দু'টি যৌনাঙ্গ, তিনটি পা, মানুষ একটাই! যে বিরল ঘটনায় হাঁ হয়ে গেছিল বিশ্ব

Frank Lentini: ১৮৯৮ সালে লেন্টিনিদের পা পড়ল আমেরিকার ব্রিজপোর্টে। আর ১৮৯৯ সালেই লেন্টিনি রিংলিং ব্রাদার্সের 'স্টার পারফর্মার' হয়ে উঠলেন।

১৮৯৯ সাল। গোটা আমেরিকা জুড়ে তখন সার্কাসের খুব প্রচলন। বিভিন্ন ধরনের 'ফ্রিক শোজ'-এর আয়োজকরা দর্শকদের মনোরঞ্জন করার জন্য নিজেদের সার্কাস দলকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন দেশ জুড়ে। কিন্তু 'ফ্রিক শো' নাম কেন? কারণ দর্শকদের মনোরঞ্জন করার জন্য এইসব সার্কাস দলে থাকতেন তাঁরাই, যাঁরা জন্মগতভাবে স্বাভাবিক নন, যারা 'ফ্রিক'। কারও হাতির শুঁড়ের মতো নাক, কারও জিরাফের মতো লম্বা গলা, কারও কুমিরের মতো মুখ, কারও উচ্চতা এক ফুটেরও কম, কোনও মহিলার পুরুষের মতোই দাড়ি গোঁফ, তো কেউ হুবহু হনুমানের মতোই দেখতে। সপ্তাহান্তে মানুষের ঢল নেমে আসত এরকম মানুষ দিয়ে ভর্তি সার্কাসের তাঁবুর ভিতরে। টিকিটের টাকা মিটিয়ে, প্রাণ খুলে হো-হো শব্দে হাসতে গেলে একমাত্র উপায় হল 'ফ্রিক শো'।

রিংলিং ব্রাদার সার্কাস তখন আমেরিকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অদ্ভুতূড়ে সব মানুষদের নিয়ে তাদের সার্কাস দল। টিকিটের মূল্য আকাশছোঁয়া। ১৮৯৯ সালের এমনই একদিনে, রিংলিং ব্রাদার্সের সার্কাসের তাঁবুর ভিতরে শো দেখতে ঢুকে থমকে গেল দর্শক। তারা যা দেখল তা দেখার জন্য তাদের কোনওরকম মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। সেদিন সার্কাসের ভিতরে উপস্থিত দর্শকরা দেখল,  একটা বছর দশেকের ছেলে, যার তিন খানা পা, সে তার তিন নম্বর পা দিয়ে ফুটবলে শট মারছে, গোল করছে বলে বলে। সাইকেল চালাচ্ছে, আইস স্কেটিং করছে, দড়ির ওপর দিয়ে চলে বেড়াচ্ছে, এবং হাঁফিয়ে বসতে গিয়ে টুল না পেলে নিজের তিন নম্বর পা-কে ভাঁজ করে টুলের মতো বানিয়ে তার ওপরেই বসে পড়ছে। দর্শকরা হাঁ করে সেদিন প্রথমবার তাকিয়ে দেখল এই বিস্ময় বালককে। কে এই ছেলে? এই কি তবে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য?

হইচই পড়ে গেল বিশ্বজুড়ে। তিনটে পা? তাও আবার তিন নম্বর পা কার্যকারী। নিজের ইচ্ছায় নড়াচড়া করানো যায় সেই পা? এও কি সম্ভব?

সম্ভব। ১৮৮৯ সালের মে মাসে ইতালির সিসিলিতে জন্ম নেন এই বিস্ময় বালক, নাম ফ্রান্সিসকো ফ্র্যাঙ্ক লেন্টিনি। তাঁর বাবা মায়ের ১২ জন ছেলেমেয়ের মধ্যে এই পঞ্চম সন্তানের জন্মের সময় ডাক্তার আর নার্সরা অবাক হয়ে দেখেন শিশুটির তিনটি পা, চারটে পায়ের পাতা, ১৬ খানা আঙুল আর আর দু'খানা যৌনাঙ্গ। অবাক হয়ে যান প্রত্যেকে। 'প্যারাসিটিক টুইন' এমন একটি দুর্লভ রোগ, যা প্রতি ১০ লাখ শিশুর মধ্যে একজনের হয়। এক্ষেত্রে মায়ের গর্ভাবস্থায় পেটের ভিতরে বাড়তে থাকে যমজ সন্তান, কিন্তু তাদের দুজনের মধ্যে একজনই পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় এবং অন্যজন পরাশ্রয়ীর মতো লেপ্টে থাকে অন্যের শরীরে। ফ্র্যাঙ্ক লেন্টিনির ক্ষেত্রেও এই দুরারোগ্য একই কাজ করে। তার শরীরের তিন নম্বর পা এবং সেই তিন নম্বর পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে ঝুলতে থাকা একটি অপরিণত পায়ের পাতা আসলে তাঁর নয়, তাঁর যমজ ভাইয়ের, যা তাঁর শরীরে থেকেই বড় হয়েছে সারাজীবন। লেন্টিনির যখন ৪ মাস বয়স তখন তাঁর মা বাবা ডাক্তারদের কাছে যান, চিকিৎসা শাস্ত্রের সাহায্য নিয়ে অপারেশন করে কেটে বাদ দিয়ে দিতে চান লেন্টিনির তিন নম্বর পা এবং অতিরিক্ত যৌনাঙ্গটি। যাতে লেন্টিনি ভবিষ্যতে একটি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। কিন্তু বিধাতা বোধহয় অন্য কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে লেন্টিনিকে এই গোলকধাঁধায় পাঠিয়েছিলেন। ডাক্তাররা পরিষ্কার ভাষায় জানান, লেন্টিনির তিন নম্বর পা-টি জন্ম নিয়েছে মেরুদণ্ডের ঠিক নিচের দিক থেকে, তাই পা কেটে বাদ দেওয়া বিপজ্জনক হতে পারে। লেন্টিনির প্রাণ সংশয়ও ঘটতে পারে। রাজি হননি লেন্টিনির বাবা মা। তাঁরা সন্তানকে কোলে করে বাড়ি ফিরে আসেন। 

