অশান্ত সময়ে সঠিক উচ্চারণের এক স্তম্ভ ছিলেন মিহির সেনগুপ্ত

সমাজ নির্দেশিত অস্তিত্বহীনতার ভিতরে অস্তিত্বের অনুসন্ধাই ছিল সদ্য প্রয়াত মিহির সেনগুপ্তের সৃষ্টির অন্যতম প্রধান সুর। যে বিভাজিত বাংলাকে 'বিশ্বাস' নামক বোধের সমাধিভূমি হিসেবে সহজে চিহ্নিত করতে চায়, যেন বিজন ভট্টাচার্যের ফিল্মি ডায়লগের মতোই, ভাঙা বাংলায় ভাটিপুত্রের বাখোয়াজি দিয়েই রঙ্গের ছলে 'বিশ্বাস'কে ফিরিয়ে আনতেই কলম যুদ্ধ চালিয়েছিলেন মিহির। বিভাজন ঘিরে অনেক সন্দর্ভ রচিত হয়েছে। ফিল্ম হয়েছে। অত্যন্ত উঁচুমানের সাহিত্যকর্ম হয়েছে। আবার সাবান সাহিত্যও হয়েছে।জাতিভেদের দীর্ণতায় জর্জরিত সেকালের পূববাংলার সামাজিক জীবনে নিম্নবর্গের কামলার আত্মীয় পরিজন উচ্চবর্ণের  অভিজাত মালিকের অন্দরমহলে বসে নৈশাহার করছে। প্রভুপত্নী নিজে পরিবেশন করছেন, দেশভাগের পটভূমিতে এমন সাবান-সাহিত্য বইবাজারে একদম হটকেক। মিহির সেনগুপ্ত কখনো হটকেক রাঁধতে বসেননি সাহিত্যের ভিয়েনে। তাই দেশভাগ, হিন্দু- মুসলমান সম্পর্ক-- এইসব স্পর্শকাতর বিষয়গুলি কখনোই মিহির সেনগুপ্তের কাছে বিপনণের খুব মশলাদার বিষয় বলেও মনে হয়নি।তাই চোখের জলের জ্যাবজ্যাবে সেন্টিমেন্ট মেশানো কোনো আবেগঘন বিষয় কখনোই আমরা তাঁর লেখার মধ্যে দেখি না। দেখতে পাই না অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ইচ্ছাকৃত অভিযুক্ত করবার পৌনঃপুনিকতা। মিহিরের লেখাতে যেমন থাকে না একঘেঁয়েমি, তেমনিই থাকে না হঠাৎ করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠবার কোনো উপকরণ। ফলে নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, মিহিরের লেখা বক্স অফিসের নিরিখে সাবান সাহিত্যের ধারপাশ দিয়ে যাওয়ার সাফল্যজনিত সৌভাগ্য কখনোই অর্জন করে উঠতে পারেনি।

বিশ্লেষণে গহন থেকে গহিনে ডুব দিতেই মিহির সেনগুপ্ত বেশি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতেন। তাই তাঁর কি বহুল প্রচলিত উপন্যাস, কি স্বল্পখ্যাত উপন্যাস বা ছোটগল্প অথবা ভাটিপুত্রের গর্বে গরিয়ান পত্র বাখোয়াজি- সব জায়গাতেই আমরা দেখতে পাই সত্যকে অনুসন্ধানে তৎপর এক ডুবুরির ডুব, ডুব সাঁতারকে। রূপসাগরে ডুব দিয়ে তিনি সবসময়েই অরূপ রতনের সন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। কি সেই অরূপরতন? মানুষে মানুষে ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক।সম্পর্কের সেই অতল ভুবনে জীবন পণ রেখে সাঁতার কাটতে কখনো ক্লান্তি ছিল না মিহির সেনগুপ্তের। আর সেই কারণেই মিহিরের লেখার ভিতরে মানুষকে আবার সেই মূল্যবোধ সম্পন্ন মানবিক জীবনে ফিরিয়ে দিতেই মিহির যেন তাঁর সবধরণের লেখার  প্রতিটি শব্দকে বার বার বুকের রক্ত দিয়ে রাঙিয়ে নিয়ে সাজিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-মধুস্মৃতির ছোটবেলাগুলি চলে গেল নারায়ণ দেবনাথ সঙ্গে, নন্টে-ফন্টে-কেল্টুদের আজ চোখে জল

