পল্লবী-বিদিশা-মঞ্জুষাদের মতো মানুষরা চরম মুহূর্তে মনের কথা বলবে কাকে?

মনে করে দেখবেন, সুশান্ত সিং রাজপুত মারা যাওয়ার পরেও একের পর এক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।

বিদিশা দে মজুমদার, ২১ বছরের অভিনেত্রী-মডেল পল্লবী দে-র মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি, সেই কথা ক'দিন আগে লিখেছেন ফেসবুকে, ঠিক যেমনভাবে লিখেছেন পল্লবীর আরও অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ঠিক সেভাবেই বিদিশা আত্মহত্যা করেন। বিদিশা মারা যাওয়ার পর একই ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেন তাঁরই 'বন্ধু' মঞ্জুষা নিয়োগী। এই লেখা আমি এখন লিখছি অত্যন্ত ভয়ের সঙ্গে, কারণ আমি জানি না আগামী দুই-তিনদিনে আরও কিছু নাম যোগ হবে কি না। এবং একটি বিষয় মাথায় রাখা এক্ষেত্রে দরকার, যিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন, তা প্রেমঘটিত কারণে না কেরিয়ারঘটিত, সেই প্রশ্নের উত্তর তাঁর সঙ্গেই চলে গেছে। আমরা শুধু আঁচ করতে পারছি মাত্র। সেই আঁচের উত্তাপ থেকেই এই লেখা।

 

ব্যক্তিগতভাবে আমি পল্লবী, বিদিশা, মঞ্জুষা- এঁদের কাউকেই চিনি না, জানি না। তাই এখনও অবধি পাওয়া খবরের ভিত্তিতে বিদিশা ও পল্লবীর মৃত্যুর কারণ সম্পর্ক, তাই-ই ধরে নিলাম। প্রেমিকের একাধিক প্রেম মেনে না নিতে পারার যে যন্ত্রণা, অথবা সম্পর্কে থাকাকালীন যে তিক্ততা, তা জমেছে বহুদিন ধরে, যে প্রেমের ক্ষত নিয়ে এঁরা বাঁচতে পারবেন না ভেবে মৃত্যুকে সহজ ভেবে আপন করে নিয়েছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ক্ষত সেরে উঠবে। কিন্তু আমি-আপনি-আমরা, যারা 'ইশ! এটা কোন কারণ হলো না কি' বলে দাগিয়ে দিচ্ছি, তাদেরকেই এই কথা বলার যে, একথা হয়তো ঠিক আপনাদের মনে হওয়া থেকে, কিন্তু তাঁদের এই প্রিয়, আদরের জীবন নিমেষে শেষ করে দেওয়া থেকে নয়। অনেক সময় যাঁরা আত্মহত্যা করতে গিয়ে সফল হননি, পরের দিন সকালে জ্ঞান ফেরার পর স্বীকার করেছেন যে, কোন ঘোরের মধ্যে থেকে তাঁরা এমনটা ঘটিয়ে ফেলেছেন, তাঁরা সেটা নিজেরাও জানেন না। তাও আমরা দাগিয়ে দিই, তাই যে কারণই হোক, বিদিশা, পল্লবী বা মঞ্জুষারা ভরসা করে পাশের মানুষটিকে তাঁদের এই চিন্তার কথা বলতেই পারেন না, অপরদিকের মানুষটির প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে।

 

