স্বয়ং জগন্নাথের চিহ্ন! ১৫১ হাত দীর্ঘ ছিল পুরীর মন্দিরের নিশান, তার মাহাত্ম্য জানুন

পুরীর জগন্নাথে আস্থাশীল প্রতিটি ভক্তের হৃদয়ে তিরতির করে কাঁপছে সেই পতাকা। ভক্তেরা মানেন এই নিশানই জীবনের ঠিক ভুলের সংকেতবাহী। হ্যাঁ, পুরীর মন্দিরের নিশানের কথাই বলছি। বহু বছর পেরিয়েছে, কিন্তু এই নিশানের মাহাত্ম্য আজও অবাক করে। আজ দু'কথা বলা যাক এই পতাকা নিয়েই।

পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের চূড়ায় রোজ নিশান বাঁধা নিয়ম দীর্ঘকাল। প্রতি একাদশীতে একটি প্রদীপও জ্বালান হয় সেখানে। ৮০০ বছর আগে মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় নির্দিষ্ট চোল পরিবারের এক পুরুষকে মন্দিরের চূড়ায় বাঁধার জন্য এই ত্রিকোণ নিশান বাঁধার দায়িত্ব দেন রাজা অনন্ত বর্মণ চোড়গঙ্গ দেব। তিনিই ছিলেন এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। সেই থেকে এই চোল বংশের লোকেই এই নিশান বাঁধার কাজ করে আসছে প্রতিদিন। কথিত, এই সব নিশানেরা ওড়ে হাওয়ার বিপরীতে!

যে চক্রের গায়ে এই নিশান বাঁধা হয়, তার নাম নিলচক্র। লোহা, তামা, দস্তা, পারা, শিসা, পিতল, রুপো ও সোনা দিয়ে তৈরী এই অষ্টধাতুর চক্রের বাইরের ঘের ৩৬ ফুট, ভিতরের ঘের ২৬ ফুট। নানা কারুকার্য্যময় চক্রটি প্রায় ২ ইঞ্চি পুরু। মনে করা হয়, এই চক্র আসলে সুদর্শন চক্র, যা বিষ্ণুর সবথেকে শক্তিশালী অস্ত্র। ২১৪ ফুট উঁচুতে এই চক্রের ওপর খুঁটিতে যে পতাকাটি বাঁধা হয়, তার নাম পতিতপাবন বন। ওড়িয়া ভাষায় ‘বন’ শব্দের অর্থ ‘নিশান’। প্রচলিত বিশ্বাস এই পতাকা দর্শনেই পাপীতাপী লোকের পাপস্খালন হয়। সূর্যনারায়ণ রথ শর্মা, এক জগন্নাথ সংস্কৃতি-বিশারদ, বলেন, এই নিশান পরমব্রহ্মের চিহ্ন। ভক্তেরা যদি মন্দিরে নাও আসতে পারে, দূর দূরান্ত থেকেও এ পতাকা দেখে জগন্নাথকে ভোগ চড়ানো যায়, প্রসাদ দেওয়া যায়।

মন্দিরে নিশান উৎসর্গ করা পবিত্র বলে মনে করেন তীর্থযাত্রীরা। তাই প্রতিদিন নতুন নিশান বাঁধা হয় মন্দির চূড়ায়। এই নিশান বাঁধার জন্য সেই নির্দিষ্ট চোল বংশের দু'টি ছেলেকে ছোটবেলা থেকেই মন্দিরে চড়ার বিদ্যায় পারদর্শী করে তোলা হয়। এরা গরুড় সেবক বা চুনর নিয়োগ নামে পরিচিত। মন্দিরে এদের গুরুত্ব ভীষণ, কারণ প্রতি সন্ধ্যায় এরা ২১৪ ফুট মন্দিরের মাথায় চড়ে ভক্তদের উৎসর্গ করা পতাকা বেঁধে দিয়ে আসেন নীলচক্রের গায়ে লাগানো বাঁশের খুঁটিতে। খেয়াল রাখা দরকার, এই খুঁটিটি ৩৮ ফুট লম্বা, নীলচক্র ছাড়িয়ে আরও ২৫ ফুট উপরে উঠে থাকে। প্রশিক্ষণ ছাড়া সাধারণ মানুষের পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব নয়। খুঁটিতে নতুন পতাকাগুলি বেঁধে, পুরনো পতাকাগুলি ফের কোমরে জড়িয়ে নেমে আসেন প্রশিক্ষিত সেবায়েতরা। এই পুরনো নিশান বিক্রি হয়, কেনার জন্যে কাড়াকাড়ি পড়ে ভক্তদের মধ্যে।

ভক্তদের দেওয়া এই নিশানগুলি সাধারণত হলুদ এবং লাল রঙের। এর মাঝে সাদা রঙের এক ফালি চাঁদ ও সূর্য। এছাড়া সাদা নিশানও থাকে। শরত মোহান্তি নিজে একজন গরুড় সেবক। তাঁর বয়ানে, এককালে মন্দির চূড়ায় বিরাট বিরাট সব নিশান লাগান হতো। সে সব বহুদিনের কথা। এই সে দিনও, অর্থাৎ কয়েক দশক আগেও চুনর সেবকরা ১৫১ হাত নিশান লাগিয়েছে। তবে তা অতীত। শেষ এমনটা হয়েছে ১৯৯৩ সালে, সুনীল দত্ত নিজের ছেলের জন্য যখন নিশান দান করেছিলেন মন্দিরে। সঞ্জয় দত্তের নামে তখন টাডা কোর্টে কেস চলছে। সেদিনও শরতই নিশান তোলেন। যদিও আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়ার অনুরোধে এরপরে মন্দিরের পতাকার কমিয়ে প্রথমে ২১ হাত, পরে ১৪ হাত ও তার কম করা হয়। মন্দিরের সুরক্ষার জন্যই এই ব্যবস্থা।