মিহিরের লেখার শব্দচয়ন হয়ে বিষয়বস্তু,তা থেকে উপস্থাপনা- পাঠককে কখনো অভিধান খুলে পড়তে বসতে হয় না। মিহির যে সময়টা জুড়ে সৃষ্টিকর্মে মগ্ন থেকেছেন , সেই সময়কালেই একটা বড় অংশের সাহিত্যিকদের সৃষ্টি আমাদের কেবল পড়তে গেলেই পাশে একটা বেশ মোটাসোটা অভিধান খুলে রাখতে হয়। প্রথমে কঠিন কঠিন শব্দের মানে বোঝা।তারপর তো বিষয়বস্তুর ভিতরে ঢুকতে পাড়ার চেষ্টা। সকলেই চান কমলকুমার মজুমদার হতে।তাঁদের ধারণা বুঝি , যত বেশি পাঠকের মাথার উপর দিয়ে সাহিত্য চলে যেতে পারে, সেই সাহিত্য ততবেশি উঁচু দরের সাহিত্য হয়।তাই বাজার চলতি সাবান সাহিত্য তৈরির পাশে একটা বড় অংশের সাহিত্যিক ভাষা, আঙ্গিক, বিষয়বস্তুর অপাঠ্য দুর্বোদ্ধতাকেই সবথেকে উঁচুদরের সৃষ্টি, সফল সৃষ্টি বলে মনে করে থাকেন।

সেই পথ দিয়ে কিন্তু মিহির সেনগুপ্ত কখনো হাঁটেন নি। যদি হাঁটবার ইচ্ছেটুকুও কখনো মিহিরের হতো,তাহলে ১৯৫৯ সালের প্রেক্ষিত কে সামনে রেখে, সেই সময়ের দুইবাংলার আর্থ- সামাজিক- রাজনৈতিক জগতকে মাথায় রেখে' ঘা' গল্প লেখা তো দূরের কথা, অমন গল্পের প্রেক্ষিতই তিনি ভাবতেন না।এই গল্পটিতে মিহির লিখছেন; " যারা সুবিধে করতে পেরেছে,দেশভাগের পর কিছু এবং পঞ্চাশের দাঙ্গা - ফ্যাসাদে আঞ্চলিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না হলেও , আতঙ্কে বাকিরা ভিটেমাটি বিক্রি করে,বা কাউকে দায়িত্ব দিয়ে চলে গেছে। তবু নমশূদ্র এবং প্রান্তিকজনদের অনেক মানুষই এখনও আছে, আছে নিরুপায় ভদ্র শিক্ষিত তকমার পরিবার। এরা সবাই বেশিরভাগ জমিনির্ভর পরশ্রমজীবী এবং স্বভাবগতভাবে কুচক্রী।"

 মিহির যদি কোনো রাজনৈতিক দলভুক্ত প্রগতিশীল লেখক হতেন, তবে নিশ্চিত করেই বলতে পারা যায় যে, এমন অমোঘ সত্য উচ্চারণ তাঁর পক্ষে সম্ভব হতো না। তখন এমন উচ্চারণ করা মাত্রই 'তংখাইয়া' হিসেবে ঘোষিত হতেন লেখক। দেশভাগের সময়কালের অভিজাত,অচ্ছুৎ- যাইহোক না কেন,  'হিন্দু' হলেই তিনি  ধোয়া তুলসীপাতা, প্রফুল্ল রায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়দের এই ধারণার পাশ দিয়ে মিহির সেনগুপ্ত কখনো হাঁটেননি। যেমন হাঁটতেন না সমরেশ বসু।সাধের বুড়িগঙ্গার পাশে আর কোনো নিঝুম সন্ধ্যায় বসে থাকতে পারবেন না মুনসীগঞ্জের সমরেশ, এই দুঃখ যেমন সমরেশ বসুকে চিরদিন কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছিল,তবু কখনো একটা দিনের জন্যেও পড়শি মুসলমান সমাজ সম্পর্কে একটাও অনৈতিহাসিক, ব্যক্তিঅসূয়া জনিত কথা তিনি বলেননি, বরং 'সদাগর' উপন্যাসে দেখিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের অভিজাত হিন্দু কী ভাবে ঠকিয়ে স্বর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে ছিন্নমূল হিন্দুকেই , তেমন ভাবেই দেশভাগের পরেও সাবেক পূর্ব পাকিস্থানে থেকে যাওয়া হিন্দুদের একটা বড় অংশকে,'স্বভাবজাতভাবে কুচক্রী' বলে এতটুকু কলম কাঁপছে না মিহির সেনগুপ্তের।

ইতিহাস বোধের সঠিক উপলব্ধি যে কখনো মানুষকে 'হিন্দু' করে না, 'মুসলমান' করে না, শিখ,খ্রিস্টান,জৈন ও নয়- এটা মিহির সেনগুপ্তের হাতে ফলানো ফসলের যে কোনো একটার স্বাদ নিলেই সহজে বুঝতে পারা যায়। ভোট রাজনীতি করা বামপন্থীরা মুখে শ্রেণী রাজনীতির কথা বলে, মুসলমান বিদ্বেষ ছড়াতে তপশিলি জাতি ,উপজাতির কার্ড এই দেশভাগের প্রেক্ষিতে খেলতে কখনো কসুর করে নি।মুসলমানের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সামাজিক স্থিতি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রশ্নে সরব হলেই ভোটপাখি বামপন্থীদের ভিতরে আত্মোপলব্ধি ঘটে,' আমরা তো শ্রেণী রাজনীতির কথা বলি'। অথচ যোগেন মন্ডলের রাজনীতিকে তুলে ধরে , পিছড়ে বর্গপ্রীতির নামে মুসলমানদের খেউড় করা থেকে তাঁদের একটা বড় অংশ কখনোই পিছপা হয় না।