ধীরে ধীরে লেন্টিনির খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকে পাড়া প্রতিবেশী হয়ে ছোট্ট শহরের চৌদিকে। লোকে লেন্টিনির অদ্ভুত রূপ দেখে লেন্টিনিকে 'শয়তান বাচ্চা' বলে ডাকতে শুরু করে। স্কুলে, খেলার মাঠে বাচ্চারা লেন্টিনিকে ভয় পেতো, কেউ মিশত না। লেন্টিনির কোনও বন্ধু ছিল না। লেন্টিনি মুষড়ে পড়তে শুরু করল, নিজেকে নিয়ে লজ্জিত এবং অপ্রস্তুত বোধ করতে শুরু করলো। নিজেকে পঙ্গু এবং অক্ষম ভাবতে শুরু করল। কিন্তু লেন্টিনির বাবা মা চাননি লেন্টিনির শৈশব এইভাবে কাটুক। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন দেশ ছাড়ার। ১৮৯৮ সালে লেন্টিনিদের পা পড়ল আমেরিকার ব্রিজপোর্টে। আর ১৮৯৯ সালেই লেন্টিনি রিংলিং ব্রাদার্সের 'স্টার পারফর্মার' হয়ে উঠলেন। ভিড় জমতে শুরু করলো তাকে দেখার জন্য। প্রতিটা শো হাউসফুল, ব্লকব্লাস্টার। অন্য জীবনে পা রাখলেন লেন্টিনি। শরীরের যে অস্বাভাবিকতা তাকে একলা করে দিয়েছিল ইতালিতে তাঁর নিজের শহরে, শরীরের সেই অস্বাভাবিকতার কারণেই তিনি আমেরিকাতে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেন।

ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠলেন লেন্টিনি। শো করে প্রচুর নাম, অর্থ, যশ কামালেও লেন্টিনির বাবা চেয়েছিলেন লেন্টিনি যেন এই প্রতিপত্তির জোয়ারে ভেসে না যান। তিনি লেন্টিনিকে পড়াশোনা শেষ করিয়ে শিক্ষিত করে তোলেন। ২২ বছর বয়সে লেন্টিনি গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করার পর পুরোপুরি ভাবে পা রাখেন সার্কাস বা মনোরঞ্জনের জগতে। এই জগতে তার বিভিন্ন নাম জনপ্রিয় হয়। তিনি পরিচিত ছিলেন, 'তিন পা'ওয়ালা সিসিলিয়ান', 'পৃথিবীর একমাত্র তিন পেয়ে ফুটবল খেলোয়াড়', 'চিকিৎসা শাস্ত্রের সবথেকে বড় বিস্ময়', আবার তাকে 'মহান লেন্টিনি' নামেও ডাকা হতো। তিনি সার্কাসে ওই তিন নম্বর পা দিয়ে দড়ির ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে চলতেন, স্কেটিং করতেন, সাইকেল চালাতেন, ফুটবল খেলতেন। 

