উঠোন পেরিয়ে ইতালি, চোখে দেখা সাধু অসাধুর বৃত্তান্ত

প্রায় দু'দশক ধরে দেশ বিদেশের নানা অস্থানে- কুস্থানে, আজাগায়-কুজাগায়, বিখ্যাত-অখ্যাত নানা পরিসরে থাকতে হয়েছে। কোথাও ভালো থেকেছি তো কোথাও খারাপ। কোথাও মজা, কোথাও ভয়। কাজ-অকাজের সীমারেখা ঘুচিয়ে শুধু কাটিয়ে দিয়েছি সময়। কোথাও হয়তো একটা আনন্দের মনোময় আভাস ছিল। তা না হলে এমত দিব্য কাটিয়ে দেওয়া যায় না।  সময়কে অতিক্রম করা যায় না। নিজেকে দেখা যায় না। বোঝা যায় না যে আমার মধ্যেই বাসা বেঁধেছে প্রতিষ্ঠান, আমাতেই লীন আছে অহেতুক স্থিতি জাড্য। সে সব হলো জ্ঞানের কথা।

আসলে যেখানেই যখন গেছি, কেন জানি না, সব সময় একটা না একটা বিপরীত স্রোতের মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে। তাদের মত ও কথার সঙ্গে আমি হয়তো একমত নই। কিন্তু তাতে কি? ওই যে ভিন্ন পথ বা অন্য পন্থা আমাকে আকৃষ্ট করেছে। যেমন কাজের সূত্রে  নানা ধরনের ধর্মীয় মানুষের সাথে সঙ্গ করেছি। তথাকথিত ধর্ম আমার সহ্য হয় না। কিন্তু কী একটা কারণে টিকে গেছি, মানে ওটাই তখন আমার আস্তানা, আমার কাজ। তা সে যত কম সময়ের জন্যই হোক। সেখানে আধ্যাত্মিক বেসামাল কথা আছে। পূজার্চনার প্রকারভেদে বাড়াবাড়ি আছে। তথাপি আমি আছি।

এ পর্বে তেমনি কিছু ধর্মীয় পরিসরে এক-আধজন মানুষের কথা লিখব। তারা ভেকধারি এবং জটাজুটোও। হ্যাঁ, জটাই দেখেছি। কোনো হেড গিয়ার নয়। এরা বিদেশি কিন্তু হিন্দু ধর্মে আস্থা রেখেছে। এরা নিজেদের মতো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের আদি অন্তের ধার ধারে না। কিন্তু ধর্মবিশ্বাসে একনিষ্ঠ। সচরাচর যেহেতু ধম্মকথায় রুচি নেই তাই এদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন খানিকটা দুরূহ মনে হয়। আদতে কিন্তু একটা যোগাযোগ তৈরি হয়ে যায়। তৈরি হয় তার চর্চার প্রত্যন্ত প্রদেশে হানা না দিয়েও। তার দৈনন্দিনের সাক্ষী থেকে। ওই যে লিখেছি, ভালো মন্দ সব ছিল। কিন্তু আমি কে, ভ্যালু জাজমেন্ট করার? বরং যেটুকু দেখা শোনা,  কিঞ্চিত বোঝাবুঝির মধ্যে একটা নির্বাচনী মন তৈরি করার চেষ্টা করছি।

এমনি একজনের সাথে দেখা। তার নাম মারিও। ওর পদবি বলে না। বাপের দেওয়া নামকে অস্বীকার করে নিজের নাম বলে রুইদাস। সত্তরের কোঠায় ছুঁই ছুঁই এই ইটালিয়ান মানুষটির সাথে দেখা হয়েছিল ফ্লরেন্সের কাছে  তোস্কানায়। আপাদমস্তক সাধুর ভেক ও ভাব। বড়সড় চেহারার এই সাধু শহর থেকে দুরে একটা পাহাড়ের ওপর থাকে। পাহাড়ে থাকা যত না বিষয় তার চেয়ে বড় বিষয় তার চারপাশ। হাজার দেড়েক বছর পুরনো একটি ভেঙে পড়া চার্চকে ঘিরে রুইদাসের বসবাস। চার্চের মধ্যে একদিকে যিশু ও মা মেরির মূর্তি আর অন্যদিকে শিব ও পার্বতী। এমন কীর্তি রুইদাস ছাড়া আর কে করবে? সেখানে দুবেলা সন্ধ্যা আরতি হয়। চমৎকার প্রসাদ বিতরণ হয়। তবে চালকলাফলমূল নয়। ইউরোপিয়ান প্রসাদ। চকলেট থেকে পেস্তা-কাজু-কিসমিস।

