'আজ সকালে সে মারা গেছে', কাছের মানুষের মৃত্যুশোক সারাজীবন তাড়া করেছে রবীন্দ্রনাথকে

পরিবারে পরের পর মৃত্যু সয়েছেন আজীবন। মৃত্যুকে যেভাবে দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ, তাতে জীবন দিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়েছে কবিকে।

মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান/

মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজুট,/

রক্ত কমলকর, রক্ত অধরপুট/

তাপবিমোচন করুণ কোর তব/

মৃত্যু অমৃত করে দান...।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের প্রথম প্রভাতে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে অমৃতের স্বরূপ বলে আহ্বান করেছিলেন ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীরত 'মরণ’ পদে। পরিবারে পরের পর মৃত্যু সয়েছেন আজীবন। মৃত্যুকে যেভাবে দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ, তাতে জীবন দিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়েছে কবিকে। তাই বোধহয় কবি অতি সহজেই বলতে পেরেছেন- 'আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।' গানটির আলোকে সহজেই অনুমান করা যায়, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচিন্তায় নান্দনিকতার সফল উপস্থিতি।

সুদীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে রবীন্দ্রনাথকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত ধারণ-লালন করতে হয়েছে। বালক বয়সে মায়ের মৃত্যু এবং পরবর্তীতে সন্তান ও স্ত্রীর অকালমৃত্যু। মৃত্যুর মতো বেদনাবহ ঘটনা যেখানে সমগ্র মানবসত্তাকে ওলটপালট করে দিতে পারে, সেখানে রবীন্দ্রনাথ একান্ত স্বজন হারিয়েও নিজেকে স্থির রেখেছেন। তাঁর কাব্যকে প্রতিষ্ঠা করেছেন জীবনমৃত্যুর সীমানা ছাড়িয়ে অনন্ত বিশ্বে। তবে কাব্য-সাহিত্যে কবির 'মৃত্যু দর্শন’ নানা অনুষঙ্গে বিকশিত ও সমন্বিত। অন্তঃস্থলে প্রচুর ভাঙচুরকে লালন করে বলেছেন,

জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে,

বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে।।

কৈশোরে মায়ের বিদায়, যৌবনে চলে গেলেন কবির সমস্ত ভুবনজুড়ে থাকা নতুন বৌঠান। এরপর একে একে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, বাবা এবং নাতি। পরিবারে পরের পর মৃত্যু সয়েছেন। অন্তরের অন্তঃস্থলে কতই না ভাঙচুর। তবু জীবনবোধে অবিচল।

মা সারদাসুন্দরী দেবী
তখন তাঁর বয়স ১৩ বছর ১০ মাস। অসুস্থ হওয়ার পর তিনতলার ঘরে থাকতেন মা সারদা দেবী। একদিন গভীর রাতে পুরনো এক দাসীর চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল কিশোর রবির। পরেরদিন সকালে পেলেন মায়ের মৃত্যুসংবাদ।

রবীন্দ্রনাথ 'জীবনস্মৃতি'-তে লিখেছেন,

প্রভাতে উঠিয়া যখন মার মৃত্যু সংবাদ শুনিলাম তখনো সে কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম, তাঁহার সুসজ্জিত দেহ, প্রাঙ্গণে খাটের ওপর শয়ান। মৃত্যু যে ভয়ঙ্কর সে দেহে তার কোনও প্রমাণ ছিল না। জীবন হইতে জীবনান্তের বিচ্ছেদ স্পষ্ট করিয়া চোখে পড়িল না।

শুধু মায়ের দেহ যখন সদর দরজার বাইরে আনা হলো, সবাই যখন শ্মশানের পথে অনুগামী হলো, কিশোর রবিও যখন সে-পথ ধরলেন, তখন যেন হঠাৎ অনুভব করলেন মায়ের শূন্যতা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,

মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকন্নার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না।

নতুন বউঠান কাদম্বরী
প্রকৃতপক্ষে কবি মৃত্যুর স্বরূপ প্রথম চিনতে পেরেছিলেন তাঁর নতুন বউঠান কাদম্বরীর মৃত্যুতে। কবির কথায়, 

আমার চব্বিশ বয়সের সময় মৃত্য়ুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল, তাহা স্থায়ী হইল।

কবি চব্বিশ বছর লিখলেও তখনও তাঁর ২৩ পূর্ণ হয়নি। ১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল। অভিমানে আফিম খেয়ে আত্মঘাতী হন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী। নতুন বউঠান ছিলেন কবির ভুবনজুড়ে। তাঁর বৌদ্ধিক আদানপ্রদানের সঙ্গী, তাঁর হাসিখেলা, সুখ-বেদনার সঙ্গী। এক নিমেষে মিলিয়ে গিয়ে কবিকে দিয়ে গেলেন, অপরিসীম বিচ্ছেদশোক। "তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছে", লিখেছিলেন কবি।

