চোরাশিকারিদের ত্রাস, বন্যপ্রাণীদের বুকে আগলে রাখেন এই মানুষটা

পিরা রাম রয়্যাল ব্যাঙ্ক অফ স্কটল্যান্ডের তরফ থেকে 'Earth Heroes Award' সম্মানে ভূষিত হন। এই পুরস্কার তাঁরাই পান, যাঁরা পরিবেশ সংরক্ষণের কাজে বিশেষ ছাপ রাখেন, যাঁরা পরিবেশকে বাঁচাতে নিরলস পরিশ্রম করেন।

একটি কালো হরিণ ছটফট করছে রাস্তার ধারে। রাস্তাটি হল ৬৫ নম্বর জাতীয় সড়ক। একটি গাড়ির ধাক্কায় প্রায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে হরিণটি। দৃশ্যটি দেখে আর নিজেকে আটকাতে পারেননি পিরা রাম বিষ্ণোয়ি। নিজের ছোট্ট পাংচার সারানোর দোকানের সব কাজ ছেড়ে তিনি ছুটে চলে যান তার কাছে। নিজের অতি সামান্য আয় থেকেই তার চিকিৎসা করান এবং জঙ্গলে ছেড়ে দেন।

সেই শুরু। তারপর থেকে বছরের পর বছর ধরে তিনি সেইসব পশুদের চিকিৎসা করে চলেছেন, যারা নিজেদের বাসস্থানেই বহিরাগতদের দ্বারা আক্রান্ত। সেই বহিরাগতরা আর কেউ না, আমরা মানুষরা। রাজস্থানের জালোর জেলার ধামানা গ্রামের বাসিন্দা পিরা রাম হলেন বিষ্ণোয়ি সম্প্রদায়ের মানুষ। পরিবেশ সংরক্ষণ তাঁর রক্তে। স্বাভাবিকভাবেই, ওই কালো হরিণটিকে বাঁচানোর পরে তাঁর উপলব্ধি হয় যে, তিনি এই প্রাণীদের সংরক্ষণ করার কাজে ব্রতী হওয়ার মানসিকতা পোষণ করেন। লেগে পড়েন এই কাজে। অসুস্থ, দুর্ঘটনায় আক্রান্ত পশুপাখিদের তিনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে শুরু করেন, নিজের অত্যন্ত কম উপার্জন থেকেই তাদের ওষুধ কেনেন। নিজের বাসস্থানকে পশুপাখিদের আশ্রয়শালায় পরিণত করেন। সেই আশ্রয়শালায় ধীরে ধীরে ঠাঁই হতে থাকে কালো হরিণ, হরিণ, ময়ূর, শকুন, খরগোশ, বাঁদর এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণীদের।

"দিনের বেলায় আমি দোকানে কাজ করতাম, আর সন্ধেবেলায় সরকারি আধিকারিক, ডাক্তার, ধনী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দেখা করতাম, তাঁদের সাহায্য চাইতাম, যাতে তাঁরা এই বন্য পশুপাখিদের সাহায্য করেন। শুরুতে তাঁরা বিশেষ আগ্রহ দেখেননি ঠিকই, কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁদের মানসিকতায় পরিবর্তন হয়। আমি আমার কাজের মাধ্যমে তাঁদের বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হই", বলছিলেন পিরা রাম।

আরও পড়ুন: ভালো নেই ঘোড়ার দল, কী হতে চলেছে কলকাতার ঐতিহ্য ঘোড়ার গাড়ির ভবিষ্যৎ?

কিন্তু সুখ বেশি দিন টেকেনি। পিরা রামকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাঁর অপরাধ? তিনি সরকারের অনুমতি ছাড়াই বন্যপ্রাণীদের, বিশেষ করে বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীদের নিজের গৃহে রাখছিলেন। যেটা সত্যিই আইনের চোখে অপরাধ। তারপর তিনি সরকারের থেকে লিখিত অনুমতি আদায় করেন এবং সরকারেরই পরিত্যক্ত এক জমিতে বন্যপ্রাণীদের জন্যে আশ্রয়শালা গড়ে তোলেন। সেই আশ্রয়শালার যাত্রা শুরু হয় একফালি জমিতে, একটি হরিণকে নিয়ে। আজ সরকারি সহায়তায় সেই ফার্মের আয়তন প্রায় দুই একর।

"মানুষ আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে শুরু করলেন। অনেকেই এলেন। আমার থেকে কেউ আর ওষুধের দাম নিতেন না। আমার ফার্মের পশুপাখিরা বিনামূল্যে ওষুধ পেতে শুরু করল। ডাক্তাররাও বিনা পারিশ্রমিকে ওদের চিকিৎসা করা শুরু করলেন। অনেকে অর্থসাহায্য করলেন। সরকার থেকে আট জন সশস্ত্র রক্ষী দেওয়া হল এই বিপন্ন প্রাণীদের রক্ষা করার জন্য। শুধু তাই নয়, আমাকে যোধপুর চিড়িয়াখানার পশু চিকিৎসাকেন্দ্রে ছয় মাস প্রশিক্ষণ নেওয়ারও সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল", খুব গর্বের সঙ্গে বলছিলেন পির রাম।

এই পিরা রাম রয়্যাল ব্যাঙ্ক অফ স্কটল্যান্ডের তরফ থেকে 'Earth Heroes Award' সম্মানে ভূষিত হন। এই পুরস্কার তাঁরাই পান, যাঁরা পরিবেশ সংরক্ষণের কাজে বিশেষ ছাপ রাখেন, যাঁরা পরিবেশকে বাঁচাতে নিরলস পরিশ্রম করেন।

এই Earth Heroes Award পাওয়ার পথ কিন্তু খুবই কঠিন ছিল। নিজের প্রাণের বাজি লাগিয়ে এই কাজ করে যাচ্ছিলেন পিরা রাম। তিনি প্রায়ই চোরাশিকারিদের হাত থেকে বন্যপ্রাণীদের, বিশেষ করে বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীদের বাঁচাতেন এবং সেই অপরাধীদের পুলিশের হাতে তুলে দিতেন। সেই কারণে তিনি চোরাশিকারিদের লক্ষ্য হয়ে উঠেছিলেন। বেশ কয়েকবার তাঁর ওপর প্রাণঘাতী হামলা হয়। কিন্তু প্রত্যেকবারই তিনি বেঁচে যান।

"পরিবেশকে ধ্বংস করে যারা পেট চালায়, বন্যপ্রাণীদের হত্যা করে যাদের জীবিকা চলে, আমি তাদের ভাতে মেরেছি, আইনের হাতে তুলে দিয়েছি। তাই তারা আমাকে প্রাণে মারতে চেয়েছে। কিন্তু পারেনি। সরকার আমাকে সবসময়ই সাহায্য করে। আমার ফার্মে এই মুহূর্তে ৬০০টি পশু আছে, এবং গত দশ বছরে আমি ১২০০-রও বেশি বন্যপ্রাণীর শুশ্রুষা করেছি।"

ছোট্ট গ্রাম ধামানার আদর্শ পিরা রাম। মানুষটা কিন্তু এখনও নিজের পাংচার সরানোর দোকানের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। গোটা বিশ্বকে তিনি দেখাচ্ছেন যে, ভালো কাজ করতে প্রয়োজন স্রেফ ইচ্ছাশক্তির। সেটা থাকলেই পৃথিবীকে পাল্টে ফেলা সম্ভব।

More Articles