এই পাহাড়ের তিন দিকে বিস্তীর্ন ভ্যালি, সেখানে চাষবাস হয়। মূলত অলিভ আর তার সঙ্গে ধান গম ডাল সবজি। এদিকে চার্চের পিছন দিকটায় একটি বহু পুরনো কবরখানা। জঙ্গল পেড়িয়ে পাহাড়ি উঁচু নিচু পথ হেঁটে সেখানে পৌঁছাতে হয়। খুবই রোমাঞ্চকর এবং তার সঙ্গে রোমান ইতিহাসের গল্প জুড়ে গেছে লোকচর্চায়। ওই যে বিস্তীর্ণ চাষের জমি তার সমস্ত দেখভাল ও পরিচর্যা রুইদাসের নেতৃত্বে তার স্ত্রী, এক ছেলে ও তার বউ মিলে সামলায়। পরিবারে আর আছে সাধুর বছর তিনেকের নাতি। এখানে একাধিক আধুনিক ট্রাক্টর ও ছোট বড় মিলিয়ে নানা কিসিমের মাল বওয়ার গাড়ি আছে পাঁচ-ছটা।সাধু নিজের উৎপাদিত ধান গম সবজি আর অলিভ তেল এই সব গাড়িতে করে শহরে পৌঁছায় বিক্রির জন্য।

এই দুর্গম পাহাড়ি অবস্থানে রুইদাস সাধু অন্তত পঞ্চাশ-ষাটজন থাকতে পারে তার জন্য ছোটো ছোটো কটেজ করে রেখেছে। দু'জন করে থাকতে পারে আবার প্রশস্ত ডরমিটরিও আছে। আছে প্রকৃতির সংলগ্ন মায়ায় একটি আড্ডাঘর বা কমিউনিটি কিচেন। খাদ্যখাবার যেমন ইউরোপীয় বা ইতালিয় থাকে আবার এই মুলুকের পাকিস্তান বা ভারতীয় বংশোদ্ভূতরাও রান্নাবাটিতে থাকে কখনো কখনো। বাঙালিদের সেই আড্ডার কিচেন ঘরে পেয়েছি। সমবৎসর এখানে বিভিন্ন উৎসব,প্রদর্শনী এবং কর্মশালার আয়োজন থাকে। তা কখনো সম্পূর্ণত সাধুর নিজ দায়িত্বে, কখনো বা বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগে। সেরকমই এক অনুষ্ঠানে ছিল আমার প্রথম যাওয়া।

মারিও ওরফে রুইদাস কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ভারতবর্ষে এসেছে,এই বল্লভপুরেও এসেছে। তার হিমালয়ের পাদদেশে যেমন ঘুরে বেড়ানো ছিল তেমনি নাকি একটা অন্বেষণও ছিল। খ্রিষ্টধর্মের প্রতি আস্থা অনেকদিন আগে থেকেই কমতে শুরু করে ছিলো তার। তারপর আর পাঁচটা সাধুর গল্পের মতোই দেখা হয়ে যায় গুরুর সঙ্গে। তাকে সর্বশক্তিমান মনে হয় ইত্যাদি প্রভৃতি। কিন্তু  নিজের সমাজকে অস্বীকার করে একটা সর্বধর্ম সমন্বয়ের রাস্তা নিয়েছে রুইদাস। এটাই উল্লেখযোগ্য। কিছুটা ইংরেজি জানে। মাঝে মধ্যে বাংলাও বলে। তাই লিখতে চাই যে সব সাধুকে ধর্ম দিয়ে দেখতে নেই কর্ম দিয়েও দেখা যায়, ভাব দিয়েও।

