মালালা ইউসুফজাই - সর্বকনিষ্ঠ নোবেল পুরস্কার বিজয়িনী

সারা পৃথিবীর নজর এখন আফগানিস্তানের দিকে। পুরো দেশটা তালিবানদের কব্জায়। এখন সেখানে কোনও তরুণী যদি স্কুলে যাওয়ার চেষ্টা করে, তালিবানদের বন্দুকের গুলিতে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। মনে পড়ে,  ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা। নিজের স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল একটি মেয়ে। সেই সময় একজন মুখোশপরা বন্দুকবাজ তার স্কুল বাসে উঠে জিজ্ঞাসা করে- "মালালা কে"? তারপরেই ওই বন্দুকবাজ গুলি করে বাসের সিটে বসা একটি মেয়ের মাথার  বাঁ-দিকে। ১০ দিন পর মেয়েটির জ্ঞান ফেরে। সে তখন বার্মিংহামের একটি হাসপাতালের বেডে শুয়ে। সেই আক্রান্ত মেয়েটিকে গোটা বিশ্ব চেনে 'মালালা ইউসুফজাই' নামে। নারীশিক্ষার সমর্থনে প্রকাশ্যে কথা বলেছিল ওই একরত্তি কিন্তু জেদি মেয়েটি।

মালালার জন্ম পাকিস্তানে। ১৯৯৭ সালের ১২ জুলাই। মালালার বাবা জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাই চাইতেন পুত্রসন্তানকে যে স্বাধীনতা দেওয়া হয় সেই স্বাধীনতা নিজের মেয়েকেও দেবেন। সেইভাবেই মালালাকে বড় করে তুলেছিলেন তিনি।

মালালা উসাফজাই - সর্বকনিষ্ঠ নোবেল পুরস্কার বিজয়িনী

চিত্রঋণ : Google

জিয়াউদ্দিন একজন শিক্ষক। নিজেদের গ্রামে মেয়েদের একটি স্কুলও চালাতেন তিনি। সেই ভাবেই মালালাকেও শিক্ষা দেওয়া শুরু করেন। চলছিল ভালোই।  আচমকা জীবন বদলে গেল। তাদের শহর সোয়াট উপত্যকা দখল করে তালিবানরা।  বহু জিনিস নিষিদ্ধ হয়ে যায় তাদের শহরে। টিভি কেনা থেকে শুরু করে গান শোনার পাশাপাশি বন্ধ করে দেয় মেয়েদের স্কুল যাওয়াও। তালিবানরা জানিয়ে দেয়, কেউ যদি তাদের কথা অমান্য করে তাহলে তাদেরকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। এই কারণেই ২০০৮ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে বন্ধ হয়ে যায় মালালার স্কুল যাওয়া।

২০০৯ সালে যখন মালালার যখন ১১-১২ বছর বয়স, সেই সময় সে একটি ব্লগ লেখে।  লেখার মাধ্যমে সে আসলে তুলে ধরেছিল নিজের জীবনেরই কথা।  এর পরেই সাংবাদিক অ্যাডাম বি এলিক মালালার জীবন নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি ডকুমেন্টারি করেন। নিউ ইয়র্ক টাইমসের ওই ডকুমেন্টারি তুলে ধরেছিল মালালার জীবনের একটা বড় অংশ।  যার মাধ্যমে বিশ্বের একটি বড় অংশের কাছে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠে সে। চলতে থাকে সব ধরনের মিডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারও। ওই সময়েই আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয় মালালা।