বর্তমান সময়ে 'আমাকে দেখো’-র ইঁদুর দৌড়ে আমরা কি ভীষণভাবে অস্থির, ক্লান্ত, ভীত, অবসাদগ্রস্ত! এবং যদি মনের গভীরে ডুব দিয়ে দেখতে যাই, এই যন্ত্রণার শিকড়ও আছে অনেক গভীরে। আসলে আমরা সকলেই চাইছি গ্রহণযোগ্যতা, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, সহানুভূতি, প্রশংসা- যা আমাদের এই ক্ষমাহীন জীবনে ব্যাথায় লাগানো মলমের মতো কাজ করবে। ছোটবেলায় পাওয়া অসংখ্য অপমান, অমর্যাদা, হীনম্মন্যতা, নিরাপত্তাহীনতা- সমস্তকিছুই সেরে উঠবে সাফল্যের হাততালিতে। সেই আকাঙ্ক্ষা, সেই চাওয়া কি ভুল তবে? একদমই নয়। তবে খুব অল্প সময়ে অনেকটা চাওয়ার প্রত্যাশা হয়তো কিছুটা ভুল। আবারও বলছি, আমি ধরে নিচ্ছি, ওঁদের মৃত্যুর কারণ ওঁদের সঙ্গেই চলে গেছে। কিন্তু ভয়টা রয়ে গেছে যে, অন্য পল্লবী, বিদিশারা এখনও প্রহর গুনছেন কি না।

 

আরও পড়ুন: স্টারডমের দুনিয়া ক্ষমাহীন, পল্লবীদের দুঃখ বেড়ে বেড়ে ক্যানসার হয়ে ওঠে সেখানে


মনে করে দেখবেন, সুশান্ত সিং রাজপুত মারা যাওয়ার পরেও একের পর এক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সেই করোনাকালের পরিস্থিতিতে চাকরি খুইয়ে বহু মানুষ অবসাদগ্রস্ত, আর যাঁরা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের অনিশ্চয়তা ছিল সবচেয়ে বেশি। তখন বহু অজানা সুশান্ত একের পর এক আত্মহত্যা করেছেন, তাঁদের ক'জনকেই বা জানি বা চিনি আমি-আপনি? একজন সেলিব্রিটির মৃত্যুর পর যখন একের একের পর এক আত্মহত্যা ঘটতে থাকে, মনোবিদ্যার ভাষায় তাকে বলা হয় 'কপি ক্যাট সুইসাইড’। এখনও আপনি খেয়াল করে দেখবেন ফেসবুক স্ক্রল করলেই ‘জেনে নিন পল্লবী দে-র মৃত্যুর পিছনে থাকা গভীর রহস্য’ বা হোয়াটসঅ্যাপ স্ট‍্যাটাসে অথবা খবরের কাগজের পাতায়, টেলিভিশনে ক্রমাগত একই আত্মহত্যার খবর নিয়ে চাটনি, তা আসলে অনেক অবসাদগ্রস্ত, হেরে যাওয়া পল্লবীদের উত্তেজিত করে ফেলে মনের গোপনে। লক্ষ করে দেখবেন, এঁদের সকলের বয়স ২৫-এর মধ্যেই, আবেগপ্রবণতা থাকে এই বয়সে অনেক বেশি। আমরা জানি, কম বয়সে বিপ্লবী, রক্ত গরম হয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে (মনোবিদ্যায় জানা গেছে, কম বয়সে মস্তিস্কে আবেগের অভিঘাত বেশি হয়), তাহলে কমবয়সিদের প্রতি কেন আরও যত্নশীল হতে পারছি না? কেন এভাবে ভাবতে পারছি না যে, আমাদের সময় এমন হয়নি বলে এই সময় এরকমটা হবে না? কেন কিছু আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে আমরা ‘attention seeking’ বলছি, ও আসলে ভীতু, ওর আসলে আত্মহত্যা করার দম নেই- এই ধরনের মন্তব্য রাখছি?