সার্কাসে নিজের দারুণ দক্ষতার প্রদর্শন করা ছাড়াও লেন্টিনির ব্যক্তিত্ব ছিল বেশ আকর্ষণীয়। তিনি খুবই মিশুকে এবং মজাদার মানুষ ছিলেন। তার সঙ্গে মিশলে বোঝা যেত তার মধ্যে হাস্যরসের উপস্থিতি ঠিক কতটা পরিমানে ছিল। সারাক্ষন মজা করতে থাকা, লোককে হাসানো তার অভ্যাস ছিল। একটা মজার ঘটনা বলি এইক্ষেত্রে। একবার লেন্টিনি একটা ইন্টারভিউ দিচ্ছেন। ইন্টারভিউয়ার লেন্টিনিকে একটু অপ্রস্তুতে ফেলার জন্য প্রশ্ন করেন, 'আপনি নিজের তিনটে পায়ের জুতো কীভাবে কেনেন?' লেন্টিনি একটুও সময় নষ্ট না করে উত্তর দেন, "আমি সবসময় দু'জোড়া জুতো কিনি। তার মধ্যে থেকে তিনটে আমি পরি, আর একটা জুতো আমার এক বন্ধুকে দিয়ে দিই যার একটা পা নেই।" আর এক ইন্টারভিউয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়, "আপনার তিনটে পা, আপনি কেমন অনুভব করেন?" লেন্টিনি উত্তর দেন, 'ধরে নিন পৃথিবীর সমস্ত মানুষের একটাই হাত, শুধু আপনারই দু'টো হাত। এ'বার আপনি যেমন অনুভব করছেন, আমিও তেমনই করি..."। নিজের ইন্টারভিউগুলোকে আরও মজাদার করে তোলার জন্য তিনি নিজের তিন নম্বর পা-কে টুলের মতো ব্যবহার করে তার ওপরেই বসতেন। 

নিজের দক্ষতার বাইরেও দেশজুড়ে লেন্টিনি পরিচিত ছিলেন একজন বুদ্ধিমান, মজাদার, ভালো মনের মানুষ হিসাবে। ইতালি থেকে আমেরিকায় এসে তিনি ইংরেজি ভাষা শেখেন। ১৯০৭ সালে, ১৮ বছর বয়সে বিয়ে করেন থেরেসা মুরে নামক এক আমেরিকান অভিনেত্রীর সঙ্গে। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে তাঁরা একসঙ্গে সংসার করেন। জন্ম দেন চারটি শিশুর। যাদের নাম জোসেফিন, নাটালে, ফ্রান্সিসকো জুনিয়র এবং জিয়াকমো। ১৯৩৫ সালে লেন্টিনি এবং থেরেসার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। লেন্টিনি কয়েক বছর পর আবার ভালোবাসার সম্পর্কে আবদ্ধ হন হেলেন শুপে নামক এক মহিলার সঙ্গে এবং বাকি জীবনটা তাঁর সঙ্গেই কাটান। 

নিজের গোটা জীবনে লেন্টিনি কখনও সার্কাসের জন্য কাজ করা থামাননি। ১৯৬৬ সালে, ৭৭ বছর বয়সে ফুসফুসে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যান ফ্র্যাঙ্ক লেন্টিনি। নিজের শেষের দিনগুলোতে সার্কাস করা ছেড়ে দিলেও, তিনি শেষবয়সে আমেরিকার যে এলাকায় থাকতেন, সেই এলাকায় আরও কিছু নিজের মতো মনোরঞ্জনকারী মানুষদের নিয়ে মনোরঞ্জন করতেন এলাকাবাসীদের। 

শরীরের অদ্ভুত অস্বাভাবিকতা নিয়ে গোটা জীবন কাটানোর পরেও, সমাজের ভ্রুকুটি সহ্য করতে না পেরে পরিবারের সাথে দেশ ছাড়ার পরেও, আর চারটে মানুষের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হওয়ার পরেও, শরীরে তিনটে পায়ের উপস্থিতির কারণে সারাজীবন রাতে বিছানায় স্বাভাবিক ভাবে ঘুমাতে না পারার পরেও, লেন্টিনি কখনও হতাশ হয়ে পড়েননি। তাঁর ভাষায়, 'আমি কখনও অভিযোগ করিনি। জীবন খুবই সুন্দর, এবং আমি এই জীবনকে নিয়ে বাঁচতে খুব ভালোবাসি'।

তাঁর মৃত্যুর ৫০ বছর পর, ২০১৬ সালে ইতালিতে তার হোম টাউন, যেখান থেকে একসময় তার পরিবারকে পালিয়ে আসতে একপ্রকার বাধ্য করা হয়েছিল, সেই একই শহরে, ইতালির রোসোলিনিতে দু'দিন ব্যাপী এক স্মৃতি উৎসবের মাধ্যমে উদযাপন করা হয় তাদের শহরের নায়ককে। ফ্রাসিসকো ফ্র্যাঙ্ক লেন্টিনিকে। এ'খানেই লেন্টিনির জয়, এখানেই লেন্টিনির 'দ্য গ্রেট লেন্টিনি' নামের স্বার্থকতা। ফ্রান্সিসকো ফ্র্যাঙ্ক লেন্টিনি নিজের ৭৭ বছরের জীবনে শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, থামার ইচ্ছা না থাকলে মানুষ নিজেকে কীভাবে অপ্রতিরোধ্য করে তুলতে পারে। নিজের দুর্বলতাকে কীভাবে মানুষ নিজের অস্ত্রে পরিণত করতে পারে। আর কীভাবে হাসতে হাসতে, হাসাতে হাসাতে একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে...

More Articles