নারীদেহের বন্ধ্যাত্বের সমস্যা
বন্ধ্যাত্ব এক আধুনিক সমস্যা। এই সমস্যা যে আগে ছিল না এমনটা নয় কিন্তু বর্তমানে নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত মানুষদের প্রায় ঘরে ঘরেই এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। ‘সেন্টারস্ অব ডিসিস কন্ট্রোল এবং প্রিভেনশন’– এর মতে, আমেরিকার মতো দেশে বছরে প্রায় ৬.৭ মিলিয়ন মানুষ এই সমস্যায় আক্রান্ত। ভারতের পরিসংখ্যানটা আরও ভয়াবহ। মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ বিবাহিত নারী-পুরুষ এই সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন।
৩০ মিলিয়ন দম্পতির মধ্যে কেবলমাত্র ৩ মিলিয়ন দম্পতিই এর চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে থাকেন। জানলে অবাক লাগলে, শহুরের মানুষদের মধ্যেই এই সমস্যা অধিকমাত্রার লক্ষ করা যায়। ভারতে, শহরে বসবাসকারী প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজন বিবাহিত দম্পতি বন্ধ্যাত্বের শিকার। তবে, এই সমস্যার সম্মুখীন হওয়া মানুষের পরিমাণও যেমন বেশি, সেরকমই বর্তমানে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির কারণে, ডাক্তারি পরামর্শ নিয়ে নানা ধরনের চিকিৎসার মাধ্যমে অনেকেই এই সমস্যার হাত থেকে রেহাইও পাচ্ছেন অতি সহজেই। বন্ধ্যাত্বের জন্য শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু উভয়েরই সমান গুরুত্ব থাকে। ডিম্বাণু নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আজ আপনাদের জানাব।
একজন কন্যাশিশু যখন জন্মগ্ৰহণ করে, তখন তার দেহে ডিম্বাণু সংখ্যা থাকে প্রায় কয়েক লক্ষের মতো। তারপর আসে মাসিকের পালা। একজন সুস্থ স্বাভাবিক নারীদেহে মাসিক শুরু হয় ১২ থেকে ১৪ বছর বয়েসের মধ্যেই। খুব স্বাভাবিকভাবেই সেই সময় থেকেই ক্রমে ডিম্বাণুর সংখ্যা কমতে শুরু করে । সেই সময় এই সংখ্যা এসে দাঁড়ায় চল্লিশ হাজার এবং বাকি ডিম্বাণুগুলি নষ্ট হয়ে যায়। এরপর তিরিশের কাছাকাছি বয়সে বা তিরিশের পরবর্তী বয়সে ডিম্বাণুর সংখ্যা খানিক দ্রুত হারে কমতে শুরু করে এবং সর্বশেষে ৪২ বছর বয়সে অতিদ্রুত হারে এই ডিম্বাণুগুলি নষ্ট হতে শুরু করে তখন স্বাভাবিকভাবে গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই হ্রাস পায়। এইসময় সন্তানধারণের জন্য অনেকেই ডাক্তারি পরামর্শ নিয়ে থাকেন। তবে এই সমস্যা যে কেবলমাত্র বয়সজনিত তেমনটাও নয় । অনেকের ওভারি বা ডিম্বাশয়ের কোন সমস্যা থাকলেও তাঁরা এই বন্ধ্যাত্বের সর্বোপরি ডিম্বাণু নষ্টের সম্মুখীন হতে পারেন।
অনেক মহিলার ক্ষেত্রেই মূলত ওভারি বা ডিম্বাশয়ে পূর্বের কোন সমস্যা থেকে ‘প্রিম্যাচিওর মেনোপজ’ হতে দেখা যায়, আবার অনেকে এরফলে অনিয়মিত মাসিক হতে দেখা যায়, অনেকের আবার মাসিক সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়।
