বিশ্বের ৫ কোটি মানুষকে বাঁচিয়েছে নুন-চিনি জল! মরণোত্তর পদ্মবিভূষণে সম্মানিত দিলীপ মহলানবিশ

Dilip Mahalanabis ORS: বনগাঁর উদ্বাস্তু শিবিরে মড়কের খবর পেয়ে ছুটলেন দিলীপ। ক্যাম্প জুড়ে ছড়িয়ে থাকা রোগী, যত্রতত্র মল, দুর্গন্ধ!

চলে গিয়েছেন নীরবে। অথচ দেশকে দিয়ে গিয়েছেন এমন এক ওষুধ যা বিকল্প আজও নেই। বুধবার পদ্ম পুরস্কার প্রাপকদের তালিকা ঘোষণা করা হয়েছে। এবার মরণোত্তর পদ্মবিভূষণ পাচ্ছে দিলীপ মহলানবিশ। ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন বা ORS তৈরির নেপথ্যে থাকা এই মানুষটি প্রয়াত হয়েছেন সদ্য। ২০২২ সালের ১৫ অক্টোবর কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি ৮৮ বছর বয়সে। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ দিলীপ মহলানবিশকে ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশনের (ORS) ব্যাপক ব্যবহারের জন্যই মরণোত্তর সম্মানে সম্মানিত করা হয়েছে। বহুযুগ ধরে ডায়রিয়া, কলেরা এবং ডিহাইড্রেশনের কারণে মৃত্যু ৯৩ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে এই নুন-চিনি জল! ।

রাজাকারদের অত্যাচারে তখন বাংলাদেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। চলে আসছেন এপারের বাংলায়। কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানেই তখন রিফিউজি ক্যাম্প। গিজগিজ করছে মানুষ। কোনও রকমে প্রাণ বাঁচাতে টিকে রয়েছেন বাংলাদেশের নাগরিকরা। এমন এক সময়ে বনগাঁর উদ্বাস্তু শিবিরে মড়ক লাগে। একের পর এক মানুষ আক্রান্ত হন ডায়েরিয়ায়। কলেরায় উজাড় হতে থাকে রিফিউজি শিবিরগুলি। এই মানুষদের বাঁচাতে সহজ টোটকার আবিষ্কার করে ফেললেন দিলীপ মহলানবিশ।

আরও পড়ুন- ওআরএস-এর জন্মদাতা! ডায়েরিয়া নিরাময়ে ইতিহাস গড়েছিলেন দিলীপ মহলানবিশ

১৯৩৪ সালের ১২ নভেম্বর অবিভক্ত বাংলার কিশোরগঞ্জে জন্ম দিলীপ মহলানবিশের। ১৯৫৮ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ডাক্তারি পাশ করে সেই হাসপাতালেই শিক্ষানবিশ চিকিৎসক হিসেবে যোগ দিলেন। লন্ডনে জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা শুরু হওয়ায় তখন বহু চিকিৎসকের প্রয়োজন পড়ে। দিলীপও আবেদন করেন ওই পদে, সুযোগও পান। লন্ডন থেকেই ডিসিএইচ ডিগ্রি অর্জন, তারপর এডিনবরা থেকে এমআরসিপি। কুইন এলিজাবেথ শিশু হাপাতালের রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মজীবনের শুরু। সেই প্রথম কোনও বাঙালি এই পদের দায়িত্বে আসেন। দিলীপ মহলানবিশের বয়স তখন মাত্র ২৮। আমেরিকায় জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা-সংক্রান্ত একটি বিভাগে ফেলো পদেও যোগ দিলেন তিনি। সেই সূত্রেই ১৯৬৪ সাল নাগাদ ফিরে এলেন কলকাতায়। বেলেঘাটার আইডি হাসপাতালে তখন মূলত কলেরা আক্রান্তদের চিকিৎসা হত। এখানেই চিকিৎসার সঙ্গেই শুরু করলেন ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন বা ওআরএস ও স্পেশাল মেটাবলিক স্টাডি নিয়ে কাজ, গবেষণা।

বনগাঁর উদ্বাস্তু শিবিরে মড়কের খবর পেয়ে ছুটলেন দিলীপ। ক্যাম্প জুড়ে ছড়িয়ে থাকা রোগী, যত্রতত্র মল, দুর্গন্ধ! সবাইকে স্যালাইন দিয়ে সারানো সম্ভবও না! উপায় না দেখেই নুন, চিনির জলের প্রয়োগ শুরু করলেন দিলীপ মহলানবিশ। নুন, চিনি আর বেকিং সোডার মিশ্রণ বানিয়ে একের পর রোগীকে খাওয়াতে শুরু করলেন। এক লিটার জলে ২২ গ্রাম গ্লুকোজ় বা চিনি, সোডিয়াম ক্লোরাইড বা নুন ৩.৫ গ্রাম। আর তার সঙ্গে প্রায় ২.৫ গ্রাম সোডিয়াম বাইকার্বনেট অর্থাৎ বেকিং সোডা দিয়ে তৈরি করলেন মিশ্রণ। কাজ হতে থাকল। ডায়ারিয়ার মূল যে সমস্যা, ডিহাইড্রেশন কমতে থাকল ধীরে ধীরে। প্রচুর চাহিদার মুখে কম পড়ল ওআরএস। নিজেই বাজা থেকে নুন, চিনি কিনে ১৬ লিটারের ড্রামে তৈরি করলেন মিশ্রণ। প্রায় দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলল লড়াই।

১৯৮৪ বা ১৯৮৫ সাল নাগাদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডায়ারিয়া রোগ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডে চিকিৎসক নিযুক্ত হলেন তিনি। ডাক পড়ল ইউনিসেফ থেকেও। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ডায়েরিয়া রোগ গবেষণা-কেন্দ্রের প্রধান নিযুক্ত হন দিলীপ মহলানবিশ। ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান পদ্মবিভূষণে সম্মানিত হচ্ছেন এই চিকিৎসকই। ৭৪ তম প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে সরকার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, দিলীপ মহলানবিশের প্রচেষ্টায় ওরাল রিহাইড্রেশন সিস্টেম বা ওআরএসের ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রায় পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে।

 

More Articles