প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহকে ফাঁসি দিয়ে তালিবান সরকারের অট্টহাসি, বিশ্ব কেঁপেছিল

প্রসেনজিৎ চৌধুরী:সেদিন সকাল থেকেই কাবুলের রাজপথ জুড়ে প্রবল তালিবানি অট্টহাসি। থেকে থেকে আকাশের দিকে উল্লাসের গুলি ছোঁড়া আর কোলাকুলির পালা  চলছিল। অরক্ষিত স্থানীয় রাষ্ট্রসংঘ দফতরে বসে মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখছিলেন প্রেসিডেন্ট ড. মহম্মদ নাজিবুল্লাহ।

আফগানিস্তানের ক্ষমতায় তালিবান জঙ্গিরা চলে এসেছে। তাদের তাণ্ডবলীলা চলছে। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে এসে ড.নাজিবুল্লাহ হয়ত বা একটু স্বস্তিতে ছিলেন। স্ত্রী ও সন্তানরা বেঁচে গেল। তাদের ভারতে পাঠানো সম্ভব হয়েছে।

২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬

কাবুলের রাস্তায় সে এক পৈশাচিক উন্মাদনা। ল্যাম্প পোস্টে ঝুলছিল ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ড.নাজিবুল্লাহর দেহ। একপাশে ঝুলছে তাঁর ভাইয়ের দেহ। নিশ্চিন্তে সরকার গঠন করল তালিবান।

নাজিবুল্লাহর মৃত্যুর খবরটা পৌঁছল সদ্য বিলুপ্ত সোভিয়েত দুঁদে কেজিবি গোয়েন্দা কর্তাদের কাছে। রুশ রাজধানী মস্কোয় পরপর বৈঠক শুরু হয় আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে। পরিস্থিতি এমন হবে তার সম্ভাবনা আগেই করেছিল ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙে জন্ম নেওয়া রাশিয়া সরকার। বস্তুতপক্ষে পুরো  আন্তর্জাতিক মহল যেন অপেক্ষা করছিল ভয়ঙ্কর সংবাদটির জন্য- দুনিয়ার প্রথম কোনও জঙ্গি সংগঠনের সরকার চলতে শুরু করেছে।

২৬ সেপ্টেম্বর,১৯৯৬

কাবুলে নেমেছে ভয়ঙ্কর রাত। আফগান রাজধানীতে অরক্ষিত প্রেসিডেন্ট ড. নাজিবুল্লাহ। তিনি আপাতভাবে স্থান নিয়েছিলেন স্থানীয় রাষ্ট্রসংঘ কার্যালয়ে। সেখানেই ঢুকল তালিবান। বন্দি হলেন সোভিয়েত অনুগামী আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট। ব্যাস এটুকুই জানা গিয়েছে। সে রাতে কী ঘটেছিল তা অনুমান করা কঠিন কিছু নয়।

পরের দিন ২৭ সেপ্টেম্বর সকালে কাবুল থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল নাজিবুল্লাহর রক্তাক্ত দেহ টেনে হিঁচড়ে ল্যাম্প পোস্টে ঝুলিয়ে দিয়ে তালিবান জঙ্গিদের আনন্দে আত্মার হওয়ার ছবি। প্রবল অত্যাচারে মৃত্যু হয় ড. নাজিবুল্লাহর সেটা মৃতদেহ দেখেই বুঝেছিলেন রুশ, মার্কিন, ব্রিটেনের গোয়েন্দা কর্তারা।

বন্দি হয়ে মৃত্যু নিশ্চিত সেটা বুঝতে পেরেছিলেন নাজিবুল্লাহ। হয়ত এতটুকু ক্ষীণ আশা ছিল, আন্তর্জাতিক নিয়মকে একটু হলেও মানবে তালিবান। বারবার চেষ্টা করেছিলেন ভারতে যাওয়ার। কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় নয়াদিল্লি প্রথমেই আশ্রয় দেয় নাজিবুল্লাহর স্ত্রী ফাতানা নাজিব ও সন্তানদের। আফগান প্রেসিডেন্ট কে  রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিষয়ে আলোচনা চলানোর মাঝেই হয়েছিল হত্যাকাণ্ড।

