উত্তরপ্রদেশে যোগী বনাম রাবণ, কে এই দলিত নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ?

“ব্যক্তি বড়া নেহি হোতা, পার্টি বড়ি হোতি হ্যায়, সংগঠন বড়া হোতা হ্যায়”

ভারতীয় রাজনীতি চিরকালই ‘আইকন’মুখী। শুধু আদর্শে আইকন নয়, বসনে, চলনে, বলনে রাজনীতিতে মূর্তিপুজোর ইতিহাস বেশ সম্পৃক্ত। মূর্তিপুজো বললে চটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে ইমেজপুজোও বলা যায়। হাঁটুর উপর ধুতি আর খালি গায়ের ইমেজ, ঘোড়ায় চড়া যোদ্ধার ইমেজ, কাঁধ অবধি ছোটো চুলে পাকা চুলের স্ট্রাইপ ইমেজ, সাদা ধুতি পাঞ্জাবীর ইমেজ অথবা সাদা শাড়ি আর চপ্পলের। ইমেজের ঠেলায় নেহেরু জ্যাকেট অবধি মোদি কুর্তা হয়ে যায় এ দেশে। কিন্তু সময় নতুন গল্প বলে।  যাদের কোনও ক্যারিশমাটিক নেতা থাকার কথা নয়, অথবা এলিট রাজনীতিতে যাদের ব্যক্তির ক্যারিশমার প্রয়োজন পড়ে না বলেই ধারণা তাঁদের নেতাদের উত্থানকাব্যও লেখা হচ্ছে। পশ্চাতে রেখেছো যাদের, তাদের নিজস্ব গল্প নিজস্ব তেজে প্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে মেইনস্ট্রিম রাজনীতিতেও। অন্তত বছর পনেরো আগেও এভিয়েটর সানগ্লাস পরা, সাদা কুর্তা, নীল পাগড়ি, মোচ পাকানো দলিত ‘হিরো’র কথা ভারতের প্রেক্ষিতে ভাবা সুসাধ্য ছিল না। উত্তরপ্রদেশে দলিত আইকন চন্দ্রশেখর আজাদের উত্থান দেশীয় রাজনীতি এবং দলিত অধিকারের লড়াইয়ে এক চমকপ্রদ মোড় অবশ্যই। সেই চন্দ্রশেখরই আজ যোগী আদিত্যনাথের মুখোমুখি।

ঔদ্ধত্য নয়, দাপট। চন্দ্রশেখর নিজের উত্থান এবং প্রসারের সবটুকু জুড়ে যা ভেবেছেন কিং সাইজেই ভেবেছেন। পিছিয়ে পড়া শ্রেণির কথা বলতে হলে নিজেকে কতখানি এগিয়ে রাখতে হয় সেটা চন্দ্রশেখর নিজের নাম দিয়েই শুরু করেছেন। নিজে নিজের নাম রেখেছেন ‘রাবণ’। ভারতের মহাকাব্যের পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ এবং নির্মিত খলনায়ককে নিজের সঙ্গে জুড়েছেন। রামের দেশে রাবণ হতে চাওয়ার মধ্যেকার দাপট শুধুই চমক তৈরি নয়। রাবণকে দলিত প্রতিনিধি করেছেন আজাদ, সেই একই রাজ্যে যেখানে ‘রাম কে নাম’ মসজিদ ভাঙা হয়, মাংসের ধর্ম নিয়ে পিটিয়ে মারা হয় অথবা ধর্ষণ করে জিভ কেটে নেওয়া হয় আজও। পপুলারিস্ট ক্ষমতা, তাকে আর্য নামেই ডাকো বা ব্রাহ্মণ্যবাদ তার উলটো দিকে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার বছর ধরে নিপীড়িত দলিতদের আইকন হতে হলে যে দাপটের দরকার তাকে সর্বহারাদের ক্ষমতার প্রতীক করে ভেবেছেন পেশায় আইনজীবী, আম্বেদকর দীক্ষিত এই নেতা। খুব সুচিন্তিতভাবেই নিজের স্টাইলকে ক্ষমতা ও দাপটের সমতুল করেছেন আজাদ, বিশেষ করে এই দেশে যেখানে সিনেমার ‘হিরো’ চিরকালই মান্যতা পায়। পায় বলেই সেই ইমেজকেই বাস্তবেও চায় মানুষ। সংবিধানের অধিকার থেকে যারা দীর্ঘদিন আঁধারে থেকেছে, জোর গলায় কথা অথবা চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহসও যাদের নেই, তাদের মেরুদণ্ডকে সোজা রাখতে ভরসা জোগাতে আইকন দরকার। ব্যক্তি বড়ো নয়। কিন্তু ব্যক্তির মধ্যেকার যে সমষ্টি ভাবনা তা বড়ো। কোনও কোনও মানুষ একাই সংগঠন।

