পুতুল নাচ

"এই রানী মুড়ি ভাজছে,মুড়ি ভাজছে,মুড়ি ভাজতে ভাজতে ......বেলা হল।এই রানী চান করছে.....এই রানী চুল মুছছে,এই রানী চুল ঝাড়ছে, চুল ঝাড়ছে, চুল ঝাড়ছে......। রানীর চুল গিয়ে লাগল তার সতীনের গায়.... দুই সতীনে ঝগড়াঝাটি, মারামারি, মারামারি, মারামারি.....শাশুড়ি এলো ঠ্যাঙ্গা নিয়ে, দিল দুই ঘা।দুই সতীনের ঝগড়া শেষ।এবার দুই সতীনে ভাব করছে, জড়িয়ে ধরছে।" এই রকম মজাদার পুতুল নাচ দেখেছি, তার সঙ্গে পুতুলের নাচিয়ের অনর্গল কথকতা শুনেছি ছোটবেলায় ঝুলনের মেলায়। দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে বন্ধুদের সঙ্গে খুব হাসাহাসি করতাম | নিজেদের মধ্যে পুতুলনাচের কাহিনীর অভিনয় করতাম।খুব রঙ্গ হতো।

গত ২১শে মার্চ (কলকাতার মধুসূদন মঞ্চে) 'বিশ্ব পুতুলনাচ দিবস' উপলক্ষে,একটি উৎসবে যোগদান করার সুযোগ পেয়েছিলাম। দুদিন-ব্যাপী উৎসবে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে পুতুল-নাচ শিল্পীরা যোগদান করেছিলেন।তাদের উপস্থাপিত বিভিন্ন স্বাদের ও আঙ্গিকের পুতুল নাচ দেখতে দেখতে, ছোটবেলার স্মৃতি জেগে উঠেছিল। আর খুব আনন্দ হচ্ছিল এই কথা ভেবে, যে এই গ্রামীণ শিল্প-ধারাটি আজও সজীব হয়ে আছে এবং মানুষকে নির্মল আনন্দ বিতরণ করছে।

সেই উৎসবের আঙিনায় এইরকম কয়েকজন পুতুল নাচ শিল্পীর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার সুযোগ হয়েছিল।পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দকুমার থেকে আসা এক শিল্পীর কাছ থেকে জানলাম যে আমাদের দেশে চার ধরণের পুতুল নাচ দেখানো হয়.......ডাং পুতুল (বা Rod Puppet ), তারের পুতুল (বা String Puppet ), কাপড়ের তৈরী পুতুল (Glove Puppet ) যেটিকে পেছন দিক থেকে গ্লাভসের মত পরে আঙুলের সাহায্য নাচানো হয় এবং বেণী পুতুল (Shadow Puppet )।এদের মধ্যে ডাং পুতুল, তারের পুতুল আর কাপড়ের পুতুলই বাংলায় সর্বাধিক প্রচলিত আর জনপ্রিয়।মেদিনীপুর বিখ্যাত বেণী পুতুলের জন্য। দক্ষিণবঙ্গের জয়নগর এলাকা বিখ্যাত ডাং পুতুলের জন্য।আর নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জনপ্রিয় তারের পুতুল। এদের মধ্যে কাপড়ের তৈরী পুতুলের উপযোগিতা খুব বেশী। কারণ এগুলি ব্যাগে করে যেখানে খুশী নিয়ে যাওয়া যায়, পথের ধারে যেকোনো সুবিধাজনক জায়গায় আসর বসিয়ে এগুলি বার করে খেলা দেখানো যায়। তাই দেখতে উৎসাহভরে চারপাশে লোকজন ভিড় করে। ঐ শিল্পী জানালেন যে বিগত ৪০ বছর ধরে তিনি এই পুতুল নাচ দেখিয়েই জীবিকা নির্বাহ করেছেন।তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে ১২টি বেণী পুতুল (Shadow Puppet ) আছে। তাঁর বাবা একটি যাত্রাভিনয় দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাল্যকালে তিনি ঐ যাত্রাদলে বাবাকে সঙ্গ দিতেন, কখনো কখনো অভিনয়ের প্রয়োজনে বালিকা সেজে নাচ করতেন। অভিনয় শিল্পের যে প্রভাব তাঁর ওপর পড়েছিল, তার ছায়া পড়েছে তাঁর উপস্থাপিত পুতুলনাচে।