রুইদাসের বাইরেও একটা সাধু,মন্দির, ধুনি, যজ্ঞ, ত্রিশূল রয়েছে। দেশে দেখেছি, বাবুর বাড়ির ছেলেরা অপকর্ম করে সাধু সেজেছে। আসলে এই ভেক ধরলে সামাজিক বাধানিষেধ ও তাবৎ আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে দিব্য কাটিয়ে দেওয়া যায়। তার ফলে কি হচ্ছে সে প্রশ্নে যাচ্ছি না। শুধু একটা ইঙ্গিত করতে চাই যে ধর্মকে সামনে রেখে নিজেকে আড়াল করা এখন এমন দস্তুর যা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। নানা তালে বেতালে, নির্দিষ্ট কারনে, যে যুদ্ধদশা চলছে বিশ্ব জুড়ে সেখানে ধর্ম কোথাও রক্ষাকবচ কোথাও হাতিয়ার হয়ে উঠছে।

থাক সেসবের সমাজ পর্যালোচনা। বরং একটু অন্য কথা লিখি। রোমের উত্তর প্রান্তে একটি কালীমন্দির আছে। বেশ কয়েক বিঘের ওপর এই মন্দিরে অনেকে মিলে থাকা যায়। নানা ধরনের অনুষ্ঠান হয় এখানে। নাটক হয়, ছবি দেখানো হয়, প্রদর্শনী হয়। এই মন্দিরের ইতালিয় সাধুর হল, আলেসান্দ্র পাসে। সাধুবাজিতে তার নাম লিখিয়েছে যোগী কৃষ্ণনাথ। তো এই সাধুবাবা কি কম বয়সে আমোদগেঁড়ে নষ্ট জীবনের দিকে পা বাড়িয়ে ছিলেন? সে সব আমার জানা নেই। তবে ওর কাছে শুনেছি ভারতবর্ষে পৌঁছে সে পাসপোর্ট ফেলে দেয় এবং সাধুমহলে ঘুরতে থাকে হিমালয়ের পথে। প্রায় পঁচিশ বছর পর ভারত সরকার তাকে খুঁজে পায় ও গ্রেফতার করে। এদিকে আলেসান্দ্রর বাবা ওদেশের একজন সম্ভ্রান্ত বিচারপতি। ইতালি সরকার ও বাবার মধ্যস্থতায় সে ছাড়া পায়। কিন্তু ভারতবর্ষে আসার দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। বাবা তাকে এই জমিটি দিয়ে বাদবাকি জীবন নিজের মতো করে থাকতে বলে।

কৃষ্ণানাথের সঙ্গে একজন ইতালিায়ন মহিলা থাকে। মাতাজি গৌরীনাথ এক সময় রসায়ন বিজ্ঞানের শিক্ষিকা ছিলেন। ছেলেমেয়েরা বড় হলো আর স্বামীর সাথে মানানো গেল না। তো অবশেষে সে এখন এই আশ্রমবাসী। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা ধুনি জ্বলে, পূজার্চনা হয়, সুরে- বেসুরে ভজন হয়। সাত্ত্বিক খাদ্যখাবারের ব্যবস্থা আছে এখানে। ভরপুর তামাকসেবা চলে। কখনোসখনো উৎকৃষ্ট চরসের গন্ধে মন্দির মেতে উঠে। কিন্তু রাশভারি কৃষ্ণানাথের সমস্তটাই নিপুণ ভাবে নিয়ন্ত্রণে। বহুবার গেছি, নাটক দেখতে, গান শুনতে, ছবি দেখাতে। কিন্তু রাতে থাকিনি। জায়গাটাককে কেমন যেন মনে হয় কৃষ্ণনগরের অনতিদূরে কোনো এক গ্রাম। বাঁশবনের ছায়ায়, ফলপাকুড়ের গাছগাছালিতে পুকুরে ...

গত বছর শুনলাম সাধুকে পুলিশে ধরেছে নেশা আইনে। ওদেশ-বিদেশের নানা নাট্যকর্মী গায়ক লেখক সরকারের কাছে আবেদন করেছে ওকে মুক্তি দিতে। আমার কাছেও আবেদন পত্রে স্বাক্ষর করার জন্য পাঠানো হয়। আমি শুধু দেখি। আর কিছু করি না! ইতিমধ্যে শুনলাম, কৃষ্ণানাথ খালাস পয়েছে। আমি অবাক হলাম না।

More Articles