেষ্টই ছিল, কিন্তু পাশ্চাত্যের সঙ্গে ভারতের কসমেটিকস ছিল অনেকাংশেই কম। তার পাশাপাশি সমস্ত ভারতীয় স্কিন টোনের জন্যও এই সমস্ত কসমেটিকস ব্যবহারযোগ্য ছিল না। তাই সমস্ত ভারতীয় নারীদের কথা ভেবে ভালো মানের প্রসাধন সামগ্রী ভারতের নারীদের হাতে তুলে দিতেই ফাল্গুনী শুরু করে দিলেন তার ব্র্যান্ডটিকে। তার পাশাপাশি অ্যাপ লঞ্চ করে শপিং ই কমার্স স্টোর তৈরীর ক্ষেত্রেও নায়কা সবার আগে। 

তবে শুধুই কি অনলাইন ব্যবসা? এখন অফলাইন দোকান হিসাবেও আস্তে আস্তে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করেছে নায়কা। ইতিমধ্যেই ভারতে নানান জায়গায় ৭০ এর বেশি আউটলেট তৈরি করে ফেলেছে এই সংস্থাটির। ক্রেতারা যাতে নিজেরা নিজেদের পছন্দমতো সামগ্রী কিনে নিতে পারেন সহজেই তার জন্যই ই অফলাইন মার্কেট তৈরীর ভাবনা নিয়েছিলেন ফালগুনী। অনেকেই এখনো এমন আছেন, যারা এই অনলাইন মার্কেট ব্যাপারটির সঙ্গে খুব একটা সাবলীল হয়ে উঠতে পারেননি। তাই তাদের জন্যই এই অফলাইন রিটেলার স্টোরের ভাবনা। তার সাথেই রয়েছে নামজাদা নায়িকাদের দিয়ে বিজ্ঞাপন, বিভিন্ন সিনেমায় এবং একাধিক জায়গায় কসমেটিকস স্পন্সর ও আরো কত কিছু।

ভারতের নারীদের ত্বকের রঙের ওপরে নির্ভর করে একাধিক লিপস্টিক, নেলপালিশ এবং ফাউন্ডেশনের শেড নিয়ে এসেছেন ফাল্গুনী নায়ার। ব্রাইডাল মেকআপ হোক কিংবা সাধারণ মেকআপ, সবেতেই ভারতীয় নারীদের সাজাতে নায়কার জুড়ি মেলা ভার। ফাল্গুনী যখন নিজের ব্যবসা শুরু করেছিলেন সেই সময়ে ভারতের মার্কেট পুরোপুরিভাবে দখল করে রেখেছিল কিছু পুরনো কসমেটিকস ব্র্যান্ড যেগুলো কালের সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেছে পুরনো। কিন্তু নায়কা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়ে উঠেছে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। 

এখন শুধুমাত্র প্রসাধনী সামগ্রীর স্টার্টআপ কোম্পানি হিসেবে নয়, সম্প্রতি ক্রেতাদের সামনে নিজেদের অলংকার এবং পোশাক-আশাকের সম্ভার নিয়ে হাজির হয়েছে নায়কা। তবে এতেই শেষ না, নিজের এই ব্যবসাকে আরো বড় করতে চাইছেন ফাল্গুনী নায়ার। চলতি বছরে ফাল্গুনীর এই সংস্থার শেয়ার মূল্য বিশাল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এছাড়াও, এই সংস্থা ভারতের স্টক মার্কেটে বিশাল বড় প্রভাব ফেলেছিল গত বছরে। ভারতে যে সমস্ত মহিলা নিজের উদ্যোগে নিজের ব্যবসা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন তাদের মধ্যে ফাল্গুনী অন্যতম। এই তালিকায় থাকা সবথেকে ধনী মহিলাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ফাল্গুনী নায়ার। ব্লুমবার্গের বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী তিনি ভারতের অন্যতম ধনী মহিলা ব্যবসায়ী। বর্তমানে তার সম্পত্তির পরিমাণ সাড়ে ছয় কোটি মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। ফালগুনীর মত মহিলারা ভারতের পিছিয়ে পড়া মানসিকতার মানুষকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে প্রমাণ করিয়ে দেন, বয়স, কিংবা লিঙ্গ পরিচয় কোনটাই মানুষের সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। যদি কোন মানুষের চেষ্টা থাকে অদম্য, তাহলে তার সফল হওয়া শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।

More Articles