জয়নগর থেকে আসা এক পুতুল-নাচ শিল্পীর কথায় ...... পুতুল নাচের পরম্পরায় ডাং পুতুলই সর্বাপেক্ষা প্রাচীন।গ্রামের বৃদ্ধদের কাছে শুনেছি যে ডাং পুতুলের ৫০০ থেকে ৬০০ বছরের প্রাচীন পরম্পরা আছে। খুব সম্ভবত এই ডাং পুতুলের ধারণাটা এসেছে 'কাক-তাড়ুয়া' থেকে। প্রাচীন কালে এই পুতুল-নাচ শিল্পীরাই সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জন করতেন এবং তার মাধ্যমে অনেক প্রয়োজনীয় সামাজিক বার্তা ছড়িয়ে দিতেন। সমাজের মানুষের মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা ছড়িয়ে দেবার জন্য শিল্পীরা পৌরাণিক কাহিনীর উপস্থাপনা করতেন পুতুল-নাচের মাধ্যমে।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পৌরাণিক কাহিনী ও উপাখ্যানের ওপর নির্ভরতা অনেক কমে গেছে |

জয়নগরের ঐ শিল্পী নিজে যখন এই শিল্প-মাধ্যমের চর্চায় আসেন, তখন শুরুতে তিনি 'আলিবাবা ও চল্লিশ চোর'-এর কাহিনী, মুগলির কাহিনী উপস্থাপনা করতেন। অত্যাধুনিক কালে তিনি পুতুলনাচের মাধ্যমে জন-স্বাস্থ্য সম্বন্ধে ও পরিবার-পরিকল্পনা সম্বন্ধে জনতার মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। বালিকা -শিক্ষা ও নারী-শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের 'কন্যাশ্রী' নাম যে প্রকল্পটি আছে, তার গুনাগুন প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি সম্প্রতি একটি 'শো' করেছেন।

কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পুতুল-নাচের কাহিনী যেমন পরিবর্তিত হয়েছে, তেমন পরিবর্তিত হয়েছে পুতুল তৈরীর রীতি, প্রকরণ ও উপকরণ। অনেক আগে মাটির পুতুল নিয়ে খেলা দেখানো হতো। পুতুল ভারী হওয়ার জন্য সাবলীল ভাবে খেলা দেখানো যেত না। তারপর এল কাঠের পুতুল, সঙ্গে রঙিন সাজ।

নদীয়া জেলার হাঁসখালি থেকে আগত এক শিল্পী বললেন যে তাঁর পুতুলগুলি শোলা দিয়ে তৈরী।সেগুলি পেছন দিক থেকে তার দিয়ে বেঁধে খেলা দেখতে বেশ স্বাচ্ছন্দ হয়।তিনি তাঁর পুতুল নাচের মধ্যে দিয়ে জনমানসে বাল্য-বিবাহের কুফল, অরণ্য সংরক্ষণের সুফল এবং সীমান্ত -ঘেঁষা এলাকায় মানব-পাচারের প্ররোচনা এবং বিপদের সম্বন্ধে সচেনতা প্রসারের কাজ যথাসাধ্য করেন।

পুতুল-নাচ উৎসবের যিনি প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন, তিনি বললেন যে ২০১৬ সালে 'শকুন্তলা' নামে একটি উপস্থাপনার মাধ্যমে 'পরিবেশ দূষণ' সম্মন্ধে মানুষের মধ্যে সচেতনতা প্রসারের চেষ্টা করেছিলেন।সেখানে দেখানো হয়েছিল যেন রাজা দুষ্মন্ত এসে শকুন্তলার হাতে লালিত-পালিত তরু-লতা-প্রকৃতিকে ধ্বংস করছেন।

তিনি আরও বললেন যে বিগত ২০০ বছর ধরে এই শিল্প-মাধ্যমটি অবলম্বন করে পুতুল-নাচ শিল্পীরা অনেক যুগোপযোগী বার্তা জনমানসে ছড়িয়ে দিয়েছেন, এখন সময় এসেছে আমাদের দেশের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে সমন্বয় ও সৌভ্রাতৃত্বের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার, এই কাজ অবিলম্বে করা উচিত।।

তথ্য সূত্র : সংবাদপত্র, লেখক এর নিজস্ব সংগ্রহ

More Articles