২০১২ সালের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার পর ধীরে ধীরে  সুস্থ হয়ে ব্রিটেনে নতুন বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে থাকতে শুরু করে মালালা।এরপরেই সে প্রতিজ্ঞা করে প্রত্যেকটি মেয়ে স্কুলে না যাওয়া পর্যন্ত সে নিজের লড়াই চালিয়ে যাবে। তারপরই প্রতিষ্ঠা করা হয় 'মালালা তহবিল'। এই সংস্থাটির দ্বারা প্রতিটি মেয়ে যাতে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সুযোগ পায় সেই ব্যবস্থা করে সে। নিজের এবং তার বাবার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ হিসেবে ২০১৪ সালে ডিসেম্বর মাসে 'নোবেল শান্তি পুরস্কার' দিয়ে সন্মান জানানো হয় মালালাকে। সর্বকালের সর্বকনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী হিসেবে। নিজের পুরস্কারটি মালালা ভারতের শিশু অধিকার কর্মী কৈলাশ সত্যার্থীর সঙ্গে ভাগ করে নেন। দ্বিতীয় পাকিস্তানী হিসেবে নোবেলজয়ের কৃতিত্বও মালালার। এর আগে আর মাত্র একজন পাকিস্তানীই এই পুরস্কার পান। পদার্থবিদ আব্দুস সালাম। ১৯৭৯ সালে।

মালালাকে এই পুরস্কারটি দেওয়ার ব্যাপারে অনেকে আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন, আবার এমন অনেক মানুষও ছিলেন যাঁরা এই পুরস্কার দানের সিদ্ধান্তকে মন থেকে গ্রহণ করতে পারেননি, উল্টে সমালোচনা করেছিলেন। বিচারকদের যে কমিটি নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন একজন নরওয়েবাসী, ফ্রেডরিক হেফারমেল। তিনি বলেন যে, "যে সমস্ত ব্যক্তি কোনও একটি জনমোহিনী কাজ করে খ্যাতি লাভ করেছেন এবং এই জাতীয় পুরস্কার পেলে খুব খুশি হবেন এই ধরণের ব্যক্তিকে সম্মানিত করার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারের প্রচলন করা হয়নি। এই ধরনের ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করার ভাবনাটাই অপ্রাসঙ্গিক। সারা পৃথিবীর বুকে নিরস্ত্রীকরণের মত গুরুত্বপূর্ণ শান্তিকামী কাজ যিনি করবেন একমাত্র তাঁকেই এই সম্মানে ভূষিত করতে চেয়েছিলেন আলফ্রেড নোবেল |”

মালালা উসাফজাই - সর্বকনিষ্ঠ নোবেল পুরস্কার বিজয়িনী

চিত্রঋণ : Google

দর্শন, রাজনীতি এবং অর্থনীতি নিয়ে মালালা ২০১৮ সাল থেকে পড়াশুনা শুরু করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষা শুরু হওয়ার পর থেকে কমপক্ষে পরবর্তী ১২-বছর পর্যন্ত মেয়েরা যাতে সম্মানের সঙ্গে, নিরাপদে এবং নিখরচায় শিক্ষা লাভ করতে পারে তার জন্য মালালা তার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের বাধাহীন শিক্ষা সুনিশ্চিত করবার প্রয়োজনের কথা সাধারণ মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য মালালা পৃথিবীর বহু দেশে ভ্রমণ করেছে। বাল্যবিবাহ, লিঙ্গবৈষম্য, দারিদ্র এবং যুদ্ধদীর্ণ সমাজের জাঁতাকলে পড়ে যাতে মেয়েরা শিক্ষা-দীক্ষা ও আত্মবিকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয় তার জন্যও নিরন্তর চলেছে মালালার লড়াই।

২০১৩ সালের ১২ জুলাই তারিখে নিজের ১৬তম জন্মদিনে মালালা সংযুক্ত রাষ্ট্রপুঞ্জে বিশ্বব্যাপী মেয়েদের শিক্ষায় প্রবেশের অধিকার সুনিশ্চিত করবার আহ্বান জানিয়ে একটি বক্তব্য পেশ করেছিল। সেই দিনের ওই ঘটনাকে সম্মান জানিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জ দিনটিকে ‘মালালা দিবস’ বলে ঘ‌োষণা করেছে।

তথ্য সূত্র : https://malala.org/

More Articles