 

এখানে একটি তথ্য জেনে রাখবেন শুধুমাত্র অভিনেত্রী-মডেল নয়, বেশ কিছু স্কুলপড়ুয়া আত্মহত্যা করেছেন এই ক'দিনের মধ্যেই। কাজেই যাঁরা লাইমলাইটে আছেন, তাঁরা নন, আরও অনেক মানুষ জীবনের চেয়ে মৃত্যুকে অনেক বেশি শান্তির,স্বস্তির মনে করে এই পদক্ষেপ নিচ্ছেন। ভাবুন এটা এখনই, কারণ স্রোতের দিকে ভয়ানকভাবে গা ভাসিয়ে দেওয়া একটা গোটা প্রজন্মকে না পারবে একটামাত্র লেখা সঠিক পথ দেখাতে, না পারবে মনোবিদরা একা লড়ে যেতে। দায়টা সকলের, দায়িত্বটা সকলকেই ভাগ করে নিতে হবে। আমরা কথা বলি, আমরা মানসিকভাবে পাশে থাকি। তাতে ‘সব’ ঠিক হবে না। কিন্তু পাশে থাকার প্রতিশ্রুতির বদলে, দাগিয়ে দিয়ে আঙুল তুলে প্রশ্ন করার বদলে হয়তো কিছুটা সহানুভূতি পাবে, যা হয়তো সেই সময়টুকুই তাঁদের দরকার।

 

এখানে একটা অনুরোধ, এমন কোনও ভাবনা এলে ফোন করা যেতে পারে, এমন দু'-তিনজন বন্ধুকে রাখুন কনট্যাক্ট লিস্টে। একটু হলেও স্থির হওয়া যেতে পারে, মৃত্যুচিন্তা একটি মানসিক অবস্থান, সেটা হঠাৎ করে কোনও পূর্বাভাস ছাড়া আসতে পারে এবং হঠাৎ করে চলে যেতেও পারে। গতকাল আধঘণ্টা ধরে ঘটতে থাকা মৃত্যুচিন্তাকে পার করতে পারলে, আগামীকাল আবার আমার বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করতেও পারে। চ্যালেঞ্জটা হলো ওই মুহূর্তটাকে পেরিয়ে যাওয়ার। তবে অনেক সময় কাছের মানুষও আমার মৃত্যুচিন্তাকে লঘু করে দিতে পারে, আমার নিজেকে গুরুত্বহীন মনে হতে পারে, তেমন হলে সুইসাইডাল হেল্পলাইন নম্বরে নির্দ্বিধায় ফোন করতে পারেন, বিশ্বাস করুন, এখানে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা প্রত্যেকে দক্ষ,অভিজ্ঞ এবং সেই সময়ে ফোনের ওপারে থাকা মানুষটি আপনার কাছের মানুষ, বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন। গভীর রাতেও তাঁরা ফোন তোলেন। গুগল সার্চ করলে একাধিক নম্বর পাবেন।সাংঘাতিক অসহায়তা থেকেই আত্মহত্যার চিন্তা আসে, শুধুমাত্র গভীর অবসাদ থেকেই নয়, তাৎক্ষণিক কোনও মুহূর্তে আমার মনে হতেই পারে, আমার সঙ্গে হওয়া অন্যায়, চূড়ান্ত রাগ,অক্ষমতা- এগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার অস্ত্র আর রইল না, তাই সেই যন্ত্রণা আমি নিজের ওপর প্রয়োগ করলাম, মৃত্যুকে বরণ করে।

 

এর পরেও আবার বলব, আমরা প্রত্যেকেই প্রবলভাবে চাই, জীবনকে জড়িয়ে-জাপটে ভীষণভাবে বেঁচে থাকতে। তাই একটা ছোট্ট অনুরোধ, প্লিজ সেভ করে রাখবেন সুইসাইডিয়াল হেল্পলাইন নম্বর অথবা বন্ধুর নম্বর। যাতে ‘মাঝরাতে আমি তোমার কথা বলব কাকে’ সত্যি হয়ে উঠবে, যাতে ‘বন্ধু হয়ে হাত বাড়ালে ঝড় থেমে যাবে, রাত মুছে যাবে’। বিজন ঘরে, নিশীথ রাতে বন্ধু জানবে, তার হাতখানি আছে।

More Articles