সমস্যার কথা তো অনেক হল, এবার আসা যাক সমস্যা সমাধানের কথায়। চিকিৎসকেরা কিছু বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে এই ডিম্বাণু হ্রাসের বা ডিম্বাণু উপস্থিতির পরিমাপ করে থাকে । মূলত, যাঁদের ওভারিতে কখনও সার্জারি বা অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়েছে কিংবা যাঁদের বয়স ৩৫ এর বেশি অথবা যাদের ওষুধেও কোনরকমের ধনাত্মক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, তাঁদের ক্ষেত্রেই এই পন্থাগুলি গ্ৰহণ করা হয়ে থাকে।
চিকিৎসকেরা মহিলাদের মাসিক চলাকালীন, রক্তে অবস্থিত ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন এবং ইস্ট্রোজেন পরিমাপ করে থাকেন। ফলিকল হরমোনের অধিক মাত্রায় বেড়ে যাওয়া এবং ইস্ট্রোজেন হরমোনের কমে যাওয়ায় ফলে যে অসামঞ্জস্যতার সৃষ্টি হয় তা ডিম্বাণুর ক্ষেত্রে ক্ষতিকর। আবার রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরের অবস্থিত অ্যান্টিম্যুলেরিয়ান হরমোনের পরিমাপ করেন , এই হরমোনটি ফলিকল থেকে উত্পাদন হয়ে থাকে। যদি শরীরে এই অ্যান্টিম্যুলেরিয়ান হরমোনের পরিণাম কম হয় , তার মানে বুঝতে হবে ফলিকলের পরিমাণ কম এবং ফলিকলের সংখ্যা কম হওয়া মানেই গর্ভধারনের সম্ভবনা কম হয়ে যায়। আলট্রাসোনোগ্ৰাফির মাধ্যমেও এই ফলিকলের পরিমাণ বোঝা সম্ভব । কিন্তু এরপরেও অনেকেই গর্ভধারণে সক্ষম হয়ে থাকেন। এছাড়াও ‘স্টেস টিউব বেবি’ র মাধ্যমেও আজ অনেকেই মাতৃত্বের স্বাদ পেতে সক্ষম হয়েছেন।
এই প্রক্রিয়া হল বান্ধ্যত্বের চিকিৎসায় সর্বজন স্বীকৃত একটি পদ্ধতি । এই পদ্ধতির বিভিন্ন কৌশল রয়েছে, তার মধ্যে একটি হল আইভিএফ (ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে স্ত্রী দেহ থেকে একটি পরিণত ডিম্বাণু ‘ল্যাপারেস্কোপিক’ পদ্ধতিতে বের করে আনা হয় । তারপর সেটিকে নিয়ে যাওয়া হয় ল্যাবে , প্রক্রিয়াকরণের জন্য । এই একই সময়ে পুরুষ দেহ থেকে শুক্রাণু সংগ্ৰহ করা হয় এবং ল্যাবেই তারমধ্যে থেকে গুণমান বিচার করে একঝাঁক শুক্রাণু বেঁছে নেওয়া হয় । এরপর নিষিক্তকরণের জন্য ডিম্বাণুর ‘পেট্রিডিশে’ শুক্রাণু মিশিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে । মাতৃগর্ভের মতো পরিবেশ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে একটি ‘ইনকিউবিটরে’ ওই পেট্রিডিশটি রেখে দেওয়া হয় এবং ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টা পর জানা যায় প্রক্রিয়াটির সফলতা সম্পর্কে। এরপর ভ্রুণ সৃষ্টি হলে তা একটি বিশেষ নলের দ্বারা মায়ের জরায়ুতে স্থাপন করা হয় এবং এরপরেই অন্য ভ্রুণের মতোই তা বেড়ে চলে এবং মানবশিশুর জন্ম ঘটে । সূচনাপর্ব ছাড়া একেবারেই সাধারণভাবে শিশুটি মাতৃগর্ভে বেড়ে ওঠে। বহু ক্যানসারে আক্রান্ত মহিলা, যারা কেমো থেরাপি নিতে বাধ্য হয়েছেন , তারা এই পন্থায় আজ ফুটফুটে এক শিশুর জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছেন ।
তথ্যসূত্রঃ
১।https://www.msdmanuals.com/en-in/home/women-s-health-issues/infertility/problems-with-eggs
৩।https://www.womenshealth.gov/a-z-topics/infertility
৪।https://thediplomat.com/2018/05/indias-hidden-infertility-struggles/