সাধ্যের মধ্যে সাবেকি স্বাদ, ৯০ বছর পার করে এসেও যেভাবে বাঙালির প্রিয় 'বড়ুয়া বেকারি'
Baruya Bakery : যুগের পর যুগ ধরে বাঙালির রসনা-ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করছে কলকাতার বড়ুয়া বেকারি
রাত পোহালেই বড়দিন। শহর কলকাতার ঘিঞ্জি অলিগলি থেকে শুরু করে খোদ পার্কস্ট্রিট চত্বর কিংবা শহরতলির আনাচে কানাচে এখন সাজো সাজো রব। রং বেরঙের আলোর রোশনাই আর লাল টুপির শহরে বাড়তি পাওনা হল পেটপুজো। বাঙালির যে এই বারো মাসে তেরো পার্বণের ভুত কবেই চোদ্দ পনেরো ষোলো কাটিয়ে হাজার পার্বণের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়ে তা এখন আর আঁচ করা মুশকিল। বিবিধের মাঝে পড়ে বাংলার এখন হাঁসফাঁস অবস্থা। সব ধর্মকে মাথায় করে রাখার সবটুকু ইচ্ছে কেবল গিয়ে ঠেকেছে উৎসবে আর খানাপিনায়। বড়দিন তার ব্যতিক্রম নয়।
ডিসেম্বরের শহরে এমনিতেই বড় বেশি উত্তেজনা। আর এর শেষটুকু জমিয়ে রাখে ক্রিসমাস। এ সময় শহর এবং শহরতলির রাস্তায় উপচে পড়ে কেকের ভিড়। পথ চলতি ছোট বড় দোকান থেকে শুরু করে নামজাদা বেকারি সবেতেই ঠাসা কেক। কাপ কেক, বাটি কেক, বাপুজি কেকের থেকে খানিক আলাদা। নানা রঙের অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মোড়া কেক। কোনোটা চৌকো, কোনটা গোল। তার ওপরে আবার নানা রঙের ডেকোরেশন। এতেই মজেছে আট থেকে আশি।
আরও পড়ুন - কেক বানাতে পারেন? শখ পেশা হলে উপার্জন লাখে, কীভাবে জানুন
হাল আমলে কেক খাওয়া অবশ্য একটা ফ্যাশন। বছরভর দেদার ভিড় জমে দোকানে। যেকোনো উৎসবেই কেক কাটা দস্তুর। কিন্তু বড়দিনের কেক একটা অন্য আমেজ। আর এই নস্টালজিয়ায় জাঁকিয়ে বসে আছে বড়ুয়া বেকারি। শতাব্দীর দোরগোড়ায় এসেও দিব্যি টগবগে মেজাজে কলকাতার রসনা তৃপ্তির জোগান দিচ্ছে বড়ুয়ার দোকান।
বৌবাজার সংলগ্ন বো ব্যারাকের জে এন বেকারি ওরফে বড়ুয়া বেকারি। আধুনিকতার ভিড়ে আজও পাল্লা দিচ্ছেন এনারা। কলকাতার এই যে কেক ব্যবসা, তাতে অবশ্য অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের প্রাধান্যই বেশি ছিল। কিন্তু তাতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি বড়ুয়াদের। তাঁদের ব্যবসার আসল এসেন্স হল গুণমান এবং সবেকিয়ানা। যা দীর্ঘ ৯০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাঙালির মুখে হাসি ফুটিয়ে আসছে। বড়ুয়ার কেক মানেই চিরন্তন একটা ফিরে দেখা। এ ফিরে দেখায় ভিড় করে আসে অজস্র ইতিহাস। যে ইতিহাসের পরতে পরতে রয়েছে নানা রকম খাবারে স্বাদ। হাল আমলের অতি প্রিয় অভ্যাসে যে টিফিন কেকের নাম শোনা যায়, তার স্রষ্টাও এঁরাই।