ড. মহম্মদ নাজিবুল্লাহ-আফগানিস্তানের এমন এক প্রেসিডেন্ট যাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু বিতর্ক। তবে তিনিই ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন কব্জায় থাকা আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট অনুরাগী শাসক। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম তাঁকে বারবার দেশটির শেষ কমিউনিস্ট শাসক বলে চিহ্নিত করেছে। আসলে ড নাজিবুল্লাহ ছিলেন সোভিয়েতের অনুরাগী। লাল ফৌজের শক্তিতে চলা শাসক। মস্কোর নির্দেশিত 'কাঠপুতুল'।

আশির দশকে আফগানিস্তানের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক কৌশলগত দেশের ক্ষমতা দখলে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সফল হয়। তার অন্যতম আর একটি কারণ, সোভিয়েত সীমান্তের দেশ ছিল আফগানিস্তান। এই দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে মরিয়া চেষ্টা শুরু করে সোভিয়েত শাসক। স্বাভাবিকভাবেই পিছু হটে প্রতিপক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শুরু হয় আফগানিস্তান ঘিরে মস্কো-ওয়াশিংটন দড়ি টানাটানি।

প্রাথমিকভাবে আফগানিস্তানের দখল নেয় সোভিয়েত। কাবুল সহ দেশটির সর্বত্র সোভিয়েত সেনার নিরাপত্তার ভার নেয়। ইউরোপীয় রুশ সংস্কৃতির প্রভাব পড়তে শুরু করে আফগান জনজীবনে। অন্যদিকে রক্ষণশীল ধর্মীয় ব্যবস্থায় ধাক্কা লাগছিল। শুরু হয় ধর্ম ভিত্তিক সোভিয়েত বিরোধী সংঘর্ষ। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মদত দেয় জিহাদি গোষ্ঠীগুলিকে। তারাই পরে  হয় আল কায়েদা ও তালিবান জঙ্গি।

আফগানিস্তানের এই গৃহযুদ্ধে টানা এক দশক পার করেও সোভিয়েত সেনা পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। শুধু সোভিয়েত ভাঙার অপেক্ষা ছিল। কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের কিছু আগে থেকেই আফগানিস্তান ছাড়তে শুরু করে লাল ফৌজ। আফগানিস্তান জুড়ে জিহাদি গোষ্ঠীগুলি তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করছিল। আফগানিস্তান থেকে পুরোপুরি সোভিয়েত তার কর্তৃত্ব তুলে নিতেই অরক্ষিত হন ড. নাজিবুল্লাহ।

রাজধানী কাবুল ঘিরে নিতে থাকে জিহাদি সংগঠনগুলোর শীর্ষে থাকা তালিবান। তার পরের ঘটনা তো প্রথমেই বলা হয়েছে। ড নাজিবুল্লাহ কে খুনের দৃশ্য দেখেছিল দুনিয়া।

সোভিয়েত সরতেই আফগানিস্তানের মাটি নিজেদের কৌশলগত এলাকা করতে এগিয়ে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাদেরই মদতে ক্ষমতা দখল করা তালিবান কে হটাতে সেনা মোতায়েন করা হয়। যেভাবে সোভিয়েত সেনা সরেছিল, ঠিক সেভাবেই মার্কিন সেনা সালে। আবারও কাবুল ঘিরছে তালিবান।

তবে অবলুপ্ত সোভিয়েতের সঙ্গে আফগানিস্তানের সীমান্ত নিয়ে চিন্তিত বর্তমান রাশিয়া সরকার।সোভিয়েত ভেঙে গিয়ে তিনটি দেশ তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তানের সঙ্গে পৃথক সীমান্ত হয়েছে আফগানিস্তানের। সেই সীমান্ত বরাবর রুশ সেনা মোতায়েনের উদ্যোগ নিচ্ছে মস্কো।

ফের আফগানিস্তানে রুশি আধিপত্যের ইঙ্গিত।

Source:

Obituary: Dr Najibullah: The Independent, UK

Soviet invasion of Afghanistan: Britannica

In Afghanistan, the Dead Cast a Long Shadow

More Articles