এই অংশের ধান্দাবাজ ভোটপাখিদের উদ্দেশে মিহির সেনগুপ্তের এই যে উচ্চারণ,' স্বভাবগতভাবে কুচক্রী' ,তা নিয়ে সরব হলে , বর্ণবাদীর তকমাও দিয়ে দিতে পারেন দলিত সাম্প্রদায়িকতা করা ,মুসলমান বিদ্বেষী, বামপন্থাকে ধান্দাবিজির উপকরণ করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেওয়া একটা অংশের তথাকথিত প্রগতিবাদীরা। তাই মিহির সেনগুপ্তের মতো উচ্চারণ,' পঞ্চাশের ঝঞ্ঝাটের সময় , রমজান কাকা এবং কিছু সমমনষ্ক বন্ধুবান্ধব মিলে একটি দাঙ্গা বিরোধী বাহিনী গঠন করে গজালিয়া দোনের উত্তর কুলের গ্রামগুলোকে রক্ষা করেছিলেন' - এমন সত্য,স্পষ্ট উচ্চারণ আমরা সাধারণ ভাবে আগমার্কা প্রগতি শিবিরের লেখকদের লেখার ভিতরে প্রায় কখনোই পাই না। দেবেশ রায়ের যোগেন মন্ডলের জয়গানের সঙ্গে বিস্তর ফারাক মিহির সেনগুপ্তর লিখন-রাজনীতির।

মিহিরের লেখায় উঠে (ঘা) আসা রমজান কাকা কিন্তু প্রথাগত শিক্ষার তেমন সুযোগ পাননি। তাই বলে তিনি লিখতে পড়তে একটুআধটু জানেন না, তাও নয়। দোকানদারি করে খান। দোকান চালাবার মতো চালকলার শিক্ষা জীবন থেকে তিনি আত্মস্থ করেছেন। যোগ বিয়োগের চলতি দু'চারটে ব্যাপারও কোনো মতে জানেন। তবে কোথায় শিখেছেন এইসব, এই প্রশ্ন রমজান কাকার কাছে করা হলে বেচারি একটু বেকায়দায়েই পড়ে যাবেন আর কী!
পাঠক লক্ষ্য করুন, ছয়ের দশক শুরু হওয়ার আগের যে প্রেক্ষিত মিহির সেনগুপ্ত লিখছেন, সেখানে কিন্তু ' রমজান কাকা' শব্দটিই ব্যবহৃত হচ্ছে।' রমজান চাচা ' নয়।উনিশ শতকের সংস্কারবাদী আন্দোলনের জেরে হিন্দু এবং মুসলমানের একটা অংশ আরও বেশি 'হিন্দু' ,আরও বেশি 'মুসলমান'  হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। বীরাচারী 'অনাচার' থেকে হিন্দুদের বাঁচাতে শশধর তর্কচূড়ামণিরা যেমন তৎপর হয়েছিলেন, তেমনিই ' পীরতন্ত্রে'-র 'হিন্দুয়ানী' প্রভাব দূর করবার আড়ালে সমন্বয়বাদী সাধনা, যেটি পবিত্র ইসলামের একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক, সেটিকে অবলুপ্ত করে হজরত মহম্মদ (সঃ) উত্তর যুগের মৌলবীদের আরোপিত কট্টরপন্থায় ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে আহলে হাদিস প্রমুখ তরিকা কাকাতুয়া পাখিকে চাচাতুয়া বলা, কলাপাতার উল্টোদিকে খাওয়া ইত্যাদি যেসব ব্যাপা স্যাপার চালু করেছিল, তা আমাদের জাতীয় আন্দোলনের শেষ পর্বে দেশভাগের বিয়োগান্তক অধ্যায়কে অনেক সুবিধাজনক জায়গাতে এনে দিয়েছিল।বাংলার মুসলিম লীগের কট্টরপন্থী নেতা মওলানা আকরাম খাঁয়ের মতো মানুষেরা তাই বলতে পেরেছিলেন; সুফিয়া কামাল ' খালাম্মা' ডাকের থেকে ' মাসিমা' ডাক শুনতে বেশি ভালোবাসেন।

মিহির কিন্তু দেশভাগের বিভাজিত রাজনীতির গহিনেও বাঙালি সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত সত্যকেই ' রমজান কাকা' উচ্চারণের ভিতর দিয়ে তুলে ধরেছিলেন।বাংলাভাষায় সাংস্কৃতিক ফার্সিকে চেপে দিয়ে , ধর্মীয় আরবিকে চাপিয়ে দেওয়ার যে সেই সময়ের পশ্চিম পাকিস্থানের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ,তাকেই অসামান্য মুন্সিয়ানার মাধ্যমে মাত্র দুটি অক্ষর দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

More Articles