সময়টা ১৯৩০ সাল। পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রাম থেকে কলকাতায় প্রথম পা রাখলেন ছিন্নমূল মনোতোষ বড়ুয়া। শুরুতেই অবশ্য ব্যবসা জমানোর অর্থ হাতে ছিল না। তাছাড়া এই কেকের ব্যবসার কারিগরিও বিশেষ জানতেন না তিনি। তাই নামমাত্র বেতনে শিক্ষানবিশ হয়ে যোগ দিলেন তৎকালীন সম্ভ্রান্ত এক প্রতিষ্ঠানে। নাম ‘ফারপো’। কেক ব্যবসায় তাঁর আগ্রহ ছিল পুরোদস্তুর। তাই কম দিনের মধ্যেই আয়ত্ত করে ফেললেন কেক প্রস্তুতির খুঁটিনাটি। একদিকে পরিবারের দায়ভার অন্যদিকে নিশ্চিন্ত চাকরির আশ্রয় ছেড়ে ব্যবসা, কী করবেন বুঝতে পারেননি মনোতোষ। কিন্তু চোখে তখন ভিড় করে এসেছে হাজার রঙের স্বপ্ন। তাই আত্মবিশ্বাসের ওপর ভর করে চাকরি ছেড়ে নেমে পড়লেন ব্যবসায়। ঝুঁকি ছিল ঠিকই তবে মনের জোরে জয় করলেন সেই কঠিন পথ। মনোতষ ছিলেন খুবই পরিশ্রমী এক ব্যক্তিত্ব। তাই উচ্চতার শিখরে পৌঁছতেও বেশি সময় লাগল না তাঁর। অল্প সময়ের মধ্যেই কলকাতার অন্দরে জমিয়ে রাজ করল ‘বড়ুয়া বেকারি’।শহরবাসীর মুখে লেগে গেল বড়ুয়া বেকারির কেক পেট্রিসের লোভনীয় স্বাদ। ফ্রুট কেক থেকে শুরু প্লাম কেক খোদ বনেদি বাড়িতেও একটাই নাম, তা হল বড়ুয়ার কেক।
পারিবারিক গোলযোগ, মতের অমিল ব্যবসাকে ভেঙে দেয় পরবর্তী সময়ে। কলকাতায় এখন বড়ুয়া বেকারির চারটি শাখা। কিন্তু নামের জোরে যে পিছুটান আছে তা ফিকে হয়নি একটুও। যে বেকিং ব্যবসা শুরু করেছিলেন মনোতোষ বড়ুুয়া তা আরও এগিয়ে যায় তাঁর দুই উত্তরাধিকার সুধীর বড়ুয়া ও মনোরঞ্জন বড়ুয়ার হাত ধরে।
আরও পড়ুন - ডাকাতরা না থাকলে জন্মই হত না কেকের? বড়দিনে কেক কাটার যে কারণ অনেকেরই অজানা…
মধ্য কলকাতায় দীর্ঘ ৯০ বছর ধরে মধ্যবিত্তের মুখে হাসি ফুটিয়ে এসেছে বড়ুয়া বেকারী। সারা বছর অবশ্য কেক সেভাবে পাওয়া যায় না। বছরের এই সময়টাতে পাউরুটির ব্যবসায় জাঁকিয়ে বসে বড়ুয়ার কেক। এই ২০ দিনই মেলে এই কেকের দেখা। ডিসেম্বর এর শুরু থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চলে কেকের রমরমা। যদিও আধুনিকতার ভিড়ে আজ বেশ খানিকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে বড়ুয়াড়া। তার ওপর নোট বন্দি, করোনা, এবং সর্বোপরি পরবর্তী প্রজন্মের ব্যবসায় অনীহা প্রতিযোগিতার বাজারে বড়ুয়া বেকারিকে বেশ খানিকটা পিছনে ঠেলে দিয়েছে। কোনোরকমে ঘুপচি ঘরে আজও শ্বাস ফেলছে বড়ুয়া বেকারি। কিন্তু দাম সেই ২৩০ এই আটকে। ওটাই সর্বোচ্চ কেকের মূল্য। সাধ্যের মধ্যে সাবেকি স্বাদ।
ব্যবসায় আগের রমরমা আর নেই ঠিকই তবু আবেগের সঙ্গে সবেকিয়ানার মিশেলে আজও বাঙালি ফিরে যায় বড়ুয়াদের দোকানে। আর বড়ুয়ারাও বাঙালির আবেগের দাম দিতে স্বল্প মূল্যেই হাতে তুলে দেন বড়ুয়ার কেক। পুরনো স্বাদে আজও লেগে রয়েছে সেকেলে ঐতিহ্যের রেশ। তাছাড়া আজকের আধুনিক কেকের বাজারে বড়ুয়ার মতো পকেটের এমন বন্ধু আর কে আছে!