বন্ধুপুত্র দেবেন্দ্রনাথের হাত থেকে নিমন্ত্রণের চিঠি নেননি রামমোহন

১৮৩৮ সাল, শহর কলকাতায় সেদিনের শরতের সকালটিও ছিল বেশ ঝলমলে। রাজা রামমোহন রায়ের বাগানবাড়িতে এসেছেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র, বারো বছরের দেবেন্দ্র। সঙ্গে একটি নিমন্ত্রণের চিঠি। কিসের নিমন্ত্রণ? এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে একটু ঘুরে আসতে হবে কলকেতার সাবেকী আবহে।

তখন প্রায় সব জমিদারই বাড়িতে দুর্গা পুজো হত। আর ওই সময়ের কলকাতার যে কোনও জমিদার বা বনেদি পরিবারের দুর্গা পুজোকে টেক্কা দিতে পারত ঠাকুর পরিবারের পুজো। ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো রাজকীয় আকার ধারণ করেছিল নীলমণি ঠাকুরের নাতি প্রিন্স দ্বারকানাথের সময়। বিপুল বৈভবে পুজো শেষ হত নবমীর রাতে। দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের পর ঠাকুরবাড়িতেও আয়োজন হত বিজয়া সম্মিলনীর। সেই উপলক্ষে খোলা ঠাকুরদালানের জলসায় নাচ, গান, নাটক এবং অন্যান্য আমোদপ্রমোদ চলত মহা সমারোহে। নাম করা ওস্তাদরা সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। ঝাড়বাতির নীচে বিজয়ার রাজসিক খাওয়াদাওয়া, মিষ্টিমুখ, গোলাপজল, আতর, পান আর কোলাকুলি। তখনকার সমাজের বিশিষ্টজনেরা ঠাকুরবাড়ির দুর্গোৎসবে আমন্ত্রণ পেতেন। আমন্ত্রণপত্র লেখা হত দ্বারকানাথের পিতা রামমণি ঠাকুরের নামে।

১৮৩৮ সালের ওই সকালে ১২ বছরের দেবেন্দ্রনাথ তাঁর পিতৃবন্ধু রাজা রামমোহন রায়কে ঠাকুরবাড়ির দুর্গা পুজোয় আমন্ত্রণ জানাতে হাজির হয়েছিলেন দাদুর পাঠানো নিমন্ত্রণ পত্র নিয়ে। বালক দেবেন্দ্র রামমোহনকে বলেন, ‘সামনে পুজো তাই তিনদিনই প্রতিমা দর্শনে আপনার নিমন্ত্রণ, পত্রে দাদুর এই অনুরোধ।’’ ব্রাহ্ম রামমোহন রায় প্রতিমা পুজোয় যার একেবারেই বিশ্বাস বা আস্থা নেই তিনি এই আমন্ত্রণে খুব বিস্মিত হয়েছিলেন। বন্ধু দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্রকে তিনি খুব স্নেহ করতেন তাই নিমন্ত্রণপত্রটি প্রত্যাখ্যান করেননি আবার সরাসরি সেটা গ্রহণও করেননি, তিনি তাঁর ছেলে রাধাপ্রসাদের কাছে দেবেন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। রাধাপ্রসাদ পিতার হয়ে সেটা গ্রহণ করে দেবেন্দ্রনাথকে মিষ্টিমুখ করিয়ে দিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই পৌত্তলিকতার বিরোধী রামমোহন সেই দুর্গাপুজোয় যাননি; বদলে তাঁর ছেলে রাধাপ্রসাদ গিয়েছিলেন। নিমন্ত্রণপত্র দেখে রাজা কি বলেছিলেন দেবেন্দ্রনাথকে? শিশু দেবেন্দ্র শালগ্রাম শিলা, দুর্গোৎসব, ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরীর নিষ্ঠাবান ভক্ত ছিলেন। কিন্তু তার অব্যবহিত পরেই জীবনের ধ্রুবতারাকে খুঁজে পেয়েছিলেন পিতৃসুহৃদ রাজা রামমোহন রায়ের চৌম্বক-ব্যক্তিত্বে। বাড়ির দুর্গাপূজায় রাজাকে নিমন্ত্রণ করতে গেলে তিনি এক ভাবের মধ্য থেকে তাঁর এই অসমবয়সি ‘বেরাদর’কে (রামমোহনের স্নেহ সম্বোধন) বলেন, ‘‘আমাকে পূজায় নিমন্ত্রণ?’’ দেবেন্দ্রনাথ পরে বলেছেন, ‘‘তাঁহার কথাগুলি আমার পক্ষে গুরুমন্ত্র স্বরূপ হইয়াছিল। তাহা হইতে আমি ক্রমে পৌত্তলিকতা ত্যাগ করিলাম।’’