“দ্য গ্রেট চামারস অব গডকৌলি ওয়েলকামস ইউ”

১৯৮৬ সালে জন্ম, উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর জেলায়। দেশের মোট দলিত জনসংখ্যার বিশ শতাংশই উত্তরপ্রদেশের। দেশে দলিত নির্যাতনের সবচেয়ে বেশি ঘটনাও এই রাজ্যেই। বাবা গোবর্ধন দাস, মা কমলেশ দেবী। বাবা সরকারি স্কুলের মাস্টার। শূদ্র শিক্ষক, তাকে শুনতেই হয় “চামার হ্যায় মাস্টারজা”। গোবর্ধনরা এই চামার জন্মকে কোনও দিন উদযাপন করতে পারেননি। কিন্তু চন্দ্রশেখর আজাদ নিজের রাজনৈতিক দর্শনে দলিতজন্মকে রোম্যান্টিসাইজ করার হিম্মত দেখাতে চেয়েছেন। বাবার মৃত্যুর পরে নিজের গ্রামের বাইরে বড়ো করে দ্য গ্রেট চামারস অফ গডকৌলি লেখার ধককে কেন্দ্র করে ঠাকুর ও দলিতদের বিরোধের পর থেকে দেশের দলিত রাজনীতির কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ নাম হয়ে ওঠেন আজাদ। মেথর পাড়া, মুচিপাড়ার নেপথ্যের জাতের পরিচয়কে অপমান নয় বরং জাত্যাভিমানের জায়গায় দেখার অভ্যাস করাটাই আজাদের ক্ষেত্রে অস্ত্র সম্ভবত। 

২০১৬ সালের ২১ জুলাই প্রথম ভীমআর্মির জন্ম, আম্বেদকরের নামে এক  বাহিনী। দলিতদের অধিকার রক্ষায় সতীশ কুমার, বিজয় রতন সিং আর চন্দ্রশেখর আজাদের ভীম আর্মি পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মীরাট, সাহারানপুর, শামলি, মুজফফরনগর জুড়ে দলিতদের শিক্ষার জন্য ৩৫০ টি অবৈতনিক স্কুল চালায়। বহুজনদের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার জন্য শিক্ষা মৌলিক অধিকারকে সর্বতোভাবে নিশ্চিত করা এবং সরাসরি মাঠে নেমে প্রতিবাদই ভীম আর্মির পথ।

ম্যায় উন লোগোকো রাজনৈতিক অধিকার দিলওয়ানা চাহতা হুঁ যিনহে হাজারো সালো সে নাকারা গ্যয়া হ্যায়

অধিকার কে কাকে দেয়? অধিকার কেড়ে নিতে হয়! কিন্তু অধিকার কী, কীভাবেই বা কাড়তে হয় এই গল্প দেশের ২৫% শতাংশ দলিত মানুষ কোনওদিন জানতেও পারেননি। জানতে পারেননি বলেই এখনও যে কোনও অপরাধে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া অব্যহত। দেশের জেলবন্দিদের মধ্যে ৩৩ শতাংশের বেশি মানুষ এখনও দলিত সম্প্রদায়েরই। সুতরাং অধিকার আর তা অর্জন, এই দুইয়ের যোগসূত্র লাগে। ক্ষমতায় না এসে বদল সম্ভব কী না এই তর্ক প্রতি ভোটে হেরে যায়। 