স্ত্রী মৃণালিনী দেবী
তিরিশ-চল্লিশ বছর তো দূরের কথা। উনিশটা পেলেন না কবির সংসর্গ। চলে গেলেন ২৯ বছরের মৃণালিনী। মাধুরীলতা, রথীন্দ্র, রেণুকা, মীরা, শমীন্দ্র- পাঁচ সন্তানের মা মৃণালিনীর শরীর তখন ভেঙে পড়েছে। শান্তিনিকেতন থেকে তাঁকে নিয়ে আসা হলো জোড়াসাঁকোয়। ডাক্তারদের সঙ্গে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন কবি নিজেই।

একদিনের ঘটনা। মৃণালিনীর কথা বলার শক্তি নেই। রথীন্দ্রনাথকে ডেকে মায়ের বিছানার পাশে বসালেন রবীন্দ্রনাথ। মৃণালিনীর চোখ দিয়ে তখন শুধুই জলের ধারা। সেই রাতে রথী আর বাড়ির ছোটদের পুরনো বাড়ির তেতলায় পাঠিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। পরদিন ২৩ নভেম্বর, ১৯০২। চলে গেলেন কবিপত্নী মৃণালিনী।

প্রথম সন্তানশোক, মারা গেলেন রেণুকা
মৃণালিনী মারা যাওয়ার পর বছর না ঘুরতেই চলে গেলেন কবির তৃতীয় সন্তান তথা দ্বিতীয় কন্যা রেণুকা। তিনি যক্ষ্মায় ভুগছিলেন। জোড়াসাঁকোয় রেণুকার খোঁজখবর নিতে প্রায়ই যান রবীন্দ্রনাথের বন্ধু রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী। তেমনই একদিন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর রামেন্দ্রসুন্দর জানতে চাইলেন, রেণুকা কেমন আছেন। রবীন্দ্রনাথ বললেন, "আজ সকালে সে মারা গেছে।" দিনটা ছিল ১৯০৩ সালের কোনও এক সেপ্টেম্বর।

কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্র
কবির বাবার মৃত্যুর বছর দু’য়েক পরেই রবীন্দ্রনাথ হারালেন তাঁর কনিষ্ঠপুত্র শমীন্দ্রনাথকে। তিনি মারা যান কলেরায়। এই মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ্যে শোকপ্রকাশ করা প্রায় পরিত্যাগ করলেন। কাদম্বিনী দত্তকে লিখেছিলেন,

ঈশ্বর আমাকে বেদনা দিয়েছেন, কিন্তু তিনি তো আমাকে পরিত্যাগ করেন নাই। তিনি হরণ করিয়াছেন, পূরণও করিবেন। আমি শোক করিব না। আমার জন্য শোক করিয়ো না।

জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীতলা
রেণুকার মতোই যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলেন জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতা। রবীন্দ্রনাথ-মৃণালিনীর প্রথম সন্তান মাধুরীলতা। ফুল ভালবাসতেন। তাই রবীন্দ্রনাথ আদর করে তাঁকে ডাকতেন বেলি নামে। ১৬ মে, ১৯১৮। মাত্র ৩১ বছর বয়সে চলে গেলেন মাধুরীলতা।

রথীন্দ্রনাথ তাঁর রোজনামচায় লিখেছিলেন, দিদিকে দেখতে যাওয়ার আগে সেদিন বাড়ির ডাক্তারকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, মৃত্যুভয় তাঁর আর নেই। তিনি তৈরি আছেন।

কবির প্রিয় নাতি নীতীন্দ্রনাথ মারা যান ১৯৩২-এর ৭ অগাস্ট, ১৯৩৯ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ। এর ৯ বছর পর আর এক বাইশে শ্রাবণ প্রয়াত হন কবি।

রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে 'জীবন'-এর অপর নামে আখ্যায়িত করেছেন। ইন্দ্রিয়াতীত বিভিন্ন জিজ্ঞাসার আলোকে তা স্পষ্ট। মৃত‍্যুকে তিনি অনন্ত জীবনের যাত্রাপথে পরমাত্মীয়র মতো নতুন জীবনপথের অনুসন্ধানদাতা হিসেবে উপলব্ধি করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনায় যে মৃত্যুদর্শন এঁকেছেন, তা কালক্রমে হয়ে উঠেছে নান্দনিক ও জীবনদর্শন। তিনি লিখেছেন,

জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো।

সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো

More Articles