ইতিহাসের এক আশ্চর্য সমাপতনে ওই ঘটনার আট বছর পর তরুণ দেবেন্দ্রনাথই উপনিষদের প্রথম শ্লোকের অর্থের মধ্যে ব্রহ্মজ্ঞান খুঁজে পেয়েছিলেন। পিতার বন্ধু রামমোহনের একেশ্বরবাদ মতবাদ সম্পর্কে তখন তিনি অবগত। পরের বছর সহযোগীদের নিয়ে একেশ্বরবাদ চর্চার লক্ষ্যে তিনি গড়ে তুললেন ‘তত্ত্বরঞ্জিনী সভা’। ওই সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে তত্ত্বরঞ্জিনী নাম পাল্টে হয় ‘তত্ত্ববোধিনী’ সভা। দু’বছর যেতে না যেতেই সেই সভার সঙ্গে যুক্ত হল ‘ব্রহ্মসভা’। ওই সভার দায়িত্ব নিয়ে পঁচিশ বছরের তরুণ দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মকে দীক্ষার ধর্মে রূপায়িত করে ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা করলেন। দেবেন্দ্রনাথের এই প্রচেষ্টায় যে রামমোহনের যথেষ্টই প্রভাব ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কেমন ছিল দুজনের সম্পর্ক? একটি ঘটনার উদাহরণই যথেষ্ট। রাজা রামমোহন রায় যখন ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন, তখন প্রায় সব পরিচিত জনই এসেছিলেন দেখা করতে। দেবেন্দ্রনাথ তখনও বালক, তাই তাঁকে আর আনা হয়নি। কিন্তু বাধ সাধলেন স্বয়ং রামমোহন। তিনি বললেন, দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা না করে তিনি দেশ ছাড়বেন না। শেষ পর্যন্ত দ্বারকানাথ ছেলেকে নিয়ে এলেন। দেবেন ঠাকুরের সঙ্গে হাত মেলান নেন তিনি। সেটাই ছিল দুজনের শেষ দেখা। ব্রিস্টলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রামমোহন। কিন্তু সেই করমর্দন দেবেন্দ্রনাথ ভুলতে পারেননি কোনওদিন।

বন্ধুপুত্র দেবেন্দ্রনাথের হাত থেকে নিমন্ত্রণের চিঠি নেননি রামমোহন

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ।। ছবি সৌজন্যে : Google

ঠাকুরবাড়ির স্বতন্ত্রতার একটি অন্যতম কারণ হল তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্ম। অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক। ধর্মীয় ভাবনায় তাঁরা পৌত্তলিকতা বা মূর্তি পুজোয় বিশ্বাসী ছিলেন না। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে তা হলে সেই বাড়িতে দুর্গা পুজো হত কি ভাবে আর তা বন্ধই বা হল কবে থেকে? দ্বারকানাথের জ্যেষ্ঠপুত্র দেবেন্দ্রনাথের হাত ধরেই ঠাকুরবাড়ি ধীরে ধীরে ‘ব্রাহ্ম’ বলে পরিচয় লাভ করে। পৌত্তলিকতার ঠাঁই নেই যে ধর্মে সেখানে দুর্গাপুজো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে বাধ্য। যদিও দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গেই পুজো বন্ধ হয়নি ঠাকুরবাড়িতে। কারণ, পরিবারের অনেকেই তা মানতে চাননি। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথও ব্রাহ্ম হওয়ার পর থেকে আর পুজোয় যোগ দেননি। ওই সময় তিনি হিমালয় ভ্রমণে যেতেন। তার কয়েক বছর পরে ঠাকুরবাড়ির পুজো চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।

কিন্ত কেমন জাঁকজমক হত দ্বারকানাথ ঠাকুরের দুর্গাপুজোয়? কথিত আছে ঠাকুরবাড়ির প্রতিবেশী শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের বাড়িতে প্রতিমার গায়ে শোভা পেত বহুমূল্য ফরমায়েশি গয়না। প্রতি বছর দ্বারকানাথের বাড়ির সামনে দিয়েই গা-ভর্তি গয়না পরে দাঁ বাড়ির প্রতিমা যেত বিসর্জনে। তখন একটি প্রবাদও চালু ছিল, দুর্গা নাকি কৈলাস থেকে মর্ত্যে এসে শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের বাড়িতে গয়না পরতে আসেন। অবশ্য সে গয়না বিসর্জনের আগে খুলে নেওয়া হত। দ্বারকানাথ ভাবলেন তাঁর আয়োজনে কোথাও যেন একটা ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। তাই মনে মনে ঠিক করলেন, এর যোগ্য জবাব দেবেন। তিনিও প্যারিস থেকে বহুমূল্য ফরমায়েশি গয়না আনিয়ে তা প্রতিমাকে পরালেন। আভিজাত্যের লড়াইটা জিততে দ্বারকানাথের নির্দেশে সেই সব বহুমূল্য গয়না সমেতই দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল।

আর এই বিপুল ভোগ বিলাসের পরিণতিতে কালের নিয়মে দ্বারকানাথ ঠাকুর দেনার ভার রেখে বিদেশে হঠাৎ প্রয়াত হওয়ার কিছু পরেই কার-টেগোর কোম্পানিটিও দেউলিয়া হয় (১৮৪৭)। পিতৃঋণ মুক্তির লক্ষ্যে ওই সময়ে দ্বারকানাথের প্রিয় বেলগাছিয়া ভিলা-সহ অনেক বাড়ি, আসবাব ও সম্পত্তি নিলামে তোলেন দেবেন্দ্রনাথ। ব্যয়সঙ্কোচের জন্য গাড়ি-ঘোড়া বিক্রি করেন, কাজের লোকের সংখ্যাও কমিয়ে দেন। এমন তথ্যও পাওয়া যায়, জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকে দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলিটির প্রান্ত পর্যন্ত বাড়ির সব জিনিসপত্র সাজিয়ে নিলামে তুলতে পনেরো দিন লেগেছিল! বন্ধু রাজনারায়ণ বসু দেবেন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘‘প্রতিদিন চর্ব্য চোষ্য লেহ্য পেয় পৃথিবীর যাবতীয় উপাদেয় খাদ্যদ্রব্য পূরিত টেবিলের পরিবর্তে ফরাসের উপর বসিয়া কেবল ডাল রুটি ভক্ষণ ধরিলেন।’’ সমস্ত পিতৃঋণ শোধ করতে দেবেন্দ্রনাথের প্রায় ৪০ বছর লেগেছিল।

তথ্যসূত্র - puronokolkata.com

আনন্দবাজার, রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য প্রবেশক (প্রথম খণ্ড), প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

 

More Articles