২০১৯ সাল, লোকসভা নির্বাচন! বারাণসী আসন থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন আজাদ। হতে পারে চমক, ভারতের রাজনীতিতে চমকের কদর রয়েছে সমস্ত এলিট দলেই। ঠিক তার পরের বছরই সংসদীয় রাজনীতিতে “বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়” লক্ষ্যে ভোটের লড়াইয়ে নামতে নিজের দল আজাদ সমাজ পার্টি তৈরি করেন চন্দ্রশেখর, ২০২০ সালের ১৫ মার্চ। সেই বছরই বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে প্রোগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের সঙ্গী হয় আজাদ সমাজ পার্টি।

যোগী বনাম রাবণ

উত্তরপ্রদেশের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে আরেকবার এই চমককেই বাজি ধরেছেন আজাদ। নিজের রাজনৈতিক কেরিয়ারে এই প্রথম ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন চন্দ্রশেখর। রাম বনাম রাবণ। যোগী বনাম রাবণ। গোরক্ষপুর আসন থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে আজাদ সমাজ পার্টির হয়ে লড়বেন চন্দ্রশেখর। অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে জোটের সমস্ত সম্ভাবনাকে উড়িয়ে বিজেপিকে সোজা সাপটা চ্যালেঞ্জ করেছেন চন্দ্রশেখর। গোরক্ষপুরে আজাদ বা ভীমআর্মির তেমন পোক্ত ঘাঁটিও নেই। আসনটিও বিজেপিরই বিধায়ক রাধা মোহন দাস আগরওয়ালের দখলে। যদিও বিধায়ক পদের জন্য এই প্রথম নির্বাচনে লড়বেন যোগী আদিত্যনাথ। ১৯৯৮ সাল থেকে টানা এই আসনেরই সাংসদ নির্বাচিত হয়ে এসেছেন যোগী। তবু যোগী আদিত্যনাথ যেখান থেকেই ভোটে দাঁড়াতেন না কেন তাঁর ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে দলিতদের হয়ে লড়তেনই আজাদ, অন্তত এমনটাই জানিয়েছেন বারে বারে। 

আরও পড়ুন-বড় ক্রিকেটারে নয়, বিরাট ব্র্যান্ডে মোহিত নিউ ইন্ডিয়ার জনগণমন

২০১৭ সালে সাহারানপুরে হিংসা ছড়ানোর অভিযোগে ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে গ্রেফতার হন চন্দ্রশেখর আজাদ। ২০১৮ সালে এক বছরের খানিক বেশি সময় পরে জেল থেকে ছাড়া পান আজাদ। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে একটি মিছিলে হিংসার উস্কানির অভিযোগে দিল্লি পুলিশ গ্রেফতার করে আজাদকে। হাথরাসে দলিত তরুণী মনীষা বাল্মিকীর গণধর্ষণের ঘটনায় প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে আবারও গ্রেফতার হয়েছেন চন্দ্রশেখর। তাঁকে নিজের ঘরে নজরবন্দি করেই খোলা মাঠে মাঝরাতে পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় মনীষার মৃতদেহ। 

রাজনীতিতে একেবারেই তরুণ হয়েও কীভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে হয় তা চন্দ্রশেখর আজাদ নিজের কর্মসূচি দিয়ে প্রমাণ করেছেন ঠিকই কিন্তু বিশ্বাসের ঘর যাদের পুড়েছে তারা ‘আজাদি’র গল্পে সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। ব্যক্তি নিজের আইকনত্বকে ছাপিয়ে যেখানে সংগঠন হয়ে উঠতে পারেননি সেখানে ভুক্তভোগী হয়েছেন সমর্থকরাই। অধিকার বা আজাদির গল্প বলতে গিয়ে দল বদলে নিয়েছেন বহুজন। ভারতবর্ষে নিজস্ব এক নয়া রাজনৈতিক ঘরানা গড়েছে, অথবা আবর্ত। যেখানে আদর্শ বা সংগঠনের ভিত্তির উপর ব্যক্তির কাট আউট দাঁড়িয়ে থাকে। চন্দ্রশেখর আজাদের উত্থানে দলিতদের উত্থান হবে কী না এই উত্তর আম্বেদকরেরও অজানাই সম্ভবত।

More Articles