বর্তমানে এই নিশান ১ ফুট থেকে ২৫ ফুট পর্যন্ত হয়। আকৃতি অনুযায়ী এই নিশান বাঁধার খরচ ধার্য্য হয়। নিশান যিনি বাঁধাতে চান, সেই ভক্ত নির্ধারিত মূল্যের বিনিময়ে নিজের নিশান মন্দিরের চূড়ে পাঠাতে পারেন।

আরও পড়ুন-বছর শেষ হোক পিটার ক্য়াটের চেলো কাবাবে, বানিয়ে ফেলুন বাড়িতেই

গ্রীষ্মের সময় প্রতিদিন সন্ধে পাঁচটায় রেশম বস্ত্রে সজ্জিত গরুড় সেবক সমস্ত নিশান নিজের কোমরে জড়িয়ে মন্দিরের গায়ে চড়তে শুরু করেন। শীতকালে এই সময় খানিকটা এগিয়ে আসে। তাঁর হাতে থাকে একটা ছোট লাঠি। মন্দিরের গায়ে যথেচ্ছ বাঁদরের উৎপাত। সেই জন্যই এই সাবধানতা। কয়েক মিনিটের মধ্যে গরুড় সেবক পৌঁছে যান মন্দিরের নৃত্যশালার ওপর। এরপর নীলচক্র পর্যন্ত প্রায় ১০০ ফুট খাড়া দেওয়াল। এক বিশেষ ভঙ্গিতে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে খাঁজে দু'দিকে বেরিয়ে থাকা দেওয়ালে হাত পা চেপে উঠতে থাকেন সেবায়েত। এই ওঠা এত সাবলীল যে দেখতে বিস্ময় লাগে! মন্দিরের শরীর পেরিয়ে আসে মন্দিরের চূড়া। এই অংশটি কমলালেবুর আকৃতির। লোহার মাচা আর মন্দিরের মাথায় ঝোলানো কাছির সাহায্যে এই অংশে উঠে পড়েন তাঁরা। গোটা ব্যাপারটা ঘটতে সময় লাগে মিনিট বিশেক। খুঁটি থেকে পুরনো নিশান নামিয়ে বাঁধা হয় নতুন নিশান। নীলচক্র মূলত আর্দিং-এর কাজ করে। সে জন্য ৩০০ফুট লম্বা ও ৪ ইঞ্চি চওড়া একটা লোহার পাত লাগানো রয়েছে এর সঙ্গে মন্দিরের দক্ষিণ দিক দিয়ে।

পতিতপাবন বন ঠিক করা হয় লটারির মাধ্যমে। অথচ স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস, পতিতপাবন বন যখনই হয় সাদা, তখনই ঝড় বৃষ্টি হতে বাধ্য। এ বছর যশ ঘূর্ণিঝড়ের সময় এই খবর ভাইরাল হয় স্যোসাল মিডিয়ায়। সত্যি দেখা গিয়েছিল সে সময় নিশানের রং সাদা। সেবায়তদের দাবি লটারি ছাড়া আর অন্য কোনও উপায়ে এই নিশান বেছে নেওয়া হয় না। কিন্তু এর পরের খবরেই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন ভক্তেরা। প্রচণ্ড ঝড়ে পতাকাটি উড়ে গিয়েছিল বলে জানা যায়। এই নিয়ে গত বছর ও এবছর মিলিয়ে বার পাঁচেক এমন ঘটল! নিশানের ইতিহাসে এ জিনিস সম্পূর্ণই নতুন, এর আগে এমন কখনও ঘটেনি বলে দাবি মন্দির কর্তৃপক্ষের! গত বছরে পতাকায় গিঁট পড়ে ওড়া বন্ধ হয়ে যায়, দ্বিতীয়বার পাপমোচনী একাদশীতে মানসিকা নিশানে আগুন লেগে যায় মন্দির চূড়ায় রাখা মহাদীপ থেকে। তৃতীয়বার এমন ঘটনা ঘটেছিল আমফানের ঠিক আগে। পতিতপাবন বন উড়ে গিয়েছিল সেবারও। গত বছরের জুন মাসে আবার নিশানটি উড়ে যায়। এত কম সময়ের মধ্যে বারবার এমন ঘটনা ঘটা অশুভ বলে মনে করেছেন অনেকেই। 

 

তথ্যঋণ-

  • FLAG CHANGING IN JAGANNATH TEMPLE DAILY SINCE 800 YEAR, July 21, 2018, Incredible Orissa
  • Neela Chakra, Puri District, Odisha Police
  • Holy patitapabana flag atop Jagannath Temple in Puri flies off in heavy rains, people panic, June 15, 2020, India TV
  • Puri Srimandir's Patitapaban Bana: Flag That Symbolises The Lord, 12 July 2018, Odishatv.in
  • Cyclone Yaas: Puri Shree Jagannath Temple Adorns White Flag Indicating Rainfall, Diptiranjita Patra, 25 May, 2021, Odishatv.in

More Articles